You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.01 | রুশ ভারত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

রুশ ভারত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর মস্কো সফর শেষ হয়েছে। তিনি ফিরে এসেছেন দিল্লীতে। গত ছ’মাস ধরে ভারতের উপর চলছে বাংলাদেশ সমস্যার জের। এর সমাধানের কোন হদিশ মিলে নি মস্কোতে। যুক্ত বিবৃতির বয়ানে। নূতনত্ব খুঁজে বার করা মুস্কিল। একটা মাত্র সান্তনা-পূর্ব পাকিস্তানের বদলে এখানে ব্যবহৃত হয়েছে পূর্ববাংলা কথাটি। এ অঞ্চলের জনগণের ইচ্ছা, মানবিক অধিকার এবং ন্যায়সঙ্গত স্বার্থের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছেন সােভিয়েট কর্তৃপক্ষ। এ সমাধানের ভার দিয়েছেন তাঁরা ইয়াহিয়ার উপর। এদিকে বাংলাদেশ সরকার বলছেন-অখণ্ড পাকিস্তানের নৈতিক ভিত্তি অপসৃত। স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। তার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া হতে পারে না বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধান। সােভিয়েট রাশিয়া এখন পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বসী। তার আওতার মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে সে ইচ্ছুক। বাঞ্ছিত সমাধানের জন্য আলাপ আলােচনা চলবে কাদের মধ্যে-এ সম্পর্কে সােভিয়েট নেতৃবৃন্দ নীরব। অন্ততঃ যুক্তবিবৃতিতে নেই তার ইঙ্গিত। প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন শুধু বক্তৃতায় বলেছেন—তাঁর সরকার গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই গঠন করেছেন বাংলাদেশ সরকার। তাদের বাহিনীই লড়াই করছেন পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে। এরা অবশ্যই গণতান্ত্রিক শক্তি। এদের প্রকাশ্য সমর্থন জানালে খুশী হতেন বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা। ভারত এবং সােভিয়েট রাশিয়া এসে পড়ত পরস্পরের আরও কাছে।
যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী গান্ধী। তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তিনি পুরােপুরি মেনে নিয়েছেন বাংলাদেশ সমস্যার সােভিয়েট মূল্যায়ন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বহুবার বলেছেন নয়াদিল্লী বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্যই ওটা দরকার। এতদূর এগুন নি সােভিয়েট নেতৃবৃন্দ। অনেকদিন ধরেই তারা সদুপদেশ দিচ্ছেন ইয়াহিয়া খানকে। তিনি শুনছেন না তাদের কথা। যত নষ্টের গােড়া এই ইয়াহিয়া খানকেই তারা মিনতি জানাচ্ছেন, শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে এবং তাদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে। কিসের আশায় সােভিয়েট নায়কেরা স্বৈরাচারী ইসলামাবাদের আশে-পাশে ঘুরছেন তা তারাই জানেন। ইয়াহিয়ার সুবুদ্ধি ফিরবে এবং শরণার্থীরা স্বদেশে যাবেন—এই অলীক কল্পনার পিছনে কতদিন ছুটবেন নয়াদিল্লী? নব্বই লক্ষ বিদেশী দূর্গত মানুষের ভার প্রায় এককভাবে বহন করা যেকোন রাষ্ট্রের পক্ষে কষ্টসাধ্য। দরিদ্রদেশ ভারত। তার উপর এ বােঝা সাংঘাতিক। বেশীদিন অপেক্ষা করাও মারাত্মক। সােভিয়েট রাশিয়ার গতি অত্যন্ত মন্থর। তার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে ক’কদম পিছিয়ে পড়তে পারে না ভারত। প্রধানমন্ত্রী যে দেশ সফরে যাবেন সে দেশের সরকার কোন একটি বিশেষ সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে ষােল আনা একমত হবেন—এ আশা অযাৈক্তিক। যতটুকু ঐকমত্য পাওয়া গেছে ততটুকুই প্রকাশিত হয়েছে যুক্ত-বিবৃতিতে।
বাংলাদেশ সমস্যার জটিলতা অনস্বীকার্য। এর সমাধান শান্তিপূর্ণ উপায় হবে, না অস্ত্রের জোরে হবে তা নির্ধারণ করবেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং ইসলামাবাদ। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে পাকিস্তানের অখণ্ড অস্তিত্ব বিদ্যমান। অপর কোন সরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে রূপান্তর ঘটত সমস্যার প্রকৃতির। ওটাকে কোনমতেই বলা চলত না পাকিস্থানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ইসলামাবাদের নারকীয় তান্ডবের ফলে নব্বই লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানের উপরই নির্ভর করছে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এখানেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে ঘরােয়া সমস্যা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সৃষ্টি-এ দুটিকে একেবারে আলাদা করে দেখা চলে না। কারণ এর জের এসে পড়েছে ভারতের উপর। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নিজেই বলেছেন অনিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্যে কোন শরণার্থীকে তিনি জোর করে ঠেলে পাঠাবেন না। নিশ্চিত নিরাপত্তার গ্যারান্টি কি এবং কারা তা দিতে পারেন স্পষ্টাস্পষ্টি তা বলেছেন। নয়াদিল্লী। ভারতের দৃষ্টিতে ইসলামাবাদ সংশােধনের বাইরে, আর সােভিয়েট রাশিয়ার ধারণা-ইয়াহিয়ার সংশােধন সম্ভব। সােভিয়েট কর্তৃপক্ষ যদি সত্যিই ভেবে থাকেন যে, বাংলাদেশে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে ইয়াহিয়া খান সক্ষম তবে তার প্রচেষ্টার একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকা দরকার। ছ’মাস চলে গেছে। আর কতদিন দেখবে সােভিয়েট রাশিয়া? একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে একমাত্র সােভিয়েট রাশিয়াই খুব কাছে এসে দাড়িয়েছে ভারতের। বাংলাদেশ সমস্যা অনন্তকাল ঝুলে থাকবে না। তার সমাধান করবেন বাঙালী এবং তাদের স্বাধীন সরকার। কিন্তু ভারতের বৈষয়িক উন্নয়নও সমপর্যায়ের জরুরী সমস্যা। তার সমাধানের পথে সােভিয়েট সহযােগিতার আন্তরিক প্রতিশ্রুতি নিঃসন্দেহে উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এক্ষেত্রে ভারত-সােভিয়েট যৌথ কমিশন গঠনের প্রস্তাব প্রগতির পথে বাঞ্ছিত পদক্ষেপ। কিন্তু এই পদক্ষেপ বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে ভারতের নিজস্ব মতামত প্রভাবিত করবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। কারণ এ সমস্যার সঙ্গে ভারত যতখানি জড়িত সােভিয়েট রাশিয়া ততখানি নয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১ অক্টোবর ১৯৭১