কেন এই পাকিস্তানি রণসজ্জা?
ভারতের পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্ত যুদ্ধের উত্তেজনায় কাঁপছে। কাশ্মীর, রাজস্থান, পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরা সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ করছে পাকিস্তান। কাশ্মীরের অবস্থা উদ্বেগজনক। ১৯৬৫ সালের মত এবারাে ছাম্ব এলাকায় দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক পাক সামরিক তৎপরতা। এখান থেকেই সুরু হয়েছিল গত পাক-ভারত লড়াই। এ অঞ্চলে পাক বাহিনীর অভিযান সার্থক হলে কাশ্মীর রাজ্যটি অবশিষ্ট ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ছাম্ব থেকে উত্তরে চলে গেছে যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা। এই সীমারেখার সাত মাইলের মধ্যে ভারতীয় কিম্বা পাক বাহিনীর পাঁয়তারা নিষিদ্ধ। ওখানে রয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল। তাদের জ্ঞাতসারেই পাক সৈন্যরা নিষিদ্ধ অঞ্চলে আনাগােনা করছে। সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে ভারতের প্রতিবাদ পাঠাবার কথা। হয়ত ইতিমধ্যে তা পাঠান হয়েছে। রক্তের অক্ষরে যে ইতিহাস লেখার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, কালির আঁচড় হয়তাে তার স্থান নিতে পারবে না। সীমান্তের পাকিস্তানি গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র সরে যাচ্ছে। লাহাের শহরে চলছে সমর উন্মাদনা। ব্যাংক থেকে টাকা তােলার হিড়িক পড়ে গেছে সেখানে। পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরা সীমান্তে হামেশাই পাকসৈন্যরা গুলী চালাচ্ছে। ওদের গােলাগুলী পড়ছে ভারতীয় এলাকায়। হয়ত ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্তি পরখ করে দেখছে ওরা। আগুন নিয়ে খেলছেন ইয়াহিয়া খান। এ আগুনের একটি ফুলকী সৃষ্টি করতে পারে একটি দাবানল।
কেন মরিয়া হয়ে উঠছেন ইয়াহিয়া খান? বাংলাদেশের অবস্থা শােচনীয়। ওখানে পাক প্রশাসন কায়েম হবার কোন সম্ভাবনা নেই। মুক্তিবাহিনীর মারের তীব্রতা বাড়ছে দিন দিন। বহু বিঘােষিত উপনির্বাচনের আশা সুদূর পরাহত। ইয়াহিয়ার বিশ্বস্ত খিদমতগার গবর্ণর মালিক জানের ভয়ে বিবাশ্রিত। তার মন্ত্রীরাও পদত্যাগে উৎসুক।যেসব বিশ্বাসঘাতক উপনির্বাচনে দাড়াবার দুঃসাহস দেখাবে তারা নির্বাচনের ফলাফল দেখে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। মুক্তিবাহিনী কাউকে রেহাই দেবে না। গােটা বাঙালি জাতীর সমর্থন রযেছে তাদের পিছনে। পাক সৈন্যরা বাঙালী মেয়েদের ধরে নিয়ে তাদের দিয়ে সৈন্যাবাস গুলােতে করাচ্ছে বেশ্যাবৃত্তি। নারীর এ অপমান সহ্য করতে পারেনা কোন সভ্য মানুষ। বিশেষ করে, এইসব মেয়েরা যদি হন। নিজেদের স্ত্রী, কন্যা এবং বােন। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে উঠেছে হাহাকার। দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রতিশােধের আগুন। সৈন্য দিয়ে তাদের দাবিয়ে রাখা অসম্ভব। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ জীবন্ত বাস্তব। ইয়হিয়া খান জানেন এই জ্বলন্ত সত্য। যেসব বিদেশী সাংবাদিক সম্প্রতি সফর করেছেন পূর্ববাংলা তারা দিয়েছেন আভ্যন্তরীণ অবস্থার ভয়াবহ চিত্র। আপস আলােচনার মাধ্যমে ইসলামাবাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কোন বােঝাপড়ার সম্ভাবনা আছে বলে তারা মনে করেন না। আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীরাও নিরাশ হয়ে পড়েছেন। ওরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছেন। যােগাযােগ ব্যবস্থা একেবারে বিপর্যস্ত। দূর্গত অঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী পাঠান দুঃসাধ্য। ত্রাণের চেয়ে মানুষ মারার ঝোক পাক-সৈন্যদের পেয়ে বসেছে। গেরিলারাও নিচ্ছে নির্মম প্রতিশােধ। পশ্চিম পাকিস্তানেও প্রাদেশিক স্বাতন্ত্রের দাবী জোরদার হয়ে উঠছে। কোনদিক সামলাবে পাঞ্জাবী প্রভাবিত পাক-সৈন্যদল? ইয়াহিয়া খান হয়ত ভাবছেন, বাংলাদেশ সমস্যাকে কোন মতে পাক-ভারত বিরােধে রূপান্তরিত করতে পারলেই তিনি পাবেন নিষ্কৃতি। যুদ্ধের আস্ফালন হয়তাে তারই আনুষঙ্গিক অঙ্গ। তার ধারণা, সংঘর্ষের সূত্রপাতেই এগিয়ে আসবে রাষ্ট্রসংঘ। তারপর গতানুগতিক যুদ্ধবিরতি। সবশেষে পাকভারত আলােচনার ব্যবস্থা। এই জুয়াখেলা সার্থক হলেই বাংলাদেশ সমস্যা পড়বে চাপা। চাঙ্গা হয়ে উঠবে পাক ভারত বিরােধ মিটাবার আন্তর্জাতিক উদ্যম। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে আবার দানা বাধবে পাকিস্তানি ঐক্য। বাতাসে তাসের ঘর বানাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। পাক ভারত যুদ্ধের আশঙ্কায় যাদের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটছে তারা খুঁজে বার করুন এই সামরিক উত্তেজনার কারণ। সােভিয়েট রাশিয়া বলছে, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হলে কমবে না উত্তেজনা। এই সমাধানের অর্থ সে বুঝেছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পন। মস্কো নেতাদের এই অভিমত খানিকটা স্পষ্ট। তারা বাস্তববাদী বলে সবার বিশ্বাস। এখনও সােভিয়েট রাশিয়া মনে করে, পাকরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব? পূর্ববাংলার জনপ্রতিনিধিরা গড়েছেন বাংলাদেশ সরকার। তারা বলেছেন- আপস অসম্ভব। স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না ইয়াহিয়া খান। ছিনিয়ে নিতে হবে এই ক্ষমতা। শ্রীমতী গান্ধী তার সাম্প্রতিক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছেন- বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধিরা যে মীমাংসায় সম্মতি দেবেন তাই মেনে নেবে ভারত। এই জনপ্রতিনিধি বলতে তিনি বুঝেছেন- মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ সরকার। মুজিবুর রহমান আটক রয়েছেন পাক-কারাগারে। তার হয়ে এখন কথা বলছেন বাংলাদেশ সরকার। তাদের কাছে একটি মাত্র মীমাংসার পথ খােলা। সেটি অস্ত্রের মীমাংসা। সােভিয়েট নেতারা যদি মনে করেন, বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক মীমাংসা হলেই কমবে পাক ভারত সামরিক উত্তেজনা তবে পাকিস্তানকে বাধ্য করতে হবে সে মীমাংসায়। বােঝাপড়ার জন্য তাকে আনতে হবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। এখানে কিছুই করার নেই ভারতের। কেন মস্কো নেতারা প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছেন না ইয়াহিয়ার উপর? বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা যদি অখণ্ড পাকিস্তান না চান তবে তাদের উপর তা জোর করে চাপিয়ে রাখার কেন চলছে অহেতুক উদ্যম? শরনার্থীরা অবশ্যই ফিরবে স্বদেশে। এটা তাদের মানবীয় অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি ভারতের জনসাধারণ সঙ্গত কারণেই সহানুভূতিশীল। তারা জানে, স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়া গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কোন সম্ভাবনা নেই। আর তার প্রতিষ্ঠা না হলে শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। স্বৈরতন্ত্রের নাভিশ্বাস উঠেছে পাকিস্তানে। তাকে বাঁচাবার জন্য ইয়াহিয়া যদি যুদ্ধে নামেন তবে ভারত অবশ্যই প্রত্যাঘাত করবে। এই অবাঞ্চিত সম্ভাবনা এড়াবার একমাত্র উপায় পাকিস্তানের জঙ্গী-চক্রের ধ্বংসসাধন। তােয়াজের বদলে দরকার আন্তর্জাতিক হুমকী। তা না করে শুধু মরা কান্না কাঁদলে ইয়াহিয়া খান হবেন আরও বেপরােয়া। ওতে যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়বে-কমবে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ অক্টোবর ১৯৭১