You dont have javascript enabled! Please enable it!

অসহ্য মার্কিন মাতব্বরী

মােড়লীপনার একটা সীমা আছে। কিন্তু আমেরিকার মাতব্বরী সীমার বাইরে। পাক-ভারত সীমান্তে চলছে। সামরিক উত্তেজনা। উভয় পক্ষের সৈন্যদল দাঁড়িয়ে আছে সামনা-সামনি। মার্কিন কর্তৃপক্ষ গায়ে পড়ে উপদেশ দিচ্ছেন ভারত এবং পাকিস্তানকে- সীমান্ত থেতে সৈন্যবাহিনী হটাও। তাদের উপদেশ মত কাজ করলেই নাকি হ্রাস পাবে সীমান্ত উত্তেজনা। মার্কিন মাতব্বররা একবার ভেবে দেখেছেন কি- কে সৃষ্টি করেছে সীমান্ত উত্তেজনা? বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। নব্বই লক্ষ শরণার্থী পাঠিয়েছেন ভারতে। অসহায় নরনারী এখনও প্রতিদিন ভীড় করছে সীমান্ত পরের জন্যে। এরা বাংলাদেশে পাক সন্ত্রাসের বলি। ওপার থেকে কামান দাগছে পাক দস্যু দল। এপারে মরছে ভারতীয় নাগরীক। সীমান্ত বরাবর যখন প্রথম সৈন্য সমাবেশ করল পাকিস্তান তখন কোথায় ছিল আমেরিকার শান্তিকামীরা? তারা কি তখন পাক স্বৈরাচারীদের অস্ত্র জোগাননি? আর বাংলাদেশে যে নারকীয় বীভৎসতা চলছে তার জন্য আংশিক দায়ী আমেরিকা। তার আস্কারাতেই ইয়াহিয়া খান এতখানি উদ্ধত এবং বেপরােয়া। মার্কিন উপদেশের মূল্য কতটুকু? তাদের উপদেশ যে শুনবে সে পস্তাবে। ১৯৬৭ সালে মিশর শুনেছিল আমেরিকার উপদেশ। তার পিড়াপীড়িতেই প্রেসিডেন্ট নাসের দিয়েছিলেন প্রতিশ্রুতি- আগে তিনি আক্রমন করবেন না ইস্রাইল। কিন্তু ইস্রাইলের অতর্কিত আক্রমণ কি ঠেকাতে পেরেছিলেন মার্কিন কর্তৃপক্ষ? আক্রমণকারীকে নিন্দার প্রস্তাব যখন উঠল রাষ্ট্রসংঘে তখন ন্যাকা সাজল আমেরিকা। কে আক্রমণকারী তা জানল গােটা দুনিয়া, জানল না শুধু আমেরিকা। তার বিশ্বজোড়া গােয়েন্দাচক্র নিমেষে হয়ে গেল নির্বাক। মার্কিন প্রশ্রয় পেল আক্রমণকারী ইস্রাইল। এদিকে সর্বনাশ ঘটে গেল মিশরের। মার্কিন সামরিক অস্ত্র প্রথম যখন যাচ্ছিল পাকিস্তানে হাতে তখন নয়াদিল্লিকে দেওয়া হয়েছিল আশ্বাস- এসব অস্ত্র কখনই ব্যবহৃত হবে না ভারতের বিরুদ্ধে। ১৯৬৫ সালে মার্কিন অস্ত্র নিয়েই আক্রমণ করলেন আয়ুব খান। প্রতিবাদ তাে দূরের কথা, মার্কিন কতৃপক্ষ নিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকা। তারপর আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীকে একই পর্যায়ে ফেলে দিলেন আর এক ঝুড়ি উপদেশ।
এবার চলছে সেই পুরান কাসুন্দির ঘাটাঘাটি বাংলাদেশে যতদিন চলবে ইয়াহিয়ার তান্ডব এবং তৈরী হবে না শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ ততদিন উত্তেজনা প্রশমনের আশা বাতুলতা। মার্কিন নেতাদের মনে যদি থেকে থাকে বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা তবে তারা ইয়াহিয়া খানকে বলুন- বন্ধ কর বাংলাদেশে গণহত্যা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলের হাতে দাও শাসন ক্ষমতা। পূর্ব বাংলা থেকে সরিয়ে নাও পাকবাহিনী। এ দাবী রুপায়িত হবার পরই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে বাংলাদেশে। নির্ভয়ে শরণার্থীরা চলে যাবেন তাদের ছেড়ে আসা বাড়ীঘরে। ভারতের কাঁধ থেকে নামবে পর্বত প্রমাণ বােঝা। কমবে পাকভারত উত্তেজনা। এই সহজ পরিকল্পনার ছায়া সরাবেন না মার্কিন কর্তারা। ইয়হিয়া খান তাঁদের আশ্রিত। এই ক্ষুদে হিটলার এশিয়ায় মার্কিন কায়েমী স্বার্থরক্ষার বরকন্দাজ। তাই তার বেয়াদপী দেখেও দেখে না আমেরিকা। গােপনে তাকে দেয় অস্ত্র সাহায্য। যখনই পাক হুমকির মােকাবিলায় তৈরী হতে থাকে ভারত তখনই আসে অযাচিত মার্কিন উপদেশ। সমস্যার গােড়ায় হাত না দিয়ে তার চারদিক ঘুরে চলে ভুতের নাচন। অসহনীয় হয়ে উঠেছে মার্কিন মুরব্বীয়ানা। একই পর্যায়ে পড়ে না ভারত এবং পাকিস্তান। বাংলাদেশ সমস্যা সৃষ্টি করেছেন ইয়াহিয়া খান। তার পীড়ন জর্জরীত মানুষগুলােকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে সে তাদের ভরণপােষণে। আন্তর্জাতিক সমাজ যদি তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করত তবে থাকত না ভারতের কোন মাথাব্যাথা। তা করে নি বলেই ঘােরাল হয়ে উঠেছিল সমস্যা। তার সমাধানের জন্য প্রয়ােজন পড়েছে ভিন্ন পথের। এ পথ ভারত নেয় নি, নিয়েছে স্বাধিন বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনী। এদের মারের তীব্রতা যত বাড়ছে ততই বেসামাল হয়ে পড়ছেন ইসলামাবাদ। বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধে রুপান্তরতি করার হীন ষড়যন্ত্র চলছে স্বার্থান্বেষীদের মধ্যে। আমেরিকা এই দুষ্টচক্রের অন্যতম শরিক। তার পরামর্শের দাম ভারতের কাছে এক কানাকড়িও নয়। কারণ উপদেশদাতা পক্ষপাতদুষ্ট। তার কথায় কান দিলে সর্বনাশ অনিবার্য। হয়ত নয়াদিল্লীর অসতর্ক মুহুর্তে অতর্কিতভাবে ভারতের উপর ঝাপিয়ে পড়বে পাকিস্তান। তাকে ঠেকাবে না আমেরিকা। বরং ঝুড়ি খুলে নয়াদিল্লীকে দেবে আরাে ক’দফা উপদেশ।
কতদিন শরণার্থীদের আগলাবে ভারত? জনসাধারণ কতদিন যােগাবেন টাকা? এ প্রশ্নের বিশ্বাসযােগ্য কোন উত্তর দিতে পারে কি আমেরিকা? বাংলাদেশে যে তাবেদার সরকার কায়েম করতে চাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান তার উপর কোন আস্থা নেই জনতার। শরণার্থীরা যাবেন না এসব গােলামের খপ্পরে। তারা জানেন, গােলামের পিছনে নেই স্থানীয় সাধারণ মানুষের সমর্থন- আছে শুধু পাক সৈন্যদের বেয়নেট। গত সাড়ে ছ’মাস ধরে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানাচ্ছেন নয়াদিল্লী। সারা দুনিয়া ঘুরেছেন তাদের প্রতিনিধরা। কতটুকু সাড়া পেয়েছেন তারা? সম্প্রতি সােভিয়েট রাশিয়া খানিকটা সুর মিলিয়েছে ভারতের সঙ্গে। এখনও পাক-রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার ফয়সালায় সে বিশ্বাসী। গত সাড়ে ছ’মাসে যে ফয়সালার পাওয়া গেল না কোন ইঙ্গিত তা পাওয়া যাবে কবে? ফয়সালার বদলে ভারত সীমান্তে পাকিস্তান করছে সৈন্য সমাবেশ। তার উত্তরেই ভারত বানাচ্ছে প্রতিরক্ষাব্যুহ। এখন উপদেশ নিস্ফল। শরণার্থীদের ফিরাতে হবে স্বদেশে। বাংলাদেশের মুক্তি ছাড়া তা অসম্ভব। এ মুক্তি আনবেন বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনী। তাঁদের জয় যত ত্বরান্বিত হবে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনও তত এগিয়ে আসবে। মার্কিন কর্তাদের খুশি রাখার জন্য নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে পারে না ভারত। সীমান্ত থেকে সে সৈন্য সরাবে না। অসতর্ক মুহূর্তে পাকিস্তানকে কখনই ভারত আক্রমণের সুযােগ দেবে না। মুক্তিবাহিনী অবশ্যই জিতবে। ব্যর্থ হবে না শহীদদের রক্তদান। জনযােদ্ধাদের অগ্রগতীর পথ সুগম করা ভারতীয় জনগনের আন্তরিক কামনা। কারণ তার মধ্যেই নিহিত বাংলাদেশের মুক্তি, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। তাতে যদি আমেরিকা গোঁসা করে, করুক ক্ষতি নেই।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ অক্টোবর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!