You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.21 | বাংলাদেশ সমস্যায় যুগােশ্লাভিয়া | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ সমস্যায় যুগােশ্লাভিয়া

পাঁচদিনের ভারত সফর শেষ হয়েছে। মার্শাল টিটো ফিরে গেছেন স্বদেশে। ভারত-যুগােশ্লাভ বন্ধুত্ব দীর্ঘ দিনের। এক সময় নেহেরু, নাসের এবং টিটো ছিলেন জোটনিরপেক্ষ নীতির তিন স্তম্ভ। ভারত, মিশর এবং যুগােশ্লাভিয়ার বন্ধুত্বও তখন ছিল খুব নিবিড়। ইহজগতে নেই নেহেরু এবং নাসের। অস্থিরতা চলছে। প্রেসিডেন্ট সাদাতের মিশরে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার মতিগতি এলােমেলাে। প্রেসিডেন্ট টিটো প্রায় নিঃসঙ্গ। তার সান্ত্বনা ভারত। বৈষয়িক উন্নয়নে এবং পররাষ্ট্র নীতির নবমূল্যায়নে এখন এ দুটি রাষ্ট্র পরস্পরের সহযােগী। যুগােশ্লাভ প্রেসিডেন্টের সদ্য সমাপ্ত সফর তার উপর দিয়েছে বাস্তবতার ছাপ। টিটো গান্ধীর যুক্ত ইস্তাহারের বয়ান এ ধারণার নিশ্চিত প্রমাণ। শুধুমাত্র ভারত এবং যুগােশ্লাভিয়ায় নয়, অপর কোন উন্নয়নশীল তৃতীয় রাষ্ট্রের বৈষয়িক উন্নয়ন পরিকল্পনায় এ দুটি রাষ্ট্র যুক্তভাবে মদৎ দিতে রাজী। লােকদেখান বন্ধুর অভাব নেই ভারতের। নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের দৃষ্টিতে তারা বিচার করেন নয়াদিল্লীর কার্যকলাপ। তাদের কাছে আদর্শটা গৌণ, নিজস্ব স্বার্থটাই বড়। যতক্ষন এ স্বার্থের বিঘ্ন না ঘটে ততক্ষণ চলে ভাল মানুষী। তার ব্যতিক্রম হলেই উঠে কঠোর সমালােচনা এবং ভারতকে ফাঁদে ফেলার জন্য নগ্ন পাঁয়তারা। বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলাের মনােভাব পাওয়া যাবে আদর্শভ্রষ্টতার লজ্জাজনক নিদর্শন।
বাংলাদেশে ইয়াহিয়া চালিয়েছেন গণহত্যা। তার অত্যাচারে নব্বই লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। সবাই স্বীকার করছেন সমস্যার ব্যাপকতা। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কিন্তু যে সাহায্য এসে পৌছেছে তার পরিমাণ অতি সামান্য। মার্কিন কর্তৃপক্ষ শরণার্থীদের দুঃখে ন্দ্রিাহারা। আবার তারাই ইয়াহিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছেন অস্ত্র। ভারতের খুব কাছে এসে দাড়িয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া। এখন সে স্পষ্টই বলেছে, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য দরকার বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। এই সমাধানের অর্থ, জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। পাক-রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে যদি রাজনৈতিক সমাধান না। আসে (তা আসবে না বলেই অনেকের বিশ্বাস) তবে কি করবে সোভিয়েট রাশিয়া তা এখনও অজ্ঞাত। বৃটেনের মতিগতি অপরিচ্ছন্ন। পাক-ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে তার যত মাথাব্যাথা। এর প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণে বৃটিশ সরকারের ঘােরতর অনিচ্ছা। শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বাস্তব উপায় উদ্ভাবনেও তাদের আগ্রহের অভাব স্পষ্ট। আরব রাষ্ট্রগুলাে তন্দ্রাচ্ছন্ন। অনেক আগেই ঐশ্লামিক মােহ কেটেছে পূর্ব বাংলার। কিন্তু তারব রাষ্ট্রগুলাে এখনও ঝিমুচ্ছে ধর্মীয় নেশায়। মানবদ্রোহী ইয়াহিয়াকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে তারা নারাজ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যাচ্ছেন আমেরিকা এবং ইউরােপ সফরে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং যেখানে মাথা কুটে ফিরে এসেছেন সেখানে শ্রীমতি গান্ধী খােলা দ্বার পাবেন কিনা সন্দেহ। বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারিত হয় নিজেদের স্বার্থের ভিত্তিতে, বাইরের কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রভাবে নয়।
ভারতের সমব্যথী যুগােশ্লাভিয়া। দীর্ঘদিনের নৈকট্য এ দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে এনেছে মমর্মিতা। ভারতের সমস্যা অনুধাবনে দেরি হয়নি প্রেসিডেন্ট টিটোর। শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি বলেছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারত বইতে পারে না শরণার্থীর বােঝা। এদের আশু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্ভব না হলে এই উপমহাদেশে দেখা দেবে অশান্তি। এর জন্য দায়ী পাকিস্তান। কারণ শরণার্থীরা তারই সৃষ্টি। এদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য দরকার-জনগণের গ্রহণযােগ্য বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। জনসাধারণ কি চান রক্তের অক্ষরে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বকে। তাদের সুস্পষ্ট মতামত এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলে বিপর্যয় অনিবার্য। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অবিসম্বাদী নেতা। তিনি আজ ইয়াহিয়ার বন্দী। তাকে বাদ দিয়ে কোনমতেই হতে পারে না বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান।
রাশিয়ার অনুরূপ। মস্কো নেতাদের মনােভাবের স্পষ্টতা এসেছে পরে এবং যুগােশ্লাভিয়ার এসেছে আগে। গােড়া থেকে মার্শাল টিটো স্বমতে অটল। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান উপায় সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে তিনি প্রায় একমত। এই সমদৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে নূতন করে পাওয়া গেছে ভারত-যুগােশ্লাভ বন্ধুত্বের নবপ্রকাশ। যুক্ত ইস্তাহার বহন করছে তার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২১ অক্টোবর ১৯৭১