রাষ্ট্রসঙ্ঘে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। ভুলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীস্বরণ সিং। তাঁর বক্তৃতায় বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগাশাহী। ভদ্রলােকের এক কথা—পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় নাক গলাচ্ছেন স্বরণ সিং। আগাশাহীর বাধা গ্রাহ্য করেন নি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে একক নন আগাশাহী। ঐশ্লামিক জোটের অন্যান্য শরিকও আছেন সেখানে। লাফিয়ে উঠেছিলেন সৌদী আরবের প্রতিনিধি জামিল বারােদি। আগাশাহীর পাে ধরলেন তিনি। সাধারণ পরিষদের এবারের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার আদম মালিক। তিনি আবার পাক সমর্থক। স্বরণ সিং-এর বক্তব্যকে বিধিবহির্ভূত বলার সাহস তার ছিল না। তা করলে জল ঘােলা হত অনেক। তা িবারােদিন কথাগুলাে মান্য করে চলার সবিনয় অনুরােধ জানালেন তিনি স্বরণ সিংকে। অনুরােধ প্রত্যাখ্যাত হল। বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন স্বরণ সিং। এদিকে আবার আর এক বিপদ। বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা যাবেন নিউইয়কে। সেখানে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্যদের শুনাবেন তারা বাংলাদেশের কাহিনী। চারদিন দেরী হয়ে গেল তাঁদের যাত্রার। তারা নাকি পাচ্ছিলেন না মার্কিন ভিসা। তলে তলে নাকি চলছিল বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির প্রয়াস। শেষ পর্যন্ত টেকে নি কোনাে অজুহান। ওরা চলে গেছেন নিউইয়র্কে। সকালের আকাশ দেখে নাকি ঠাহর করা যায় গােটা দিনের আবহাওয়া। এ প্রবাদ যদি সত্যি হয়, তবে রাষ্ট্রসঙ্ঘে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের সম্ভাব্য পরিণতি ঠাহর করা অসম্ভব কিছু নয়।
শ্রীস্বরণ সিং বলেন নি কোন নূতন কথা। গত ছ’মাস ধরে জনে জনে বলেছেন তারই বু করেছেন তিনি। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমবেত সদস্যদের সামনে। বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাকান্ড, লুণ্ঠন, নাবীধর্ষণ প্রভৃতি বীভৎসতার কাহিনী সবারই জানা। ভারতে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থী দেখে গেছেন অনেকেই। পাকিস্তানে গণতন্ত্রে জবাই করেছেন ইয়াহিয়া খান। তার অত্যাচারে বাংলাদেশে এসেছে দুর্ভিক্ষ, আর শরণার্থীর স্রোত নেমেছে ভারতে। মানবতার খাতিরে দুর্গত মানুষগুলােকে নয়াদিল্লী দিয়েছেন সাময়িক আশ্রয়। প্রতিদিন খরচ হচ্ছে প্রায় তিন কোটি টাকা। রাষ্ট্রসঙ্রে সেক্রেটারী জানিয়েছেন সাহয্যের আবেদন। বাংলাদেশের ভিতরে যারা অনশনে এবং অর্ধাশনে দিন কাটাচ্ছেন তাদের সাহায্যদানও বিশ্বসভার কর্তব্য অলিকাভুক্ত। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্রে সাহয্য ইয়াহিয়া ব্যবহার করছেন সামরিক এবং প্রচার অভিযানে। অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী পাকিস্তান সরকার, আর তার খেসারত দিচ্ছে ভারত এবং অন্যান্য রাষ্ট্র। তবু বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। ওতে নাক গলাতে পারবে না বাইরের কেউ। কোন উন্মাদ যদি নিজের ঘরে আগুন দিতে চায় তা সে দিক। কিন্তু তার ঘরের আগুন যদি প্রতিবেশীর বাড়ী স্পর্শ করে তবে তাকে আর ঘরােয়া আগুন বলা চলে না। নিজের বাড়ী রক্ষার জন্যই তখন উন্মাদ প্রতিবেশীর হাত চেপে ধরার দরকার পড়ে। বাংলাদেশেও চলছে এধরনের ঘটনা। ইয়াহিয়া সেখানে জ্বালিয়েছেন আগুন। প্রাণের দায়ে নব্বই লক্ষাধিক মানুষ পালিয়ে এসেছেন ভারতে। ফিরতে হবে তাদের স্বদেশে। যাদের তাড়িয়েছেঠন ইয়াহিয়া খান তাদের ফিরাতে পারবেন না তিনি। প্রশাসনে যত চুনকাম করা হােক না কেন কেউ বিশ্বাস করনে না নরহন্তাকে। যারা বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার বলে মাতামাতি করছেন, কি ভূমিকা নিয়েছেন তারা রােডেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বেলায়। সেখানে শ্বেতাঙ্গ মুষ্টিমেয় ফ্যাসিস্ত সরকাগুলাের বক্তব্য—এসব তাদের ঘরােয়া সমস্যা। তাতে নাক গলাবার অধিকার নেই অন্য কারও। ওদের কুযুক্তি গ্রাহ্য করেছেন কি রাষ্ট্রসঙ্ঘ? যারা আজ পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতীতে গলদঘর্ম তারাই কি ঘােরতর আপত্তি জানান নি শ্বেতাঙ্গ ফ্যাসিস্তদের কৈফিয়তে? পাকিস্তানর বেলায় তারা আজ ডিগবাড়ী খাচ্ছেন কেন? এই দ্বৈত নীতি কপচিয়ে কতদিন রাখবেন তারা বিশ্বশান্তি? এরই নাম কি বিবেক? এভাবেই কি দিচ্ছেন তারা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদের মর্যাদা?
বিশ্বসভার মুখের দিকে চেয়ে যারা বসে থাকবেন তাদের কপালে আছে অশেষ দুঃখ। রাষ্ট্রসঙ্ ন্যায় বিচারের স্থান নয়, ওটা বিতর্ক সভা। কাশ্মীর নিয়ে ভারত গিয়েছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘে। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছে তার মজা। বিশ্বসভার তদারকীর জ্বালায় সাইপ্রাস অস্থির। বছরের পর বছর কাটছে। কিছুতেই সে রেহাই পাচ্ছে না। সংখ্যালঘু তুর্কী সিপ্রিয়টদের দৌরাত্ম থেকে। ওদের ঠাণ্ডা করতে বেশী সময় লাগে না। কিন্তু উপায় নেই। কারণ ঘাড়ের উপর বসে আছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যক্ষেক দল। তাদের সামনে রেখে দাবার ঘুটি চালাচ্ছে বৃটেন, আমেরিকা এবং ঐশ্লামিক জোটের শরিকেরা। সাইপ্রাস সমস্যার গণতান্ত্রিক সমাধানের বিরাট বাধা তুরস্ক। এ রাষ্ট্রটি আবার পাকিস্তানের দোস্ত এবং পশ্চিমী সামরিক জোটের অংশীদার। তার উপর তুরস্কের সঙ্গে রয়েছে। ঐশ্লামিক জোটের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কোথায় সুবিচার পাবে ক্ষুদ্র সাইপ্রাস? প্রায় তেইশ বছর ধরে জড়িত রাষ্ট্রসঙ্ঘ। সেখানে তার জন্য সংরক্ষিত শুধু বৃহন্নলার ভূমিকা। বিশ্বসভার উপর বেশী নির্ভর করলে বাংলাদেশ সমস্যারও ঘটবে অনুরূপ পরিণতি। ওখানে সমাধান রাষ্ট্রসঙ্রে হাতে নয়। স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রধান প্রবক্তা এ সংস্থা। বাংলাদেশে স্থিতাবস্থা অসম্ভব। ওটা ভেঙ্গেছে এবং যতটুকু বাকি আছে তাও ভাঙ্গবে। সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং তাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে। এদের আঘাতের ক্ষমতা বাড়ান অত্যাবশ্যক। তা না হলে কাবু হবেন না ইয়াহিয়া খান—ঘুচবে না বাঙালীর দুর্গতি।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১