ত্রিপুরার উপযুক্ত জবাব
উচিত জবাব দিয়েছে ভারত। কমলপুর এলাকায় সন্ত্রস্ত করেছে সে পাক কামানের আওয়াজ। সীমান্তের সন্তস্ত মাত্র চার মাইল দূরে অবস্থিত ত্রিপুরার এই মহকুমা শহর। গত এগারদিন ধরে সেখানে পড়ছিল পাক গােলন্দাজদের কামানের গােলা। ধ্বংস হচ্ছিল বাড়ীঘর। প্রতিদিন বাড়ছিল হতাহতের সংখ্যা। আতঙ্কিত নরনারী পালাচ্ছিল ভিটেমাটি ছেড়ে। গােটা ত্রিপুরার দিন কাটছিল নিদারুণ সন্ত্রাসের মধ্যে। সবার মনে দানা বেধে উঠেছিল একটি মাত্র প্রশ্ন ভারত কি এতই দুর্বল কিম্বা সহনশীল? পাক-হামলার কি কোন প্রতিকার নেই? স্বদেশেও থাকবে না কি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বােধ? কতদিন পড়ে পড়ে মার খাবে তারা? অবশেষে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে উত্তর দিয়েছেন নয়াদিল্লী। সীমান্ত রক্ষীরা হেনেছে প্রত্যাখাত। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের বড় আঘাত তারা করেনি পাক-বাহিনীর উপর। এতে হয়ত হামলা চালাবেন ত্রিপুরায়। মুখ রক্ষার তাগিদে হয়ত হয়ে উঠবেন আরও বেপরােয়া। সীমান্ত রক্ষীদের প্রত্যাঘাতের ফল খুবই সীমিত। কিন্তুি তা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী। জওয়ানরা পেয়েছেন নয়াদিল্লীর ঢালাও হুকুম—আক্রান্ত হলে প্রত্যাঘাত করতে হবে। হামলাকারীদের ঠেলে পাঠাতে তাদের নিজের এলাকায়। কেন্দ্রীয় সরকারের এই কঠোরতা ব্যাপক ক্ষেত্রে কার্যকর হলে তার ফল ফলতে বাধা। পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকরা যুক্তির ভাষা বুঝেন না, বুঝেন মারের ভাষা। এই ভাষাতেই পাক-ধৃষ্টনার উত্তর দিতে ভারত তৈরী। নয়াদিল্লী দিয়েছেন তার আশ্বাস।
ত্রিপুরার ভৌগলিক অবস্থান ভারতীয় সমর-স্ট্র্যাটেজীর প্রতিকূল। সঙ্কীর্ণ পথে অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে তার যােগাযােগ। পাক জঙ্গীনেতাদের ধারণা, তারা অনায়াসেই অবরােধ করেত পারবেন এ রাজ্যটিকে। এই উদ্দেশ্যেই ত্রিপুরার উপর চলছিল অবিচ্ছিন্ন পাক হামলা। রেলপথ ধ্বংসের চেষ্টা করছিল পাক নাশকদল। ভারতীয় সমর নায়কেরা জানেন ত্রিপুরার রক্ষাব্যুহের দুর্বলতা। আগে ভাগেই সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতি অবশ্যকাম্য। অন্তত দু মাসের রসদ এবং অধিক সংখক সৈন্য মজুত রাখা দরকার ত্রিপুরায়। যুদ্ধের সময় এ রাজ্যটির উপর আসবে প্রথম আঘাত। শত্রুর আক্রমণ দু তিন সপ্তাহ ঠেকিয়ে রাখতে পারলে আর ভয় নেই। এর মধ্যেই ঘটবে ঢাকার পতন। সঙ্গে সঙ্গে অবরােধ মুক্ত হবে ত্রিপুরা। এই সম্ভাবনা সামনে রেখেই হয়ত তৈরী হচ্ছেন নয়াদিল্লী। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারতের যে-কোন অঞ্চলের উপর হামলা চালাতে বিনা শাস্তিতে ফিরে যেতে পরবে না পাকবাহিনী। কমলপুরের ঘটনায় তার প্রমাণ পেয়েছে পাকিস্তান। ত্রিপুরা সীমান্তের মারটা শেষ কথা নয়। ওটা সবে মাত্র আরম্ভ। ভাবতে অবাক লাগে কেন এতদিন অপেক্ষা করলেন নয়াদিল্লী? জনগণের মনেবলের উপর পড়ছিল অসম্ভব চাপ। হিমশিম খাচ্ছিলেন স্থানীয় সরকার। যে পিটুনী ব্যবস্থা সীমান্তরক্ষীরা এখন নিয়েছে অনেক আগেই তা নিতে পারত তারা। অবস্থা সঙ্কটজনক। আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। হয়ত দ্বিগুণ বিক্রমে ত্রিপুরার উপর পাক-বাহিনী করবে ব্যাপক হামলা। এই সম্ভাবনার পরিপেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু হয়েছে সেখানে।
ওটা পাক-আক্রমণ মােকাবিলার প্রস্তুতির পূর্বাভাস। শুধু ত্রিপুরা নয়, হয়ত আসামের সঙ্কটও আসন্ন। এই সীমান্তেও পাক-সৈন্যদের স্পর্ধা উচ্চগ্রামী। অদুর ভবিষ্যতে এখানেও দরকার পড়বে ভরতীয় জওয়ানদের পিটুনী-ব্যবস্থা। জনগণের মনােবল অক্ষুন্ন রাখার জন্যই ওটা অত্যাবশ্যক।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং জওয়ানদের তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিরাট দায়িত্ব পড়েছে জনসাধারণের উপর। দু-চারটা পাক গােলাগুলীতে সন্ত্রস্ত হলে চলবে ন। দৃঢ়তার সাথে মােকাবিলা করতে হবে আসন্ন। বিপদের। তারা যত ভীত চকিত হবেন জওয়ানদের কাজ তত জটিল হয়ে পড়বে। ভুলবেন না, তাদের পিছনে আছে বিশাল ভারতীয় বাহিনী। ইয়াহিয়া খান যদি যুদ্ধ বাধায় তবে সে যুদ্ধ তারা ঠেলে নিয়ে যাবে পাকিস্তানে হৃদপিন্ডের কাছে। পূবের মত পশ্চিম সীমন্তেও অগ্নিগর্ভ। কাশ্মীরে যুদ্ধ-বিরতি সীমারেখা বরাবর গত কয়েকদিন ধরেই চলছে পাক-হানাদারী। সেখানেও জওয়ানরা দিচ্ছে পাল্টা দাওয়াই। এক চোখে তিনি। কাঁদছেন এবং অপর চোখে আগুন ছড়াচ্ছেন। এরপর হয়ত তার চোখ থেকে ঝলসিবে আগুন। ইয়াহিয়া বলছেন—যুদ্ধ আসন্ন। হামলা চালাবে পাকিস্তান আর বসে মার খাবে ভারত। এ আশা নিঃসন্দেহে উম্মাদের দুরাশা। পাক হামলা প্রতিরােধে সীমিত প্রত্যাঘাত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার পক্ষে অপরিহার্য। তা না হলে ভেঙ্গে পড়বে জনগণের মনোেবল। বিঘ্নিত হবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আধুনিক যুগের যুদ্ধ শুধুমাত্র সৈন্যদলের লড়াই নয়, এটা সর্বত্মক সংগ্রাম। জনগণের অটুট মনোেবল এই সংগ্রামের অঙ্গ। ত্রিপুরার দাওয়াই নিঃসন্দেহে জনমানসে গভীর দাগ কাটবে। ফিরিয়ে আনবে তাদের সংগ্রামী চেতনা। যে দাওয়াই পেয়েছে পাকিস্তান তার মাত্রাদিকে হয়ত তার সদ্বিত ফিরবে। নইলে পাকিস্তান জ্বলবে। ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর চোখের জলে নিভবে এ আগুন। আর বাংলাদেশে পাক-দস্যুদের মহা কবরের উপর উড়বে জয়বাংলা পতাকা। তাকে বিজয়ীর অভিবাদন জানাবে মুক্তিবাহিনী।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ নভেম্বর ১৯৭১