You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.04 | শ্রীমতি গান্ধী কতােটা সফল ছিলেন? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শ্রীমতি গান্ধী কতােটা সফল ছিলেন?

বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের সামনে ভারতের সঙ্কটের আসল চেহারাটা তুলে ধরাই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বর্তমান বিদেশ সফরের প্রধান উদ্দেশ্য। এ কথা তিনি নিজেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বলে গেছেন। তাঁর সফর এখন ঠিক অর্ধ পথে। ইউরােপের দুটি অতি গুরত্বপূর্ণ দেশ বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়ার পর বৃটেন সফরের পালাও এখন সাঙ্গ। আলাপ-আলােচনার ধারা থেকে অনুমান ব্রুসেলস এবং ভিয়েন প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক সার্থকতা অর্জন করেছে। আমরা শুনছি, ঐ দুটি দেশ নাকি ভারতের সঙ্কটের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। বাংলাদেশ সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আমাদের অনেক মন্ত্রীই বিদেশে ছুটেছেন এবং ফিরে এসে রিপাের্ট দিয়েছেন যে সকলেই নাকি ভারতের বক্তব্য বুঝতে পেরেছে। তবু প্রধানমন্ত্রীর সফরের গুরুত্ব কমে না। কারণ তাঁর সঙ্গে আলােচনা চলছে উচ্চতম পর্যায়ে। বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়া যদি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বুঝে থাকে তবে তা অবশ্যই ভালাে কথা। তবে শ্রীমতি গন্ধীর এই কূটনৈতিক অভিযানের উদ্দেশ্য যদি হয় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা তবে বেলজিয়াম বা অস্ট্রিয়ার বক্তব্যের গুরুত্ব অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। নিরপেক্ষ অস্ট্রিয়ার তাে বটেই, ইসলামাবাদের ওপর বেলজিয়ামের প্রভারও পরিসীম, একথা কেউই বলবেন না।
বাকি থাকে বৃটেন। সেখানে শ্রীমতী গান্ধীর সফরের প্রাক্কালে কয়েকটি দায়িত্বশীল সংবাদপত্রে তার তথা ভারতের প্রশস্তি উচ্চারিত হয়েছে। নিদারুণ শরনার্থী সমস্যার বােঝা ঘাড়ে নিয়েও ভারত যে সংযমের পরিচয় দিয়েছে তারই পুরস্কার এই প্রশস্তি। কয়েক দিন আগে অবশ্য শীমতী গান্ধীই পরিহাস করে বলেছিলেনম আমরা সংযম দেখাচ্ছি না (অর্থাৎ পাকিস্তান) তারা প্রশস্তির সঙ্গে ফাউ হিসেবে পাচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র। সুতরাং এই প্রশস্তিতে বিশেষ চি’ড়ে ভিজবে না। এমতী গান্ধীর সফরের সংবাদ বৃটেনের জনপ্রিয় কাগজগুলােতে নাকি প্রায় স্থানেই পায় নি। এ থেকে এ কথা কখনােই মনে করা চলে না যে, বৃটিশ সরকার তার সঙ্গে আলােচনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন নি। প্রধানমন্ত্রী হিথ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিউমের সঙ্গে আলােচনার সময় শ্ৰমতী গান্ধী অবশ্যই কোনাে ঢাক-ঢাক গুড়-গুড়ের আশ্রয় নেন নি। নেওয়ার কোনাে উপায়ও নেই। কিন্তু তাতে বৃটেনের এই সব রক্ষণশীল রাজনীতিকের হৃদয় কতােখানি গলেছে? ভারত-পাক উপমহাদেশের এই সঙ্কটের জন্যে ভারত ও পাকিস্তানকে একই পংক্তিতে বসানাের নীতি কি বৃটিশ সরকার অতঃপর ত্যাগ করবেন বলে আমরা আশা করতে পারি? এই অদ্ভুদ সমদর্শিতার নীতির ফলেই ভারত-পাক সীমান্তের দুই পাশেই রাষ্টসঙ্রে পর্যবেক্ষক বসাবার আব্দার উঠেছে পশ্চিমী দুনিয়ায়। লন্ডনে থাকর সময়ই শ্ৰীমতী গান্ধীকে একাধিকবার এই ন্যক্কারজনক প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে হয়েছে। সে সতর্কবাণী ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে কিনা তা বিচারের সময় অবশ্য এখনও আসেনি।
বৃটিশ পার্লামেন্টের বৈঠকের উদ্বোধন করার সময় রাণী এলিজাবেথ জানিয়েছেন, পূর্ববঙ্গের সমস্যা সমাধানের জন্যে বৃটেন চেষ্টা চালিয়ে যাবে। সেই সমাধানের সম্ভাব্য চেহারাটা কী রকম, তা শ্রীমতী গান্ধীর কাছে এখন পরিষ্কার হয়ে ওঠার কথা। কিছুদিন আগে এক ফরাসী পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আক্ষেপ করেছিলেন যে, বর্তমান সঙ্কটে বৃটেনই তার প্রধান বিরােধীর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই প্রধান বিরােধীও জেনারেল ইয়াহিয়ার সাবেক পাকিস্তানকে দু’টুকরাে করে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়বার মতলব অটিছে, এমন অপবাদ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও নিতে পারছেন না। হিথ সাহেবের দৌড় বড় জোর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার একটা শিথিল কনফেডারেশন পর্যন্ত। পূর্ব বাংলায় পাক ফৌজের পৈশচিক তান্ডব, কয়েক লাখ নরনারী শিশুর প্রাণবলি এবং কোটি লােকের দেশত্যাগের পর এই ধরনের সমাধান সম্ভব কিনা, সে বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে সঙ্গতভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। আসলে, ভারতের সন্দেহেও তেমন কিছু আসে যায় না। এই প্রশ্নের শেষ মীমাংসা যে করবেন গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী পূর্ব বাংলার জনপ্রতিনিধিরা এ কথা শ্ৰীমতী গান্ধীই মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের অধিস—দিত নেতা শেখ মুজিব যতদিন ইয়াহিয়ার কারাগারে পচবেন,ততদিন পর্যন্ত এই ধরনের যেকোন আলােচনাই নিরর্থক। মুজিবের মুক্তি এবং ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনার জন্যেও হিউম সাহেব নাকি চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেই আলােচনায় যােগ দেওয়ার আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেক দিক ভেবে দেখতে হবে। শ্ৰীমতী গান্ধী এ কথা জানাতে ভােলেন নি, জোড়াতালি সমাধানে সমস্যা জটিলতর হয়ে দাঁড়াতে পারে। বৃটেন এসব কথা ভেবে দেখবে কিনা বলা মুস্কিল, কারণ ইতিমধ্যেই সে গাইতে শুরু করেছে যে, ইসলামাবাদে নাকি তার তেমন প্রভাব নেই। কথাটা আংশিক সত্য মাত্র। উপমহাদেশের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে বৃটেনের বক্তব্যের এখনও বেশ কিছু গুরুত্ব আছে। সুতরাং পশ্চিমী দুনিয়ার ঔদাসীন্যের ফলে উপমহাদেশের সঙ্কট যদি আরাে গুরুতর হয়ে দাঁড়ায় তবে বৃটেন তার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। শ্রীমতী গান্ধীর সফরের ফলে হিথ সাহেব যদি শুধু এইটুকুই হৃদয়ঙ্গম করে থাকেন, তবে সেটাও কম লাভ নয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ নভেম্বর ১৯৭১