লড়াই কি বাধবে?
ভােলেনি ভারত ১৯৬৫ সালের লড়াই এর কথা। ভােলেনি ফিলােরা এবং ক্ষেমকরণে প্যাটন ট্যাঙ্কের মহা শ্মশান। ভােলেনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে আয়ুব খানের আকুল আবেদনের কাহিনী। লড়াই বাধিয়েছিল পাকিস্তান। প্রত্যাঘাত করেছিল ভারত। পাঞ্জাব এবং কাশ্মির রণাঙ্গনে পাঁচশ সত্তর বর্গমাইল পাকভূমির দখল নিয়েছিল জওয়ানেরা। রাষ্ট্রসংঘ যদি মাঝপথে যুদ্ধ থামিয়ে না দিত তবে আর সপ্তাহ দুয়ের মধ্যেই চুরমার হয়ে যেত পাক সামরিক যন্ত্র। যুদ্ধের আগে আয়ুব খানকে দুঃসাহসী করে তুলেছিলেন পশ্চিমী প্রচারকরা। ওরা বলতেন, ভারতীয় বাহিনী আকারে বড়। শক্তিতে পাকিস্তানের চেয়ে দুর্বল। এক-একটি পাক-সৈন্য সাহসে এবং সমর কৌশলে তিনজন ভারতীয় জওয়ান এর সমান। ওদের হাতে আছে মার্কিন সেবার জেট এবং প্যাটন ট্যাঙ্ক। যুদ্ধে পাকিস্তানের সামনে দাঁড়াতে পারবে না ভারত। ওয়াগার হাতাহাতি লড়াই-এ পাক-সৈন্যরা প্রথম বুঝেছিল জাওয়ানদের মারের চোট। ইছছাগিল খালের পারে দাঁড়িয়ে ভারতীয়েরা দেখত ওপারে পাকসৈন্যদের লজ্জা-মলিন মুখ। রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতি স্তব্ধ করে দিয়েছিল রাষ্ট্রসংঘ এবং বিজয়ীর অধিকার কেড়ে নিয়েছিল তাসখন্দ চুক্তি। এ-চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে অধিকৃত পাক-ভূখণ্ডের উপর বসে থাকত জওয়ানেরা। ভয়ে ভয়ে দিন কাটাত লাহাের। এই শহর ছিল ভারতীয় কামানের পাল্লায়। পাক-বিমানবহর তখন নিঃশেষিত প্রায়। পাল্টা আঘাত হানার ক্ষমতা ছিল না তার।
এবার ও কি ঘটতে যাচ্ছে পাঁচ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি? পাকিস্তানের রণ-উন্মাদনা দেখে হুশিয়ারী দিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম। তিনি বলেছেন- যদি ভারতের উপর চড়াও হন ইয়াহিয়া খান, তবে যুদ্ধ শেষ হবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে। কোনমতেই ছাড়বে না বারত অধিকৃত পাক-ভূমি। আন্তর্জাতিক চাপে নতী স্বীকার করবে না সে। পাক-জঙ্গীশাহীর বাঁকা ঘাড় সিধে না হওয়া পর্যন্ত চলবে এ-অবস্থা। ইয়াহিয়া খানের রণ-হুঙ্কার। পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্ত বরাবর তার সৈন্য সমাবেশ। মাঝে মাঝে ভারতীয় এলাকায় গুলিবর্ষণ। সব মিলিয়ে সৃস্টি করেছে এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি। নিশ্চিন্ত বসে নেই নয়াদিল্লী। নিচ্ছিদ্র করেছেন তারা প্রতিরক্ষা-ব্যুহ। শ্রীজগজীবন রামের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে কঠিন হুশিয়ারী। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সীমান্ত বরাবর থেকে যাবে ভারতীয় বাহিনী। সবার মুখে আজ অধীর জিজ্ঞাসা- সত্যিই কি লড়াই বাধবে? যদি বাধে তবে তা কতদিনের মধ্যে? পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামাে ভাঙনের মুখে। তা স্বত্ত্বেও যুদ্ধের দুঃসাহস কেন দেখাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান? তিনি কি হারিয়ে ফেলেছেন বাস্তববােধ? হরেক রকমের প্রশ্ন জমা হচ্ছে জনতার মনে। আসল উত্তর জানেন শুধু ইয়াহিয়া খান। আক্রমণ আরম্ভের দায়ীত্ব তার। ভারতের ভূমিকা শুধু আত্মরক্ষা এবং পাল্টা আঘাত। লাহােরের দেয়ালে দেয়ালে এবং যানবাহনে পড়েছে পােস্টার- ভারতকে ধ্বংস কর। নয়াদিল্লীর এবং ভারতীয় জনতার মনােভাব সংযত। তারা দিচ্ছেন না যুদ্ধের উস্কানি। নয়াদিল্লীর দাবী বংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃস্টি। এর মধ্যে নেই যুদ্ধের বিন্দুমাত্র উত্তাপ। যে লড়াই বাংলাদেশে এখন চলছে তা করছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনী। নয়াদিল্লীর অপরাধ- তারা পাক দস্যুদের কবলমুক্ত নব্বই লক্ষ শরণার্থীকে দিয়েছেন আশ্রয়। তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই সহানুভূতি দেখাচ্ছেন মুক্তিবাহিনীর প্রতি। তাতে যতি গোসা করেন ইয়াহিয়া খান তবে কিছুই বলার নেই ভারতের। আক্রান্ত হলে প্রত্যাঘাত অনিবার্য। এই সহজ কথা দেরীতে বুঝেছিলেন আয়ুব খান। তা বুঝেও না বােঝার ভান করছেন এখন ইয়াহিয়া খান।
একথা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশের অবস্থা সঙ্গীন। মারের চোটে মুক্তিবাহিনী কাহিল করে তুলেছে পাক সৈন্যদের। স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার অবলম্বন যদি হয় একমাত্র গেরিলা লড়াই তবে তার স্বার্থক সমাপ্তি হবেনা সহজে। হয়ত দুতিন বছর কেটে যাবে। শেষ পর্যন্ত পাততাড়ি গুটাবে পাকিস্তান। এতদিন অপেক্ষা করতে পারে। না নয়াদিল্লী এবং ইসলামাবাদ। এত শরণার্থীর বােঝা দীর্ঘদিন বইয়ে চলা ভরতের পক্ষে অসম্ভব। তার আর্থিক সহনশীলতার একটা সীমা আছে। নয়াদিল্লী চান, বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত এবং সন্তোষজনক ফয়সালা। অপরপক্ষে ইসলামাবাদও সাঙ্ঘাতিক বিব্রত। পূর্ববাংলার বৈদেশিক আয় শুন্যের ঘরে পৌঁছাতে দেরী নেই। এ অঞ্চলের বিরাট বাজার পাকিস্তানের হাতছাড়া। এক একটি করে বন্ধ হচ্ছে পাক-শিল্প প্রতিষ্ঠানের দরজা। বাইরের সাহায্য বন্ধ হবার উপক্রম। বাংলাদেশ ভরে উঠছে পাক-সৈন্যের কবরে। সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে দানা বাঁধছে অশান্তি। জনতার মন এখন অন্যত্র সরানাে দরকার। তার জন্যই প্রয়ােজন ভারত-বিরােধী জেহাদ এবং বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধে রূপান্তরিত করার কারসাজী। তারই অঙ্গ, সীমান্তে পাক-সৈন্য সমাবেশ। ইয়াহিয়া খানের আবদার- সীমান্ত থেকে ভারত সৈন্য সরালে এবং বাংলাদেশে গেরিলা অনুপ্রবেশ বন্ধ করলেই পাকিস্তান ফিরিয়ে নেবে তার সৈন্যদল। ওটা বেকুবের রাজনৈতিক চাল। দুনিয়ার নজর পাক-ভারত বিরােধের উপর সীমাবদ্ধ করার পাঁয়তারা। সীমান্ত বরাবর আগে সৈন্য সমাবেশ করে নি ভারত, করেছে পাকিস্তান। আর গেরিলারা ভারতীয় নয়, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। মুক্ত অঞ্চল থেকেই চলছে তাদের সংগ্রাম। লড়াই-এর ময়দানে তাঁদের নামিয়েছেন স্বয়ং ইয়াহিয়া খান। তার শয়তানি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে হয়ত মরণ কামড় দেবেন ইসলামাবাদ। তিলে তিলে বাঙালী গেরিলাদের হাতে মৃত্যুর চেয়ে তারা হয়ত নেবেন। চরম পথ। সেটা ভারত আক্রমণ। ভরসা রাস্ট্রসংঘ। তাদের ধারণা- শেষ পর্যন্ত এই সংস্থাই হয়ত আসবে ইমলামাবাদকে বাঁচাতে। ফলে রক্ষা পাবে মান মর্যাদা এবং পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব। জুয়া খেলছেন ইয়াহিয়া খান। ১৯৬৫ সাল এবং ১৯৭১ সাল এক নয়। এবারের অবস্থা আলাদা। যুদ্ধের শুরুতেই খসে পড়বে বাংলাদেশ। লড়াই-এর শেষে পশ্চিম পাকিস্তান যাবে গােল্লায়। আর বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের স্বাধীন। এই সম্ভাবনা সামনে থাকা স্বত্ত্বেও কি লড়াই বাধাবেন ইয়াহিয়া খান?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ অক্টোবর ১৯৭১