ভারত মহাসাগর কি শান্তির সাগর হবে?
এটা একটা বিরাট পরিহাস যে, ভারত মহাসাগরকে ‘শান্তির এলাকা’ বলে চিহ্নিত করার জন্যে সিংহল সরকার যে মুহূর্তে রাষ্ট্রসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, সেই মুহূর্তে তারা নিজেরাই সেখানে অশান্তির ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছিলেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সিংহল যদি পাকিস্তানের জঙ্গী বিমানগুলিকে অবতরণ আর তেল সংগ্রহের সুযােগ না দিত, তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতাে না। কোনাে পাকিস্তানি সৈন্যবাহী বিমানকে নামতে দেওয়া হচ্ছে না বলে কলম্বাে যা বলছে তার কোনাে মূল্য নেই। পাকিস্তানি বিমান করাচী থেকে সরাসরি ঢাকায় যেতে পারে বটে, কিন্তু মাঝপথে তেল না নিয়ে সরাসরি ফেরার ক্ষমতা তাদের নেই। ফিরতি পথে সিংহল থেকে তেল নেবার সুযােগ না থাকলে নতুন সৈন্য পাঠানাে তার পক্ষে মুস্কিল হয়ে পড়ত। সিংহলের পক্ষে এটা শুধু মানবতা বিরােধী কাজ নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতার প্রতি প্রত্যক্ষ আহ্বানও বটে; কেন না এই ব্যাপার চলতে থাকলে এর প্রতিকারের জন্যে অন্যান্য মহল থেকে তৎপরতা দেখা দিতে বাধ্য।
কথার আর কাজে এই ধরণের ফারাক আছে বলেই আমরা মনে করি না সিংহলের আবেদনের কোনাে মূল্য আছে। ঠাণ্ডা লড়াই যাতে ভারত মহাসাগরে সম্প্রসারিত না হয় তার জন্যে এই মহাসাগরের প্রান্তবর্তী দেশগুলির উদ্বেগ স্বাভাবিক। কেননা নিজেদের বৈষয়িক উন্নতির জন্যে অবিচ্ছিন্ন শান্তি তাদের প্রয়ােজন। কিন্তু শুধু কি ইচ্ছে করলেই আমরা বৃহৎ শক্তিবর্গকে এই এলাকা থেকে বাইরে রাখতে পারবাে? তার জন্যে কি নিজেদের মধ্যে প্রস্তুতির কোনাে প্রয়ােজন নেই? নিজেদের মধ্যে একটা সাধারণ, ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত ও কর্মপন্থা ঠিক করে রাখার আবশ্যকতা নেই যে কর্মপন্থা ও সিদ্ধান্তকে বৃহৎ শক্তিগুলির সামনে একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে পেশ করা চলে? এখন পর্যন্ত সেরকম কোনাে প্রয়াস দেখা যায় নি। একটি সাধারণ বক্তব্যের প্ল্যাটফর্মের ওপর এই এলাকার দেশগুলিকে একত্রে দাঁড় করাবার জন্যে কোনাে উদ্যোগই পরিলক্ষিত হয় নি। বৃহৎ শক্তিগুলি এই অবস্থার সুযােগ গ্রহণ করবার জন্যে অতিমাত্রায় উদগ্রীব। এবং সেটাই কি স্বাভাবিক নয় যখন এই এলাকার এক একটি দেশ নিজেদের প্রতিরক্ষার স্বার্থে এক একটি বৃহৎ শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে বাধ্য?
হয়ত চূড়ান্ত বিচারে এই অবস্থার পুরােপুরি প্রতিকার সম্ভব নয়। কেননা ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা যেরকম, সামরিক অবস্থা সেই রকম কিংবা তার চেয়েও বেশি দরিদ্র। সুতরাং ভারত মহাসাগরের সতীত্ব নিজেদের জোরে রক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া এই দেশগুলির মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শেরও কোনাে সমতা নেই। কাজেই সমস্ত বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে একটা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ সৃষ্টি করাও সহজসাধ্য হবে না। ঠাণ্ডা লড়াই ইতিমধ্যেই যথেষ্ট পরিমাণে ভারত মহাসাগর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা চাই বা না চাই এবং পুঁথিগতভাবে সােভিয়েট ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গী যা-ই হােক, গত দুতিন বছরে এই এলাকায় রুশ নৌ-বহরের কার্যকলাপ অন্তত দ্বিগুণ বেড়েছে। গান ও সেচেলস দ্বীপে বৃটিশ ঘাটি তাে উত্তেজনার একটি স্থায়ী উৎস। এবং এখন মার্কিন নৌ-দপ্তরের একজন অফিসার, ভাইসঅ্যাডমিরাল মারস ওয়াইজনার জানিয়েছেন যে, রুশ উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকাকে বাধ্য হয়েই ভারত মহাসাগরে তার কার্যকলাপ বাড়াতে হবে। এই যেখানে মনােভাব, সেখানে ভারত মহাসাগরে ঠাণ্ডা লড়াই পরিহারের জন্যে বৃটেনের লেবার পার্টির আবেদন অরণ্যে রােদনেরই সামিল। এরপর এখন চীন। একটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক শক্তিরূপে নিজেকে জাহির করতে সুরু করবে তখন পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠতে বাধ্য।
তবু আমরা বলব, এই এলাকার দেশগুলি যদি একটা ঐক্যবদ্ধ ঘােষণা ও স্ট্র্যাটেজির ওপর দাড়ি সুরে কথা বলতে পারত, তাহলে বৃহৎ শক্তিবর্গ একেবারে প্রতিহত না হােক বৃহৎভাবে সংহত হতে পারত। তার সুযােগ ও প্রয়ােজনীয়তা দুটোই আছে। তবে তার জন্যে দরকার প্রচলিত রাজনীতির আদর্শকে সরিয়ে রেখে একটি আফ্রোশীয় রাজনীতিকে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু সে রকম আফ্রোশীয় নেতা কই যিনি এই পরিণতিকে সম্ভব করতে পারেন?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ অক্টোবর ১৯৭১