নয়াদিল্লীর পাক কসাইখানা
আটচল্লিশ ঘণ্টার চরমপত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে। বাইরের কেউ জানে না হুসেন আলী জীবিত না মৃত। আট এবং চার বছরের দুটি নাবালক ছেলে ঝর্ণা দিয়ে ধসেছিল পাক হাইকমিশন ভবনের সামনে। ওরা জানাচ্ছিল সবার মুক্তির দাবী। কপালে জুটেছে উচ্চপদস্থ পাক অফিসারের গালাগালি। রাগে ফেটে পড়ছেন বাংলাদেশ মিশনের কর্মীরা। জেনিভা কনভেনশনের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছেন এই কূটনৈতিক দস্যুরা। আন্ত র্জাতিক নিয়মের বর্মা ওদের যদি ঢেকে না রাখত তবে পরিণাম কি হত, নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। পাক হাইকমিশনে যে বীভৎস নাটকের বাস্তব অভিনয় হয়ে গেছে তা নজিরহীন। দশজন বাঙালী কূটনৈতিক কর্মী এবং তাদের পরিবারবর্গ ছেড়ে এসেছেন নয়াদিল্লীর পাক কসাইখানা। পারেন নি শুধু হুসেন আলী এবং তার স্ত্রী কণ্যারা। দুটি নাবালক ছেলে অন্যদের সঙ্গে কোন মতে পালাতে পেরেছিল। এই শিশু দুটি জানে না বাবার সংবাদ। বাংলাদেশ হাইকমিশন ছেড়ে আসার সময় তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেভাবে প্রহার করা
হয়েছে তাতে তার জীবিত থাকার কথা নয়। হুসেন আলীর স্ত্রীও পাকমিশনে বন্দিনী। তার চোখের সামনে পনের বছরের মেয়েকে চুলের মুঠি ধরে নির্যাতন করেছে ইয়াহিয়ার কসাইয়ের দল। অপরাধ প্রহার জর্জরিত বাবার আর্ত চীৎকার সহ্য করতে পারে নি হতভাগিনী কণ্যা। গােটা বাংলাদেশে যে নারকীয় তান্ডব চালিয়েছেন ইসলামাবাদ তারই ছােট একটি নমুনা পাওয়া গেছে নয়াদিল্লীর পাক হাইকমিশনে। হুসেনন আলী ছিলেন পাক গােয়েন্দা দপ্তরের একজন বিশিষ্ট অফিসার। অনেক গােপন সংবাদ জানা আছে তার। বাইরে এলে ভারতে পাক গােয়েন্দা চক্রের হাড়ির খবর হয়ত ফাঁস হয়ে পড়ত। এই আশঙ্কাই হয়ত করেছিলেন পাক হাইকমিশন কর্তৃপক্ষ। ওদের বুদ্ধিভ্রম ঘটেছে। ক্ষ্যাপা কুকুরের মত যেখানে সেখানে কামড় বসাচ্ছে। হুসেন আলীকে একেবারে খতম করা এদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। আর যদি তিনি জীবিত থাকেন তবে তার মুক্তি সহজে পাওয়া যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকার কিছুটা দিশাহারা। পাক হাইকমিশনের ভিতবে ঘটেছে এই ঘটনা। ওখানে ভারতীয় পুলিশের প্রবেশ আন্তর্জাতিক রীতিবিরুদ্ধ। নরকের কটিগুলাে তাদের নাগালের বাইরে। আইনের কোন প্যাচে ওদের ফেলা যায় তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। বাইরে জনসাধারণ উত্তাল। পশ্চিম বাংলার ঘরে ঘরে বইছে উত্তেজনা। বাংলাদেশের জনগণের মতই তাঁরা চান প্রতিশােধ। কিন্তু এই প্রতিশােধের উপায় অজানা টগবগ করে ফুটছে ধমনীর রক্ত। ভিতরের জ্বলতে আগুন খুঁজে পাচ্ছে না বেরুবার পথ। লক্ষ কণ্ঠে আকাশে উঠছে শুধু অভিশাপ। এই অগ্নিগর্ভ মুহূর্তে নয়াদিল্লীর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব চৌধুরী দিয়েছেন চরম পত্র। আট চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হুসেন আলীর মুক্তি না এলে নির্মম প্রতিশােধ নেবে বাংলাদেশ। মুক্তিবাহিনীর হাতে আছে হাজার হাজার পাকিস্তানি বন্দী। হুসেন আলীর উপর নির্যাতনের বদলা পড়বে তাদের উপর। ইসলামাবাদ এবং বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধরত। দাঁতের বদলে দাঁত এবং চোখের বদলে চোখ নেওয়া এসব ক্ষেত্রে মােটেই অস্বাভাবিক নয়। যুদ্ধের সময় প্রতিশােধ গ্রহণের নজির ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। হুসেন আলীর সংবাদের জন্য নয়াদিল্লী পীড়াপীড়ি করলে তাতে হয়ত কান দেবে না পাকিস্তান। রেডক্রশের মাধ্যমে শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে। তাতে যদি সাড়া না দেন পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী তবে প্রায়শ্চিত্তের জন্য তৈরী থাকুন তারা। এই নরপিশাচদের পাপের শাস্তি পাবে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাক বন্দীরা। একমাত্র হুসেন আলীর মুক্তিই ঠেকাতে পারে আসন্ন বিপর্যয়। আর তিনি যদি নিহত হয়ে থাকেন তবে রক্তের বণ্যা বইবে বাংলাদেশ সরকারের বন্দী শিবিরে। জল্লাদদের কান্নায় কেপে উঠবে স্বৈরাচারীরর সিংহাসন। ভারতীয় জনতা আজ নিরুপায় দর্শক। তাদের মাটিতে চলছে পাক বর্বরদের নির্মম অত্যাচার। কূটনৈতিক দুর্গের ভিতর বসে বীরত্ব দেখাচ্ছে কাপুরুষের দল। ইয়াহিয়া বলছেন যুদ্ধ আসন্ন। যদি সত্যিই এই যুদ্ধবাজ ডিকটেটর লড়াই চাপান ভারতের উপর তবে অবশ্যই ত হুসেন আলীর লাঞ্ছনার বদলে নেবার সুবর্ণ সুযােগ। রণক্ষেত্রে তিনি পাবেন মানবদ্রোহিতার চরম শাস্তি। আজ নিস্ফল আস্ফালনের দিন নয়, বিবেকী মানুষের সংগ্রামী দাবী জানাবার দিন। হুসেন আলী জীবিত, না মৃত—এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে পাকিস্তানকে। তার মাথার উপর ঝুলছে জনাব চৌধুরীর চরমপত্রের শানিত খাড়া। এ খাড়ার প্রয়ােগ হবে কি হবে না তা নির্ভর করছে পাক হাইকমিশনের উত্তরের উপর। চরমপত্রের মেয়াদ অতিক্রান্ত। শেষরক্ষা পাকিস্তানের হাতে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৫ নভেম্বর ১৯৭১