রেশন থেকে রেহাই নেই
খাদ্যশস্যের উৎপাদন এক লাফে ৮৩ লাখ টন বেড়ে গিয়ে দশ কোটি টনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় দিল্লীর কৃষিভবনের কর্তারা স্বভাবতঃই উল্লসিত। কিন্তু কৃষিপণ্য মূল্য নির্ধারণ কমিশনের সাম্প্রতিক রিপাের্টের মর্মার্থ হল, এতটা উল্লসিত হওয়ার সময় এখনও বােধ হয় আসে নি। যদিও সরকারের হাতে এখন প্রায় ৮০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত (৫৫ লাখ টন গম ও ২৫ লাখ টন চাল), বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির পরিমাণও কমছে, তবু সর্তকতার প্রয়ােজন আছে। কৃষি দপ্তর দাবি করছেন, উপর্যুপরি চার বছর খাদ্যশস্যের ফলন বৃদ্ধির মূলে রয়েছে তাদের নিরন্তর গবেষণা ও প্রয়াস, কিন্তু কৃষিপণ্য মূল্য নির্ধারণ কমিশনের মতে এই সাফল্যের কারণ প্রকৃতির করুণা। গত বছর মােট যে ৮৩ লাখ টন উৎপাদন বেড়েছে তার মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ টনই জুগিয়েছে রাজস্থান, তার কারণ আগের বছরের চেয়ে সেখানে বৃষ্টি হয়েছিল বেশি। কমিশনের মতে আগামী কয়েক বছরে গমের ফলন উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে উন্নত ধরনের বীজের ব্যবহারের ফলে ধানের ফলন কিছুটা বাড়াতে পারে। সতর্কতা হিসেবেই কমিশন গত বছরের তুলনায় এ-বছর দশ লাখ টন বেশি চাল সংগ্রহের জন্যেও সুপারিশ করেছিলেন।
আত্মতুষ্টি সম্পর্কে সতর্কবাণী উঃচ্চারণের সময় কমিশন নিশ্চয়ই বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের ত্রাণের সমস্যার কথাও মনে রেখেছেন। যদিও অনুমান করা হচ্ছে যে, সাত-আট লাখ টন খাদ্যশস্য (প্রধানত: চাল) হলেই তাদের প্রয়ােজনীয়তা মিটবে, তবে সেটা নেহাৎই অনুমান। কারণ শরণার্থীরা কবে স্বদেশে ফিরবেন অথবা সকলে আদৌ ফিরবেন কিনা সেটা কেউই জানেন না। এমনিতেই এখন দেশে চালের ঘাটতি রয়েছে অন্তত: তিন লাখ টনের মতাে। বাংলাদেশের শরণার্থীদের বাড়তি চাহিদা মেটাতে হলে সেই ঘাটতির পরিমাণ যেহেতু বাবে তাই খােলাবাজারে দাম চড়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা। এই জন্যেই কমিশন রেশনের দোকান ও ন্যায্যমূল্যের দোকানের ব্যবস্থাকে জোরদার করার সুপারিশ করেছেন। বুধবার দিল্লীতে মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে ঐ সুপারিশ মেনে নেওয়া হয়েছে।
ইদানিং খােলা বাজারে চাল-গম অপেক্ষাকৃত সহজে ও সুবিধে দরে পাওয়া যাচ্ছে বলে রেশনের ও ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে খাদ্যশস্য কেনাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। ১৯৬৯ সালে যেখানে এই সব দোকান মারফৎ ৯৫ লক্ষ টন খাদ্যশস্য দেওয়া হয়েছিল, ১৯৭০ সালে সেখানে ঐ পরিমাণ প্রায় ছ’লাখ টন কমে। যায়। রেশনের ও ন্যায্য মূল্যের দোকানের সংখ্যাও ঐ এক বছরে সতের হাজার কমে গিয়ে এক লাখ বাইশ হাজারে দাঁড়ায়। ১৯৬৫ সালে বিধিবদ্ধ রেশনিং চালু হওয়ার পর খাদ্যাবস্থার কিছু উন্নতি ঘটলে ১৯৬৮ সালে কয়েকটি এলাকায় এই ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তার মধ্যে শিলিগুড়ি অন্যতম। অন্ধ্র প্রদেশে ও মাদ্রাজেও বিধিবদ্ধ রেশনিং প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এখন আবার সতর্কতা হিসেবে রেশন ব্যবস্থা জোরদার করার প্রশ্ন উঠেছে। খােলা বাজার থেকে চাল-গম কেনার চেয়ে রেশনের দোকান থেকে কেনার মধ্যে অনেক ঝামেলা আছে। কিন্তু রেশনিং ব্যবস্থা বলবৎ রেখে যদি খাদ্যশস্যের মতাে অতিপ্রয়ােজনীয় জিনিসের দাম আয়ত্তে রাখা যায় তবে সাধারণ মানুষের তাতে আপত্তি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শুধু আরাে এলাকাকে রেশনিং ব্যবস্থার আওতায় এনে এবং রেশনের বা ন্যায্য মূল্যের দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেই রেশনিং ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের আস্থা বাড়বে, এমন আশা পােষণ করা ভুল। এখনই রেশনের চেয়ে ভােলা বাজারে চালের দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও লােকে যে অনেক সময় খােলা বাজার থেকেই চাল কিনছেন তার কারণ রেশনের দোকান থেকে অনেক সময়েই যে-চাল সরবরাহ করা হয়, তা মানুষের খাবার উপযুক্ত নয়। সরকারি গুদামের জন্যে চাল সংগ্রহের সময় তার মানের দিকে কোনাে রকম। নজর রাখা হয়, রেশনের চাল থেকে তা মনে করার উপায় নেই। আবার বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকায় যদিও অন্ততঃ নিয়মিত সরবরাহটুকু পাওয়া যায়, আংশিক রেশনিং এলাকায় সেই নিশ্চয়তাটুকুও নেই। সরকারের হাতে যদি যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুত থাকে তবে এই ধরনের কাণ্ড ঘটে কী করে?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৫ অক্টোবর ১৯৭১