ডায়াসের শক্ত হাত কি লবণ হ্রদে পৌছবে?
কয়েকদিন আগে লবণ হ্রদ এলাকার উদ্বাস্তু শিবিরে ত্রাণ কর্মী এবং শরণার্থীদের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়ে গেছে। তার তীব্রতা হয়ত খুব বেশি নয় মাত্র দশজন আহত হয়েছেন। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া যদি এখনই প্রতিকার করা না যায়, সুদূর প্রসারী হতে বাধ্য। এই সম্ভাবনা রােধ করবার জন্যে রাজ্যপাল শ্ৰীডায়াস কি তার শক্ত হাত লবণ হ্রদের শিবিরের দিকে, এবং সেই সূত্রে বলা যায়, এই রাজ্যের অন্য সমস্ত উদ্বাস্তু শিবিরের দিকে, প্রসারিত করবেন?
মনে রাখা দরকার, শুক্রবারের ঐ সংঘর্ষ হঠাৎ একদিনের বিস্ফোরণ নয়। এর পেছনে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ আর ক্ষোভ জমা হয়ে রয়েছে। জল, কাদা, কিংবা ঠা-ঠা রােদুরে সুদীর্ঘ অভুক্ত ঘণ্টা দাঁড়িয়ে যাদের বেশনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, তারা এই দৈনন্দিন যন্ত্রণা বাধ্য হয়ে সহ্য করছে বটে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাদের মনে কোনাে বিক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছে না। প্রত্যেকটি শিবিরে রেশন-প্রত্যাশীদের দীর্ঘ সর্পিল লাইনগুলিই যথেষ্ট প্রমাণ যে, ত্রাণ সামগ্রী বণ্টনের ব্যাপারটি কি পরিমাণ অসংগঠিত। কিন্তু বণ্টনের বিলম্ব বা বিশৃঙ্খলাই লবণ হদের বিক্ষোভের একমাত্র কারণ ছিল না। অসন্তোষের একটা একটা বড় কারণ ছিল রেশন বণ্টনে দুর্নীতি। যে পরিমাণ রেশন উদ্বাস্তুদের জননা মাথাপিছু বরাদ্দ রয়েছে, সে পরিমাণ রেশন তাদের দেওয়া হচ্ছে না, এই অভিযােগ উঠেছে। এবং এই অভিযােগ যে শুধু লবণ হ্রদের শিবিরের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা খোজ নিলেই জানা যাবে। বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যাটা এপার বাংলার একশ্রেণীর লােকের কাছে তাড়াতাড়ি-বড়লােকহওয়ার একটা সূবর্ণ সুযােগ হিসেবে হাজির হয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তারা ঐ সুযােগের সদ্ব্যবহারে উঠে পড়ে লেগে গেছে। নদীয়া সীমান্তের শিবিরগুলিতে, শােনা যাচ্ছে, এমনকি বরাদ্দের অর্ধেক সরবরাহ করে পুরাে রসিদ সই করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যুগান্তরে এক সাম্প্রতিক রিপাের্টে রেড ক্রসের দুধ নিয়ে দুর্নীতির অভিযােগের কথা প্রকাশিত হয়েছিল। একই রিপাের্টে লবণ হ্রদের উল্লেখ করে বলা হয়েছিল যে, মৃত শরণার্থীদের সংখ্যা বহুগুণ স্ফীত করে সৎকারের জন্যে সরকারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে একটি খবরে বলা হয়েছিল যে, শিবির তৈরীর ত্রিপল কেনা সংক্রান্ত একটি ফাইলের নাকি হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না।
আমরা, এপারের বাঙ্গালী, ওপারের দুর্দশায় আর যন্ত্রণার দিনে এইভাবে আমাদের সহানুভূতি জানাচ্ছি। এতে আমাদের লজ্জার কোনাে কারণ নেই জানি, কিন্তু রাজ্যপালের উঠে নড়ে চড়ে বসার প্রয়ােজন আছে। বিশেষ করে দৈনিক রেশন বণ্টনের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক দুর্নীতি চলছে তা শক্ত হাতে এখনই বন্ধ করা দরকার। কারণ ভূয়া মৃতের নাম করে টাকা আদায় করে যারা নিজেদের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বাড়াচ্ছেন, তারা বড়জোর সরকারের আর্থিক বঞ্চনার কারণ ঘটাচ্ছেন। কিন্তু যারা শরণার্থীদের বরাদ্দ রেশনে থাবা মেরে নিজেদের পকেট ভারী করছেন, তারা শুধু শরণার্থী শিবিরগুলির মধ্যে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতিকেই অবনত করছেন না, তারা দুদিক থেকে আমাদের স্বার্থের ক্ষতি করছেন। একথা সুনিশ্চিত যে, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের ফয়সালার দিনে আমরা কোনাে বন্ধু নয়, সত্তর লক্ষ বিক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট মানুষকে সীমান্তের ওপারে ফেরৎ পাঠাবাে। আর যদি শেষ পর্যন্ত অবস্থার গুণে তাদের এখানে থেকেই যেতে হয় তাহলেও কি তারা অনুগত ও কৃতজ্ঞ নাগরিক হয়ে থাকবে? এবং ঐ বিপুল বিক্ষুদ্ধ জনগােষ্ঠীর ভার কি আমাদের সমাজদেহকে আরাে নিদারুণভাবে আঘাত করবে না?
এই অব্যবস্থা এবং তজ্জনিত দুর্নীতি-হয়ত কিছু পরিমাণে প্রসাশনিক ভাঙ্গনের ফল। এই রাজোর পক্ষে তার স্বাভাবিক সমস্ত কাজকর্ম চালিয়ে এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব হয়ত সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা নিষ্ক্রিয়তার সাফাই হতে পারে না, অব্যাহত দুর্নীতির তাে নয়ই। এই রাজ্যের বিশেষ সমস্যার কথা বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় সরকার আট লক্ষ শরণার্থীকে অন্য রাজ্যে নিয়ে যাবার কথা ঘােষণা করেছিলেন। যেখানে শরণার্থী সংখ্যা সত্তর লক্ষ ছুঁয়েছে, সেখানে আট লাখ উদ্বাস্তুর স্থানান্তরে বিশেষ কিছুই অবশ্য এসে যাচ্ছে। তবু কেন্দ্রীয় সরকার ঐ প্রতীক প্রতিশ্রুতিটুকুও পালন করেননি। আজ পর্যন্ত বড় জোর সােয়া দুলাখ উদ্বাস্তুকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এটা নিশ্চিতই অসংগত। কিন্তু যেটা আরাে বেশি অসংগত সেটা হচ্ছে এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের উদ্যমহীনতা। তারা কতটুকু স্থায়ী চাপ এখন পর্যন্ত নয়াদিল্লীর ওপর সৃষ্টি করেছেন?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ অক্টোবর ১৯৭১