You dont have javascript enabled! Please enable it!

সােভিয়েট প্রেসিডেন্টের আশ্বাস

সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগাের্ণি আশ্বাস দিয়েছেন ভারতকে-বাংলাদেশ সমস্যার ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সব রকমের সম্ভাব্য সাহায্য করবে সােভিয়েট রাশিয়া। ভারতের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতি নজর রেখেই চলবে সােভিয়েট প্রচেষ্টা। সােভিয়েট প্রেসিডেন্টের আশ্বাসের মূল্য অনস্বীকার্য। কিন্তু তার অস্পষ্টতায় সাধারণ মানুষের মনে খানিকটা নৈরাশ্য সৃষ্টি অস্বাভাবিক নয়। অপর পক্ষে রাষ্ট্রপতি গিরির ভাষণ খুবই জোরাল এবং অর্থপূর্ণ। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানে হয়ে গেছে সাধারণ নির্বাচন। বিপুল ভােটাধিক্যে যারা জিতেছেন তাঁদের সঙ্গে করতে হবে সমস্যার ফয়সালা। তাদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। রাষ্ট্রপতি গিরি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন ভারতের অভিমত। প্রেসিডেন্ট পদগাের্ণি যদি রাষ্ট্রপতি গিরির মত স্পষ্টবাদী হতে পারতেন তবে শরণার্থীদের মনে কিছুটা আশা জাগত। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাও স্পষ্ট হয়ে উঠত। প্রেসিডেন্ট পদগাের্ণি এ পথে যান নি। তিনি পাক-ভারত সম্ভাব্য লড়াই এড়াবার জন্যই বেশী ব্যগ্র হয়ে পড়েছেন। যুদ্ধটা বাধাবে কে? নয়াদিল্লী বার বার বলেছেন, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চান না, তাঁরা চান বন্ধুত্ব। একাধিকবার যুদ্ধবর্জন চুক্তি সম্পাদনের ইচ্ছা জানিয়েছে ভারত। প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। যদি যুদ্ধ এড়াতে হয় তবে সংযত করা উচিত ইসলামাবাদকে, ভারতকে নয়।
সােভিয়েট রাশিয়া ভালভাবেই জানে ১৯৬৫ সালে লড়াই বাঁধিয়েছিলেন আয়ুব খান, লালবাহাদুর শাস্ত্রী নন। তাসখন্দ চুক্তি জঞ্জালের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করেছে পাকিস্তান, ভারত নয়। এত সব জানা সত্ত্বেও সমস্যার গােড়ায় কেন হাত দিচ্ছে না সােভিয়েট রাশিয়া? নব্বই লক্ষ শরণার্থী ভারতের মাটিতে এসে ধুকছেন। তাদের নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন নয়াদিল্লী। তাদের ফেরৎ পাঠাবার বাস্তব পরিকল্পনা দিচ্ছেন না কেউ। কেবল ভারতের উপর বর্ষণ করছেন ভালমানুষীর সার্টিফিকেট। এদিকে বাইরে দানা বেঁধে উঠছে বিভিন্ন ধরনের স্বার্থবাদী জোট। বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করেছেন ইয়াহিয়া খান। এই মানবদ্রোহীকে ধিক্কার দিতেও অনেকে নারাজ। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিউম খেয়েছেন ডিগবাজী। এখনও যারা পূর্বে বাংলার টিকে আছেন তাদের দুঃখ অবিরাম ধারায় ঝরছে তার চোখের জল। ওদের মুখে অন্ন তুলে দিতে তিনি উৎসুক। ত্রাণ সংস্থাগুলাে থেকে সাহায্যও যাচ্ছে সেখানে। কিন্তু সব বানচাল করে দিচ্ছে মুক্তিবাহিনী। ও ডুবাচ্ছে। অনশনক্লিষ্টদের মুখের খাবারের ঘটছে সলিল সমাধি। প্রশাসনের অভাবে ত্রাণ বিলি বণ্টনেও হচ্ছে অসুবিধা। চমৎকার কথা বলেছেন হিউম। পূর্ব বাংলার আসন্ন দূর্ভিক্ষটা টেনে এনেছে কে? অবশ্যই ইয়াহিয়া খান। তাকে ছেড়ে হিউম টানাটানি করছেন মুক্তিবাহিনী নিয়ে। ওদের সংগ্রাম শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী শােষক যন্ত্র। তার বিনাশ চায় মুক্তিবাহিনী। আর তাদেরই জনস্বার্থবিরােধী বলে ইঙ্গিত করেছেন হিউম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় গােটা বাংলায় দূর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিলেন বৃটিশ শাসককুল। গান্ধীজী দিয়েছিলেন তাদের ভারত ছেড়ে যাবার নােটিশ। আগস্ট আন্দোলনে যারা নেমেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধেও সেদিন বৃটিশ অপপ্রচারের বিরাম ছিল না। সংগ্রামী জনতার অসহযােগিতার ফলেই নাকি সেদিন বৃটিশ সরকার খাদ্য পৌছে দিতে পারেন নি অনশনক্লিষ্ট নরনারীর মুখে। মুক্তিবাহিনী সম্পর্কেও শােনা যাচ্ছে। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কণ্ঠে সেই পুরান সুর। অথচ বৃটেনও চায় বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান।
আমেরিকা বেশী ধানাই-পানাই করে নি। আগাগােড়াই সে ওকালতী করেছে ইয়াহিয়ার পক্ষে। প্রেসিডেন্ট নিকসন জুগিয়েছেন ইসলামাবাদের অস্ত্র এবং অর্থ। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনীকে সুনজরে দেখেন না মার্কিন কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ সমস্যাটিকে পাক-ভারত বিরােধ বলে দেখাতে তারা ব্যস্ত। ওরা সন্ত পণে অনুসরণ করছেন ইয়াহিয়ার অনুসৃত পথ। এক কোণে বসে আছে ফ্রান্স। এখন বেশী উচ্চবাচ্য করছে না সে। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়ম রােজার্সের সঙ্গে হয়েছে সােভিয়েট পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশ সমস্যা নাকি প্রাধান্য পেয়েছিল তাঁদের আলােচনায়। ভারতে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী আগমনে নাকি প্রবল হয়ে উঠেছে পাক-ভারত উত্তেজনার সম্ভাবনা। এটা যাতে আর বাড়তে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে উভয়েই নাকি সমভাবে ইচ্ছুক। কিন্তু কিভাবে কমবে উত্তেজনা? অনির্দিষ্ট কালের জন্য নব্বই লক্ষ শরণার্থীকে দেখাশােনা করবে ভারত? সে কি জানাবে না এদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবী? মার্কিন নীতি সবারই জানা। সমস্যার সত্যিকার সমাধানে পাওয়া যাবে না তার নিরপেক্ষ সমর্থন। কিন্তু সােভিয়েট রাশিয়ার উপর ভারত এবং বাংলাদেশের ভরসা খুবই বেশী। বৃটিশ এবং আমেরিকার থেকে তার দৃষ্টিভঙ্গীও আলাদা। তাছাড়া ভারত-সােভিয়েট বন্ধুত্ব দীর্ঘ দিনের। সাম্প্রতিক মৈত্রী চুক্তি তাকে করেছে দৃঢ়তর। দৃঢ়তর ভিত্তিকে দৃঢ়তম করার জন্যই দরকার বাংলাদেশ সমস্যার গণতান্ত্রিক সমাধানে সােভিয়েট রাশিয়ার বাস্তবমুখী স্পষ্ট ঘােষণা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ অক্টোবর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!