You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.04 | মার্কিন উপদেশের পুঁতাে | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মার্কিন উপদেশের পুঁতাে

রাষ্ট্রসঙ্ঘে উঠেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। কিছুটা আলােড়ন সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। পরে হয়ত উত্তাপটা বাড়বে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং গিয়েছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়ম রােজার্সের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁদের মধ্যে হয়েছে এক প্রস্থ ঘরােয়া আলােচনা। শুনে এসেছেন তিনি মার্কিন উপদেশামৃত। শরণার্থীদের নিয়ে পাক-ভারত সম্পর্ক নাকি ক্রমবর্ধমান অবনতমুখী। সম্ভাব্য অঘটন এড়াবার জন্য ভারত এবং পাকিস্তানকে সংযম অবলম্বনের উপদেশ দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব। পাকিস্তান যাতে বাংলাদেশ সমস্যার একটা সমাধান করে ফেলে তার জন্যও নাকি চেষ্টা করবে আমেরিকা। গত ছ মাসে ধরেই চলছে মার্কিন চেষ্টা। শরণার্থীদের জন্য সে দিচ্ছে ছিটেফোটা সাহয্য। আর শরণার্থী সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানকে যােগাচ্ছে সে অর্থ এবং অস্ত্র। তার মতে, বাংলাদেশ সমস্যাটা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। ওতে অন্যের মাথা গলান অনুচিত। তাই যদি হয়ে থাকে সুচিন্তিত মার্কিন অভিমত তবে সমস্যার সমাধানের জন্য পাকিস্তানের উপর আমেরিকা চাপ দেবে কোন যুক্তিতে? প্রথম কথার জের শেষ হবার আগেই মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলছেন-ভারতে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থীর আগমনে এ অঞ্চলে দেখা দিয়েছে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা। তাই দরকার, ভারত এবং পাকিস্তানের সংযম। শরণার্থীরা বাংলাদেশ সমস্যার আনুসঙ্গিক অঙ্গ। ভারতে তাদের অবস্থান পাক-ভারত উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়ালে কি করে বাংলাদেশ সমস্যা চিহ্নিত হবে পাকিস্তানের ঘরােয়া সমস্যা হিসাবে? মার্কিন কর্তাদের আবােল-তাবােল বকুনীর মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে বার করা মুস্কিল।
আমেরিকার চিন্তাধারা চলে পূর্বে নির্দিষ্ট একটি বন্ধুর পথে। পাক-ভারত সম্পর্কিত যে কোন ঘটনায় এক লাইনে সে দাঁড় করাবে ভারত এবং পাকিস্তানকে। কে দোষী এবং কে নিদোষ তা যাচাই করার প্রয়ােজন নেই। সমভাবেই উভয়ের উপর হবে উপদেশ বর্ষণে। বাংলাদেশ থেকে নব্বই লক্ষ মানুষ তাড়িয়েছেন ইয়াহিয়া খান। নয়াদিল্লী তাদের দিয়েছেন আশ্রয়। কল্যাব্রতী ভারত এবং মানবদ্রোহী পাকিস্তানকে মার্কিন কর্তারা করছেন সমপর্যায়ভুক্ত। ইয়াহিয়ার হাত থেকে ঘাতকের খাঁড়া কেড়ে নিলেই তাে থাকে না কোন সমস্যা। ভারতেও নামাতে পারে শরণার্থীর বােঝ। সে তাে সৃষ্টি করে নি বাংলাদেশ সমস্যা এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থী? তার সংযমের কি আছে? সংযমের উপদেশ দেওয়া উচিত পাকিস্তানকে। সে-ই সত্যিকারের আসামী। স্বকল্পিত বিচারকের আসনে বসে রােজার্স গাচ্ছেন নরঘাতী দস্যুর সাফাই। না গেয়ে উপায় নেই। স্বৈরাচারী এ রাষ্ট্রটি যে তাদের সামরিক জোটের শরিক। ঘাতকের হাতের খাড়াটাও যে আমেরিকার দান। ঠেলায় না পড়লে আশ্রিতকে পথে বসান সম্ভব নয়। তা করলে এ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক স্ট্রাটেজীতে ধরবে ফাটল। মার্কিন কর্তাদের কাছে সুবিচারের প্রত্যাশা বাতুলতা। অজ্ঞান পাপীদের বুঝান চলে। জ্ঞানপাপীদের বুঝান যায় না।
আর একটা প্যাচ কষেছেন রােজার্স। ভারতকে সংযম অবলম্বনের উপদেশ দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হন নি, তিনি তাকে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলাের উপর তার প্রভাব বিস্তারের জন্য অনুরােধ জানিয়েছেন। কি উদ্দেশ্যে এসব দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করবে ভারত? পাকিস্তান যাতে সংযত হয় তার জন্য। এই প্রক্রিয়ার মৌল লক্ষ্য কি? বাংলাদেশ সমস্যার ফয়শালা সম্পর্কে একটা আপােষ। আপােষটা কাদের মধ্যে? রােজের্সের মুখে নেই কোন উত্তর। কি করে থাকবে? স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্তিত্ব এবং মুক্তিবাহিনীর মার-দুই প্রত্যক্ষ। আপােষ আলােচনা চলতে পারে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং ইসলামাবাদের মধ্যে। এত রক্তপাত এবং গণহত্যার পর বাংলাদেশ কখনই স্বীকার করবে না ইয়াহিয়ার শাসন। স্পষ্টভাবে একথা বলে। দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকার। মুক্তিবাহিনী তাদের ঘােষণার উপর করেছেন রক্তস্বাক্ষর। নয়াদিল্লী নিজেও বলেছেন, মুজিবুর রহমান এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার নেই কোন সমাধান। এক্ষেত্রে আপােষের কথা অবান্তর। এত ধানাই-পানাই না করে আমেরিকা নিজেই ইয়াহিয়াকে পাঠাতে পারে বাংলাদেশে। তার মুখ থেকেই আসুক না আপােষের প্রস্তাব। গােটা বিশ্ব পরখ করুক, বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া। এপথে পা দেবেন না মার্কিন কর্তারা। ওঁরা মনে মনে পূর্ব বাংলার পাক তাঁবেদার মালিক সরকারকে জানাচ্ছে আশীর্বাদ। পাকিস্তানের এই চাতুরীকেই ইয়াহিয়ার ভালমানুষীর সার্টিফিকেট হিসাবে চালাবার চেষ্টায় তারা ব্যস্ত। তারই পাঁয়তারা চলছে চারদিকে। রাষ্ট্রসঙ্ েপড়বে এসব ষড়যন্ত্রের প্রভাব। ওখানে জল ঘােলা হবে। সমাধান মিলবে না। বাংলাদেশের প্রধান ভরসা বাহুবল এবং মারের তীব্রতা বৃদ্ধি। তা হলেই টনক নড়বে আমেরিকার। ফিরে পাবে সে বাস্তববােধ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ অক্টোবর ১৯৭১