You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.06 | পাঞ্জাব সীমান্তে পাক জঙ্গী পাঁয়তারা | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পাঞ্জাব সীমান্তে পাক জঙ্গী পাঁয়তারা

পাঞ্জাব সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ করেছে পাকিস্তান। ভারত-বিরােধী জেহাদ উত্তুঙ্গ হয়ে উঠেছে সেখানে। দেয়ালে দেয়ালে পােস্টার ঝুলছে-আমাদের এক নম্বর শত্রু ভারত। তিনশ বিয়াল্লিশ মাইল লম্বা এই সীমান্ত। লাহােরের আট মাইল দূর দিয়ে চলে গেছে ইছােগিল খাল। ভারতীয় সীমান্ত থেকে এ খালের নিকটতম দূরত্ব সাত মাইল। ১৯৬৫ সালের লড়াই-এ ইছােগিলের পাড়ে এসে দাড়িয়েছিলেন ভারতীয় জওয়ানেরা। ইছােগিলের পুবে একশ চল্লিশ বর্গ মাইল ভূমি দখল করেছিলেন তারা। তাদের কামানের পাল্লার মধ্যে ছিল লাহোের সেনানিবাস। এবার পাকিস্তান হয়েছে সতর্ক। ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র পাঁচ মাইল পশ্চিমে এবং ইছােগিল খালের পুবে সে কেটেছে আরও দুটি নালা। ইছছাগিলের সমান্তরালভাবে চলে গিয়েছে একটি। পার্শ্বদেশ থেকে আক্রমণ প্রতিরােধের জন্য সম্ভবত: কাটা হয়েছে অপরটি। শত্রু ট্যাঙ্কের অগ্রগতি প্রতিহত করাই এসব খালের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাছাড়া মূলতানের কাছে পাকিস্তান তৈরী করেছে নতুন। একটি পুল। ফলে কাসুর অঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ ব্যবস্থা হয়েছে উন্নত। এই রণাঙ্গনের কথা তুলেন নি পাক-সমর নায়কেরা। ১৯৬৫ সালে এখান থেকেই তাদের সাঁজোয়া বহর ঢুকেছিল ভারতীয় এলাকা খেমকরণে। সেখানে তৈরী হয়েছিল প্যাটনের মহাশম্মান। তারপর তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল শিয়ালকোটের অদূরে ফিলােরার। আগের ভুল সংশােধন করেছে পাকিস্তান। রন্ধ্রপথের সব মুখগুলােই বুজিয়ে দিয়েছে সে। গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশ মুখগুলােতে সন্নিবেশ করেছে সাঁজোয়া গােলন্দাজ এবং পদাতিক বাহিনী। পাকসামরিক শক্তি এখন ১৯৬৫ সালের তুলনায় বেশী। তাদের অস্ত্রশস্ত্রও আধুনিক। সীমান্তরক্ষীরা সরে গেছে ভিতরে। ব্যাপকভাবে তৈরী হয়েছে পিলবকসের বেড়াজাল। অনাবৃত স্থানগুলােতে মাটির নীচে পোতা রয়েছে অসংখ্য মাইন। আবহাওয়া গরম। চারদিকে শুধু সাজ-সাজ রব।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ধারণা পাক-গােয়েন্দা চক্র এখন আগের চেয়ে বেশী তৎপর। চোরাই কারবারী, ব্যবসায়ী প্রভৃতির ছদ্মবেশে ওরা ঢুকছে ভারতে। সংগ্রহ করছে গােপনীয় সংবাদ। এক শ্রেণীর ভারতীয় দিচ্ছে তাদের মদৎ। সম্প্রতি ধরা পড়েছে বেশ কিছু গুপ্তচর। জিজ্ঞাসাবাদের ফলে উঘাটিত হচ্ছে নূতন রহস্য। সম্প্রতি একদল সাংবাদিক ঘুরে এসেছেন এই দীর্ঘ সীমান্ত। দুর থেকে দেখেছেন তারা পাক সমর প্রস্তুতি। সীমান্ত অঞ্চলের ভারতীয় গ্রামবাসীরা লক্ষ্য করছেন ওপারে পাক সৈন্যদলের চাঞ্চল্যকর গতিবিধি। পাক যুদ্ধোন্মাদনার রহস্য ভেদ শক্ত কিছু নয়। ওটা হয়ত বাংলাদেশে ব্যাপক আক্রমণ আরম্ভের পূর্বাভাস। এ আক্রমণ যখন চলবে তখন হয়ত পশ্চিম সীমান্তে দানা বেধে উঠবে ইতস্তত সংঘর্ষ। সর্বাত্মক আক্রমণ হয়ত হবে না অদুর ভবিষ্যতে। আক্রমণের ভান করে হয়ত পাকসেনারা ব্যস্ত রাখবে ভারতীয় বাহিনীকে। এছাড়া আর একটি উদ্দেশ্যও আছে পাকিস্তানের মনে। নিউইয়র্কে চলছে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে সােরগােল। বৃটেন এবং আমেরিকা, পাক-ভারত লড়াই-এর সম্ভাবনা নিয়ে করছে মাতামাতি। এই মাতামাতি যত বাড়বে বাংলাদেশ সমস্যা তত চাপা পড়বে। শেষ পর্যন্ত এ সমস্যাটিকে দেখাবার চেষ্টা হবে পাক-ভারত বিরােধ হিসাবে। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের উপায় উদ্ভাবনের বদলে পাক-ভারতের হাত ধরে টানাটানি করবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল। পাঞ্জাব সীমান্তে তারই পরিবেশ সৃষ্টি করছে পাকিস্তান।
ইয়াহিয়ার গােপন মতলব যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হােক না কেন, পাকিস্তানের সমর প্রস্তুতি আজ বাস্তব। বাংলাদেশ হাতছাড়া হবার উপক্রম ঘটলে মরণকামড় দিতে তিনি হয়ত পিছুপা হবেন না। এ ক্ষেত্রে সর্তকতার প্রয়ােজন সবচেয়ে বেশী। স্পর্শকাতর রাজ্য কাশ্মীর। ১৯৬৫ সালে পাক বাহিনীর ছাম্ব আক্রমণ থেকেই সুরু হয়েছিল পাক-ভারত লড়াই। এবার যদি কোন অঘটন ঘটে তবে রেহাই পাবে না কাশ্মীর। এ অঞ্চলে তৈরী হবে অন্যতম প্রধান রণাঙ্গন। পাকিস্তানের অসুবিধা তার অন্তত পাঁচ ডিভিসন সৈন্য মােতায়েন রয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৬৫ সালের লড়াই থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল পূর্ব বাংলা। ভারতীয় বাহিনী ইচ্ছা করলে অনায়াসেই নিতে পারতেন ঢাকা। তা তারা করেন নি। পশ্চিমবাংলায় পাকবিমানের বােমাবাজীর বদলা নেন নি তারা পূর্ব বাংলায়। এবারের অবস্থা আলাদা। পাক হটকারিতার প্রথম উত্তরই হবে বাংলাদেশ। পাক-সৈন্যের কবর রচিত হবে সেখানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অগ্রগতি ঠেকাতে পারবে না কেউ। একথা মনে করা ভুল বাংলাদেশে ক’ ডিভিশন পাকসৈন্য মােতায়েন আছে বলেই পশ্চিম পাকসমরশক্তি দুর্বল। তার সৈন্য সংখ্যা এবং আঘাতের শক্তি গত ক’বছর বাড়ান হয়েছে ধাপে-ধাপে। গুপ্তচরদের সংগঠনও আগের চেয়ে বেশী জোরদার। কাশ্মীর তাদের অন্যতম প্রধান বিচরণ ভূমি। এখানে স্থানীয় পাকএজেন্টের সংখ্যাও কম নয়। আবদুল্লা এবং বেগ কোম্পানীর গােপন তৎপরতা প্রবল। ওরা নয়াদিল্লীতে নির্বাসিত, কিন্তু চেলা-চামুণ্ডার সক্রিয়। এ অবস্থায় জম্মু এবং কাশ্মীর কংগ্রেসের সাংগঠনিক ঐক্য একান্ত কাম্য। আশার কথা সাদিক মন্ত্রিসভায় যােগ দিয়েছেন সৈয়দ মীর কাশিম। তাতে হয়ত মিটবে কংগ্রেসের উপদলীয় কোন্দল। বক্সী গােলাম মহম্মদ ধরেছেন উল্টো সুর। তিনি চান সাদিক মন্ত্রিসভার অপসারণ। বেগ-আবদুল্লার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবীতেও তিনি সােচ্চার। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশেও বক্সী গােলাম মহম্মদ পঞ্চমুখ। কাশ্মীরের সামগ্রিক কল্যাণ এবং নিরাপত্তার বদলে ব্যক্তিগত রেষারেষিই সেখানে পাচ্ছে প্রাধান্য।সামনে উঁচিয়ে পাকিস্তানি সঙ্গীন। তা দেখেই ফিরে আসা উচিত নেতাদের সম্বিৎ। জাতির সংকটে স্থান নেই উপদলীয় কিংবা ব্যক্তিগত কোন্দলের।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ অক্টোবর ১৯৭১