You dont have javascript enabled! Please enable it!

শান্তির পথ মুছে ফেলেছেন ইয়াহিয়া খান

বেতার ভাষণ দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। কোন নুতন কথা শােনা যায় নি তার মুখে। বাংলাদেশ সমস্যার পাক-মার্কা রাজনৈতিক সমাধানের স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন তিনি মার্শাল ল চালু থাকবে। প্রত্যাহত হবে না। আওয়ামী লীগের উপর নিষেধাজ্ঞা। জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক আইনসভা থেকে যাদের আসন খারিজ হয়ে গেছে তাদের শূন্যস্থান পূরণের জন্য উপনির্বাচন যথারীতি চলবে। আগামী বিশে ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান। প্রকাশ করবেন খসড়া সংবিধান। সাতাশে ডিসেম্বর বসবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। খসড়া সংবিধানের সংশােধন করতে পারবে জাতীয় পরিষদ। তা গ্রহণ এবং প্রত্যাখ্যানের পুরা ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের। সরল ভাষায় জাতীয় পরিষদ হবে ইয়াহিয়া খানের হাতের পুতুল। তার গােলামদের দ্বারা ভর্তি থাকবে ওটা। প্রেসিডেন্ট যখন বুঝবেন, তার পুতুলখেলা সার্থক তখন তিনি বানাবেন অসামরিক এরকার। এই প্রক্রিয়ার সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই পাক-দোস্তরা বগল বাজাবেন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্পূর্ণ। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। ভারতে আগত শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আর নেই কোন বাধা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং তখন শুধু একটি কথাই বলতে পারবেন—এই জনপ্রতিনিধিরা আসল জনপ্রতিনিধি নন। ওরা নকল। আসল জনপ্রতিনিধি মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক সমাধান তাঁদের গ্রহণযােগ্য হওয়া দরকার। এ যুক্তি বাস্তবমুখী হলেও তাতে থাকবে না ধার। সিমলার কংগ্রেস অধিবেশনের বক্তৃতায় তিনি যে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন গােটা জাতি, তার পরিণাম বুঝবে হাড়ে হাড়ে।
কি করবেন এখন নয়াদিল্লী? স্বাধীন বাংলাদেশের দাবী তলিয়ে যাচ্ছে অতলে। পাক-মার্কা মেকী গণতন্ত্র নিয়ে লাফাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। যে অবস্থার সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন তিনি, তাতে অধিকাংশ শরণার্থীই ফিরবেন না স্বদেশে। শ্রীমতী গান্ধীর প্রতিশ্রুতি-ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন শরণার্থীকে জোর করে পাঠানাে হবে না। ইসলামাবাদের খপ্পরে। অথচ ইয়াহিয়ার খপ্পরে শিথিল হবার নেই কোন লক্ষণ। বাইরের চাপে ইসলামাবাদের মানসিক পরিবর্তন অসম্ভব। কিসের আশায় দিন গুণছেন নয়াদিল্লী? সােভিয়েট রাশিয়ার কাছে অনুরূপ প্রশ্ন করার সময় এসেছে। মস্কো নেতারাও চেয়েছিলেন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। যে সমাধান দিচ্ছেন ইয়াহিয়া খান তারা কি তা মেনে নিতে রাজী? যদি রাজী না থাকেন তবে তা স্পষ্ট করে বলুন। পেশ করুন বিকল্প প্রস্তাব। শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন যে সমস্যার সঙ্গে জড়িত সে-সমস্যা কখনই হতে পারে না ইসলামাবাদের একান্ত ঘরােয়া। অবস্থা দেখে মনে হয়, নিজের পথে চলবেন ইয়াহিয়া খান। কেয়ার করবেন না বিশ্বজনমত। শরণার্থীরা ফিরে না গেলেও তার কিছু যায় আসে না। ভারতের ঘাড়ে শরণার্থী চাপিয়ে তিনি আরও নিশ্চিন্ত। বাংলাদেশে বাঙালীর সংখ্যা কমবে এবং তাদের স্থান পূরণ করবে পাকিস্তানের অবাঙালী চেলা-চামুণ্ডারা। মাঝখান থেকে আর্থিক ভারে নুইয়ে পড়বে ভারত। এই যদি হয় বাংলাদেশ সমস্যার শেষ পরিণতি তবে কি দরকার ছিল ভারত-সােভিয়েট মৈত্রীচুক্তির? কি প্রয়ােজন ছিল আক্রান্ত হলে একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসার প্রতিশ্রুতির?
গায়ে পড়ে কখনই পাকিস্তানকে আক্রমণ করবে না ভারত। আর স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি না দিলে কেনই বা ভারত আক্রমণের হঠকারিতা দেখাবে পাকিস্তান? তা সত্ত্বেও সীমান্তের ওপারে চলছে অস্বাভাবিক পাক-সামরিক তৎপরতা। ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র ভালভাবেই জানেন-বাংলাদেশ সমস্যার যে ধরনের রাজনৈতিক সমাধান চান নয়াদিল্লী তার কার্যকর রূপ কখনই দেবে না পাকিস্তান। স্বরণ সিং বর্ণিত পাক-রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে দুটি সমাধানের সম্ভাবনা মাঠে মারা গেলে বাকী থাকবে শুধু একটি-স্বাধীন বাংলাদেশ। এখানেই বড় ভয় ইসলামাবাদের। তাই তাঁরা উঠে পড়ে চালাচ্ছেন তাণ্ডব নর্তন। সীমান্ত বরাবর সমাবেশ ঘটছে পাক-বাহিনীরা। ভাবখানা এই-যে কোন সময় লেগে যেতে পারে সংঘর্ষ। ওঁরা প্রমাণ করতে চান—শরণার্থী সমস্যা আসলে পাক-ভারত বিরােধের ফল। কাশ্মীর এবং ফারাক্কা সমস্যার মতই ওটা পাকভারত আলােচনার বিষয়। আপােষে এগুলাের ফয়সালা না হলে বাধবে লড়াই। বেতার-ভাষণে ইয়াহিয়া দিয়েছেন এ ধরনের সম্ভাবনায় স্পষ্ট ইঙ্গিত। সােভিয়েট রাশিয়া-সহ বাইরের প্রায় সব রাষ্ট্রই আঁতকে উঠছে পাক রণ-হুঙ্কারের তীব্রতা দেখে। ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তির সামরিক ধারাটি চালু থাকা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান এত সাহস পান কোথা থেকে? তিনি হয়ত মনে করেছেন শরণার্থীদের নিয়ে ভারত গর্জাবে বিন্তু বর্ষাবে না। শ্যাম এবং কুল-দুই রাখবেন মস্কো। একমাত্র ঝামেলা—স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনী। ভারত এবং বহির্বিশ্ব থেকে ওদের বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই যাবে সব ল্যাঠা চুকে। তার জন্যই হয়ত চলছে ব্ল্যাকমেইল। এ অবস্থা মেনে নিতে পারেন না নয়াদিল্লী। শরণার্থীদের অবশ্যই পাঠাতে হবে স্বদেশে। পাকরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের সব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ করেছেন ইয়াহিয়া খান। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়া অপর কোন সমাধান অবাস্তব। যারা এখনও পূর্ব বাংলায় পড়ে আছেন তাঁদের এবং শরণার্থীদের একমাত্র ভরসা বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী। তাদের হাত জোরদার করুন নয়াদিল্লী। স্বমতে আনুন সােভিয়েট রাশিয়াকে। তাতে যদি যুদ্ধ বাধান ইয়াহিয়া খান তার মােকাবিলায় ভারত তৈরী। রণক্ষেত্রে যােগ্য উত্তর পাবে পাকিস্তান। শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন এবং ভারতের অর্থনৈতিক বনিয়াদ অক্ষুন্ন রাখার জন্যই প্রয়ােজন দৃঢ়সঙ্কল্পের। তার অভাব ঘটলে বিপর্যয় অনিবার্য। সাবধান নয়াদিল্লী।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৪ অক্টোবর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!