স্বরণ সিং-এর বিকল্প প্রস্তাব
বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবীর কথা শােনা গেছে বহুবার। প্রধানমন্ত্রী বলতেন, রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ—মুজিবুর রহমান এবং তার দলের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। প্রধানমন্ত্রীর মতামত ১৯৭০ সালের নির্বাচনভিত্তিক। তাতে পাকিস্তানি জাতীয় পরিষদে এবং পূর্ববাংলার আইনসভায় আওয়ামী লীগ পেয়েছিলেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য। এই ভিত্তি মেনে নিলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বলতে বােঝায় মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দলকে। আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম। মাত্র কদিন আগেও তিনি ঘােষণা করেছেন-বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন সমাধান অবাস্তব। স্বাধীন। বাংলাদেশ সরকার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য চালাচ্ছেন জীবনমরণ সংগ্রাম। বাংলাদেশ থেকে ইসলামাবাদের শাসনের উচ্ছেদ তাদের চরম লক্ষ্য। এ থেকে সাধারণ মানুষের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল যে, অখণ্ড পাকিস্তানের ঘটেছে অপমৃত্যু। তার কবর থেকে জন্ম নিচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং জানিয়েছেন নুতন কথা। তাঁর মতে, তিনটি উপায়ে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব-পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে একটি আপােস কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ অথবা অধিকতর আঞ্চলিক স্বয়ংশাসন। এতদিন ধরে নয়াদিল্লী এবং বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী যে তালে সুর বেঁধেছিলেন তাতে স্বাধীন বাংলাদেশের কথাটাই প্রাধান্য পেয়েছিল। মনে হয়, স্বরণ সিং-এর বক্তৃতায় তাতে ছন্দপতন ঘটেছে। অবশ্য তার প্রস্তাবগুলাে শর্তাধীন। সম্ভাব্য ফয়সালার যে সুত্রই উদ্ভাবিত হােক না কেন তা হতে হবে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রহণযােগ্য।
পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তৃতায় নুতনত্ব এই যে, পাকরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের সম্ভাব্যতা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। অথচ এ ধরনের আপােসের কোন সম্ভাবনা আছে বলে স্বীকার করছেন না স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। তারা চালাচ্ছেন মুক্তিসংগ্রাম। নাজেহাল করে তুলছেন পাক-বাহিনীকে। এরাই আবার ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক দলের প্রতিনিধি। ওঁদের অভিমত যদি শেষ কথা হয় তবে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প সমাধানের প্রশ্ন ওঠে না। একথা ভালভাবেই জানেন স্বরণ সিং। তা জানা সত্ত্বেও বিকল্প প্রস্তাব কেন দিলেন তিনি? স্বস্তি পরিষদের বৃহৎ শক্তিগুলাের মতামতের উপর নজর রেখেই হয়ত কিছুটা পিছু হটেছেন স্বরণ সিং। বাংলাদেশের সংগ্রামে ভারতের নৈতিক সমর্থন মুক্তিযােদ্ধাদের অপরিহার্য পাথেয়। জনসাধারণ অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিকামীদের ঐতিহাসিক লড়াই। দুর্গত মানুষের দুঃখে তাদের স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ত্যাগ স্বীকার অনন্যসাধারণ ঘটনা। গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং ব্যাপক নারী ধর্ষণের পর অত্যাচারিত বাংলাদেশের জনগণ কখনই মেনে নিতে পারেন না পাক-দস্যুদের বন্ধুত্বের আশ্বাস। এ ধরনের মনােভাব অতি বাস্তব। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ঘটে গেছে প্রায় তিন দশক আগে। যুদ্ধবন্দীদের উপর তখন নাকি অমানুষিক ব্যবহার করেছিল, জাপানীরা। আজ সৌহার্দের যুগেওড় পুরানাে তিক্ত স্মৃতি ভুলতে পারেন নি বৃটিশ জনসাধারণ। ওঁরা কিছুতেই সহজভাবে নিতে পারছেন না রাষ্ট্রীয় অতিথি জাপসম্রাট হিরােহিতােকে। আর রক্তে ভেজা বাংলাদেশ কি করে থাকবে অখণ্ড পাকিস্তানের মধ্যে? সম্পর্ক যত শিথিলই হােক না কেন, তাতে দূর হবে না নরঘাতকদের কলঙ্কিত স্পর্শ। বাংলাদেশের চুড়ান্ত ফয়সালা নির্ভর করছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিফৌজের উপর। ওতে অবশ্যই মাথা গলাবেন না নয়াদিল্লী। তাদের মৌল সমস্যা, শরণার্থী এবং তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানের সঙ্গে এ প্রশ্ন জড়িত। এখানেই কেন্দ্রীয় সরকারের মাথাব্যথা। এক্ষেত্রে স্বরণ সিং-এর বিকল্প প্রস্তাবগুলাে হয়ত বাংলাদেশ সরকারের উপর করবে পরােক্ষ চাপ সৃষ্টি। হয়ত ভুল বােঝাবুঝির ক্ষেত্র হবে প্রসারিত। তার সুযােগ নেবেন ইয়াহিয়া খান।
আজ প্রায় ছ’মাস ধরে চলছে বাংলাদেশের সংগ্রাম। নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। তাদের সংখ্যা কোটির ঘরে পৌঁছতে দেরী নেই। এতদিন কর্তৃপক্ষ করেছেন শুধু ধানাই-পানাই। কোন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি তারা। বেশ কিছুদিন পর নেতারা শুনালেন রাজনৈতিক সমাধানের বাণী। আরও পরে ব্যাখ্যা এল, রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের মতে, এই ক্ষমতা অর্পণের অর্থ স্বাধীন বাংলাদেশ। সবাই বুঝলেন মুক্তিবাহিনী আনবেন এই স্বাধীনতা। অনেক আগেই দানা বেঁধে উঠেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের দাবী। নয়াদিল্লী সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের দাবী। নয়াদিল্লী বললেন—অবিরাম চলছে বাংলাদেশের ঘটনাবলীর পর্যালােচনা। যথাসময়ে বিবেচিত হবে স্বীকৃতিদানের | প্রশ্ন। সবাই ভাবলেন-চীনা জুজুর ভয়ে এবং মার্কিন বিরূপতায় ইতস্তত করছেন কেন্দ্রীয় সরকার। সােভিয়েট রাশিয়াকে সঙ্গে পেলেই সুনির্দিষ্ট পথ নিতে কোন বাধা থাকবে না নয়াদিল্লীর। হয়ে গেল ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী-চুক্তি। আনন্দে উচ্ছল হলেন জনতা। তারা ভাবলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য আর ঝুলান থাকবে না বাংলাদেশ সমস্যা। তার স্বাধীনতা এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আসন্ন। কারণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন নয়াদিল্লীই। এখন স্বরণ সিং দিচ্ছেন পরপর তিনটি বিকল্প প্রস্তাব। তার দুটিতেই রয়েছে কম-বেশী অখণ্ড পাকিস্তানের সম্ভাবনার ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিত যতদিন অপসৃত না হচ্ছে ততদিন আসবে না স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের চূড়ান্ত পর্যায়। বৃহৎ শক্তিগুলাের চাপে কি পিছু হটছেন। নয়াদিল্লী? মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া ইসলামাবাদের সঙ্গে কোন আপােসে যদি রাজী না হন তবে কি করবেন কেন্দ্রীয় সরকার? শরণার্থীদের সম্পর্কেই বা কি ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা? এই প্রশ্নটা পূর্বাহেই তাঁদের ভেবে রাখা দরকার।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ অক্টোবর ১৯৭১