পিকিং হতে ভুট্টোর বিদায়
বড় আশা নিয়ে পিকিং সফরে গিয়েছিলেন ভুট্টো। তাঁর গলায় ছিল ১৯৬৫ সালের চীনা ফুলের মালা। মনে করেছিলেন, এবার যদি পাক-ভারত লড়াই বাধে তবে চীন দাঁড়াবে পাকিস্তানের পাশে। সঙ্কটকালে ১৯৬৫ সালের মতই ভারত আক্রমণের হুমকী দেবে সে। পিকিং এ পৌছিয়েই তিনি দেখলেন, ছ’বছরের আগের মালার ফুলগুলাে শুকিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইএর ললাটে পাক দোস্তীর উজ্জ্বল শিখা স্তিমিত হয়ে এসেছে। অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্ভাব্য পদটিও হাতছাড়া হয়ে যেত। এই ধরনের একটা গােপন প্রতিশ্রুতি দিয়েই ইয়াহিয়া খান তাকে পাঠিয়েছিলেন চীনে। পিকিং নেতাদের সঙ্গে ভুট্টোর পুরাণ ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগানই ছিল ইসলামাবাদের উদ্দেশ্য। তার জন্যই এই সিন্ধি নেতা পেয়েছিলেন পাক-প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বের গৌরব। বাংলাদেশে প্রচণ্ড রাজনৈতিক ঝড়ের মুখে সােভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করেছে ভারত। তাতে ভেঙ্গে পরেছে জঙ্গীশাহীর মনােবল। জনসাধারণও দিশাহারা। তার বুঝতে পারছে না, যুদ্ধ বাধলে পাকবাহিনীর দিল্লী পৌছানাের আগে ভারতীয় জওয়ানরাই হাজির হবে কিনা লাহােরে। পাকিস্তানের প্রয়ােজন, একটি বড় সামরিক শক্তির সক্রিয় সমর্থন। তাহলেই ভয় পাবে ভারত এবং ঝড়বে পাকিস্তানি মনােবল। অস্থায়ী চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফেই যা বলেছেন তাতে একটা কথা পরিষ্কার— চীনও চায়, বাংলাদেশ সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধান। পাক-রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যেই তার চেষ্টার জন্য ইসলামাবাদকে উপদেশ দিয়েছেন তিনি। এদিক থেকে মার্কিন মতামতের সঙ্গে চীনা মতামতের কোন তফাৎ নেই। আমেরিকাও চায়, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। ডা: মালিকের তাবেদার সরকার এবং উপনির্বাচনের প্রহসন এই সমাধানের সন্তোষজনক অঙ্গ কিনা তা বলেন নি প্রেসিডেন্ট নিকসন এবং অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফেই। উভয়েই এড়িয়ে গেছেন ভারতে আগত প্রায় এক কোটি শরণার্থীর কথা। ওরা কেন এলেন এবং কি করে ফিরে যাবেন—এসব প্রশ্নের সাফ জবাব মেলে নি মার্কিন কিম্বা চীনা নেতাদের মুখ থেকে। অস্থায়ী চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তৃতার বয়ানে প্রকাশ, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় ভারতের হস্তক্ষেপ নাকি সহ্য করবে না চীন। নয়াদিল্লী কখনই বাংলদেশ সমস্যায় নাক গলাতে চান নি। তারা বারবার বলছেন—এ সমস্যার সমাধান করবেন, বাংলাদেশের সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিরা এবং ইসলামাবাদ। কেন্দ্রীয় সরকার শুধুমাত্র শরণার্থীদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে এবং স্বাধীকার নিজেদের বাড়ীঘরে বসবাসের সুযােগ-সুবিধায় বিশ্বাসী। তাদের ধারণা—জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা না এলে এবং বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্য অপসারিত না হলে তা সম্ভব নয়। যদি অন্য কোন পথের কথা চীনা কিম্বা মার্কিন কর্তাদের মনে থেকে থাকে তবে সেই গােপন কথাটি তারা স্পষ্টাস্পষ্টি বলছেন না কেন? আর সীমান্তের সামরিক উত্তেজনা? ওটা পাকিস্তানের তৈরী, ভারতের নয়। ইয়াহিয়া খানই প্রথম সৈন্য সাজিয়েছেন সীমান্ত এলাকায়। ভারত নিয়েছে শুধু পাল্টা ব্যবস্থা। যুদ্ধাতঙ্কে চীন যদি এতই বিচলিত হয়ে থাকে তবে সীমান্তে সৈন্য সাজাতে কেন সে বারণ করল না পাকিস্তানকে? এখন সীমান্ত থেকে ভারত এবং পাকিস্তানকে একসঙ্গে সৈন্য সরাতে বলা অর্থহীন। এটা নিরপেক্ষ বিচারের ন্যায় নীতি নয়, রাজনৈতিক ভন্ডামী। মানুষখেদা ইসলামাবাদ এবং আর্তসেবক নয়াদিল্লী একই পর্যায়ে পড়েন না। শরণার্থীদের আশ্রয় না দিয়ে ভারতের প্রবেশমুখে ওদের গুলী করে মারলে খুশী হতেন চীনের জনসাধারণ? নিশ্চয়ই নয়। নেতারা যাই বলুন, দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ হারায় নি মাতবতার মূল্যবােধ। বাংলাদেশে যা ঘটেছে তার সঠিক বিবরণ জানতে দিন চীনের সত্তর কোটি মানুষকে। দিন তার মনােভাব প্রকাশের স্বাধীনতা। তারপর নেতারা বলুন—তাদের দেশবাসীরা কি চান?
চীনা নেতাদের কথায় এবং কাজে থাকে অসমান জমিন ফারাক। তারা সােভিয়েট রাশিয়াকে গালাগালি করেন, আবার সঙ্গে সঙ্গে শান্তি আলােচনাও বসেন। বিপ্লবের চোটে ভিয়েতনামে যুদ্ধরত মার্কিন বাহিনীকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেবার সঙ্কল্প জানান। মার্কিন আক্রমণ জোরদার হলে একটি সৈন্যও তারা পাঠান না যুদ্ধক্ষেত্রে। দুর থেকে হুমকী দেওয়া তাদের অভ্যাস। শুধুমাত্র কোরিয়ায় ঘটেছিল ব্যতিক্রম। পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব এবং ইসলামাবাদের স্বৈরাচারীদের কায়েমী স্বার্থরক্ষায় চীন ও আমেরিকা সমভাবেই উৎসুক। দোষ ভারতের। শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মহাবেকুব সেজেছে সে। এই অসহায় এবং উৎপীড়িত মানুষগুলােকে ভাগাভাগি করে নিতে পারে মানবদরদী চীন এবং আমেরিকা। তাহলেই ভারতের থাকবে না কোন মাথাব্যথা। প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী গান্ধীও ছুটে বেড়াবেন না দেশ-দেশান্তরে। তারপর পিকিং এবং ওয়াশিংটন পরখ করুন-মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড মারে অখণ্ড খাকে কিনা পাকিস্তান। যেসব দাবী জানিয়েছেন চি পেং ফেই তা আগেই জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। শ্রীমতী গান্ধীর কাছ থেকে যে জবাব পেয়েছে আমেরিকা সেই জবাবই পাবে চীন। তবে একথা নিশ্চিত ভারতের উপর যুদ্ধ চাপালে প্রত্যাঘান অনিবার্য। ইয়াহিয়ার সাহায্যে রণহুঙ্কর দিয়ে এগিয়ে আসবেন না পিকিং। তারা জানেন, নয়াদিল্লীর পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন মস্কো। হয়ত চীনা-মার্কিন অস্ত্র সাহায্য যাবে পাকিস্তানে। তা আগেও গেছে, এখনও যাচ্ছে এবং যুদ্ধের সময়ও হয়ত যাবে। এতে ফিরবে না ইয়াহিয়ার ভাগ্য। ভুট্টোর অভ্যর্থনায় চীনের হয়ে কথা বলছেন অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী এবং স্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুখ খুলেন নি। তারা কথা বললেই স্পষ্ট হবে চীনা মতিগতি। অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অস্থায়ী আশ্বাস নিয়েই ফিরে এসেছেন ভুট্টো। স্থায়ী মন্ত্রীদের আশ্বাস জুটেনি তার ভাগ্যে। গত ছ’বছরে দুনিয়ার হাল পাল্টিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে চীনা পররাষ্ট্রনীতি। অস্ফালন করুন ভুট্টো। মান বাচাবার জন্য ওটা দরকার। নইলে বেরিয়ে পড়বে ভিতরের কান্না। শুনলে লােকে হাসবে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ নভেম্বর ১৯৭১