You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.06 | ভিক্ষা ও চুরির দ্বারা আর্তসেবা | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ভিক্ষা ও চুরির দ্বারা আর্তসেবা

পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের দুঃখ যে দুনিয়ার ছােট বড় সকলেই কি গভীরভাবে স্পর্শ করেছে এবং এই নিরাশ্রয় নিরপরাধ মানুষগুলিকে বিপদমুক্ত করার জন্য সর্বস্তরেই যে কি অকপট প্রয়াস চলছে, তার একটি করুণ মধুর ঘটনা পাওয়া গেছে রাজধানী দিল্লী থেকে। রাজকুমার নামে এক ক্ষীণদেহ তরুণ কবি সেখানে হিন্দী ও উর্দুতে চারণগাথা রচনা করে তাই গেয়ে গেয়ে আর্ত পূর্ব বাংলার মানুষদের জন্যে টাকা তুলছেন। তার সঙ্গে শেখ মুজিবুরের একখানি ছবি ও কাঁধে একটি কানেস্তারা। এই কানেস্তারা তিনি সংগৃহীত টাকায় ভর্তি করবেন সংকল্প করেছেন। সংগ্রহ তার হয়েছেও ভালই। দুটি লােক দুই চড়ের বিনিময়ে তাকে ১০ টাকা হিসাবে দিতে স্বীকৃত হলে, তিনি নাকি তাতেও রাজী হন। মজার কথা যে ওদের একজন তাকে চড় মেরে পালানর চেষ্টা করলে জনতা সেই ব্যক্তিকে বাধ্য করে প্রতিশ্রুত টাকা দিতে। পরের জন্যে গান গাওয়া যদি বা সম্ভব, চড় খেয়ে টাকা কুড়ান ঘটনা হিসাবে নিশ্চয় অভিনব। এর মধ্যে যে স্নেহ-সুকুমার দয়ার্দ্র হৃদয়টি প্রতিফলিত হয়েছে, তার দিকে তাকিয়ে কোন পাষণ্ডও কৌতুক করতে ভরসা পাবে না।
আর একটি খবর পাওয়া গেছে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে। ২০ বছর বয়স্ক এক নিঃস্ব যুবক কিছু দিন আগে, বিখ্যাত শিল্পী ভারমিয়ারের আঁকা প্রেমপত্র নামক সুবিদিত ছবিখানি চুরি করে। গােয়েন্দা পুলিশ প্রাণপণ চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত চোর ধরতে সমর্থ হয়, বামালেরও সন্ধান পায়। কিন্তু সেটি ফেরৎ দেওয়ার শর্ত হিসাবে যুবক বলেন, ওর মূল্য বাবদ তাকে ৩০ লক্ষ টাকা দিতে হবে। টাকাটা তিনি পূর্ব বাংলার আর্ত ও সর্বস্বান্ত নরনারীর হিতে দেবেন। পুলিশ একথায় তাঁকে চুরির দায় থেকে রেহাই দেবে কিনা অথবা কোন ধনী বদান্য ব্যক্তি আগুয়ান হয়ে এসে তাকে ঐ পরিমাণ টাকা দিয়ে বন্ধন মুক্ত করবেন কিনা জানি না। তবে ঘটনাটা উপেক্ষণীয় নয়।
এক ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম দরিদ্র কবি তাঁর লেখনী ও কণ্ঠের বিনিময়ে অর্থ সংগ্রহ করছেন। ইতর দূবৃত্তের অমানুষিক ছােটপনা অগ্রাহ্য করেও রিক্তের জন্যে ভিক্ষার গুলি সর্বসমক্ষে মেলে ধরেছেন। অপর ক্ষেত্রে দেখলাম নিঃসম্বল তরুণ অমূল্য শিল্পসম্পদ চুরি করেও বিপন্নকে সেবা করার কথা ভেবেছেন। এ জন্য দণ্ড, অবমাননা, নির্যাতন, সবই প্রাপ্য হতে পারে জেনেও পেছপা হন নি তিনি। ভিক্ষাকে মানব সংস্কৃতি বৃত্তি হিসাবে চিরদিন ছােট বলে চিহ্নিত করেছে। আর চুরিকে করেছে ঘৃণ্যতম ব্যবসা হিসাবে। কিন্তু এই দুই পথেও যে আশ্রয়হীন অন্নহীনের জন্যে মানুষ দরদের উদ্দীপনায় পা বাড়াতে পারেন, আর তাতে কোন বিবেকবান মানুষেরাও নাক সিটকান না, এমন ঘটনা যে পৃথিবীতে ঘটতে পারে, উপরের দুটি কাহিনীই তার প্রমাণ।
আসলে কাজের ভাল মন্দ নির্ধারিত হয় তার পশ্চাবর্তী উদ্দেশ্যের গুরুত্ব বিচার করে। উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয় তাহলে প্রয়ােজনমত চলতি নীতিজ্ঞানের মাপকাঠি বর্জন করতেও দ্বিধা বােধ করেন না। মননশীল মানুষেরা। কাজেই দেখা যাচ্ছে সব ভিক্ষাই ভিক্ষা নয়, সব চুরিই বড় বিদ্যা নয়। তার রকমফেরও আছে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ অক্টোবর ১৯৭১