বাংলাদেশ সমস্যায় মার্কিন ভাঁওতা
বাংলাদেশ সমস্যার মার্কিন সমাধান পাওয়া গেছে। দিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব উইলিয়ম রােজার্স। তার সমাধান সূত্র তিনটি-পাক-ভারত উপমহাদেশে সংযম রক্ষা, পূর্ববাংলায় দূর্ভিক্ষ নিবারণ এবং ভারতে আগত শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সম্প্রসারণ। সবশেষে পূর্ব বাংলার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সক্রিয় চেষ্টা। এটাই নাকি মার্কিন সরকারের নীতি। এ নীতি কার্যকর করাই নাকি তাদের মৌল লক্ষ্য। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে রােজার্সের বক্তৃতায় অবাক হননি কেউ। মার্কিন প্রশাসকরা মনে করেন, তাঁরা ভয়ানক চালাক। ওঁদের ভাওতা ধরে ফেলা অন্যের পক্ষে সহজ নয়। হাতেনাতে ধরা পড়লেও ক্ষতি নেই। টাকার জোরে বন্ধ করা যাবে সবার মুখ। ভারতে নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থী কেন এলেন-এই সহজ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব রােজার্স। তিনি যদি তার কারণ অনুসন্ধান করতেন তবে নিজের ফাকা বুলিতে নিজেই লজ্জিত হতেন। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া চালিয়েছেন গণহত্যা এবং প্রাণের দায়ে শরণার্থীরা এসেছেন ভারতে। আর এই নরঘাতীর দলই বারবার দিচ্ছে যুদ্ধের হুমকী। এ অবস্থায় সংযম কার দরকার? ভারতের না পাকিস্তানের? ভারতকে সংযমের উপদেশ দেবার অথ-ইয়াহিয়া খুশীমত শরণার্থী পাঠাবেন। মুখ বুজে ভারত তাদের সেবা করবে। ওদের প্রত্যাবর্তনের দাবী সে জানাবে না। জানালেই আসবে যুদ্ধের হুমকী। আর এ হুমকী এলেই পাক-ভারত উপমাহদেশে ঘটবে অশান্তি। সুতরাং উভয় রাষ্ট্রেরই দরকার সংযম।
এ ধরণের মার্কিন উপদেশ নূতন নয়। আগেও শােনা গেছে বহুবার। তবে এবারের উপদেশটা চমকপ্রদ। খুনী আসামী এবং মানবকল্যাব্রতীকে দাঁড় করানাে হয়েছে একই লাইনে। তারপর উভয়ের উপর পড়েছে। উপদেশের গুতাে। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ এবং উদ্বাস্তু সৃষ্টির জন্য দায়ী ইয়াহিয়া খান। তাঁকে শায়েস্তার দরকার নেই। কিন্তু তার সৃষ্ট ঝামেলার ঝুঁকি সামলাবে অন্যে। আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে সবাই ছুটবেন। ডাণ্ডাপিটা করবেন ইসলামাবাদ। আহতদের মুখে অন্ন দেবেন এবং পিঠে ব্যাণ্ডেজ বাধবেন গােটা দুনিয়া। এ দৃশ্য দেখলেই ভয়ডর থাকবে না শরণার্থীদের। ওরা তাড়াহুড়া করে ফিরবেন স্বদেশে। এ ব্যবস্থার ওলটপালট করা চলবে না। করলে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় নাক গলানাের অভিযােগ আসবে। রাজনীতিক্ষেত্রে বুজরুকীর অভাব নেই। কিন্তু মার্কিন বুজরুকী অসহ্য। ভারতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর অবস্থান যদি পাক-ভারত উপমহাদেশের সম্ভাব্য শান্তিভঙ্গের কারণ হয়ে থাকে তবে শরণার্থী স্রষ্টার হাত থেকে মারের ডাণ্ডাটা কেড়ে নিলেই তাে লেঠা চুকে যায়। ওটা কেড়ে নেওয়া দূরের কথা, মার্কিন কর্তারাই জোগাচ্ছেন ইয়াহিয়ার অস্ত্র। গত পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশে সুরু হয়েছে পাক-তাণ্ডব। জনমতের চাপে মার্কিন সরকার বলেছিলেন-আর অস্ত্র দেওয়া হবে না পাকিস্তানকে। সিনেটর কেনেডী হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গেছেন। প্রামাণ্যসূত্র থেকে তিনি বলেছেন, গত জুলাই মাসে চুড়ান্ত রূপ নিয়েছে পাক-মার্কিন অস্ত্র লেনদেনের চুক্তি। গােপন তথ্য উঘাটিত হওয়া সত্ত্বেও লজ্জার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না রােজার্সের মুখে। কোমর বেধে তিনি নিতে চাচ্ছেন শান্তির দুতের এবং মানবসেবীর ভূমিকা।
আমতা আমতা করে রােজার্স বলছেন-পূর্ববাংলা সমস্যার কার্যকর রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা দরকার। কে করবেন এই চেষ্টা? রাষ্ট্রসঙ্, না বাইরের দুনিয়া? রােজার্সের মতে সমস্যাটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাই যদি হয়, তবে অন্যে কি করে নাক গলাবেন তাতে? স্বভাবতই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এসে পড়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং ইসলামাবাদের উপর। এ দুটি সরকার এখন যুদ্ধরত। একপক্ষের চূড়ান্ত পরাজয় ছাড়া হবে না অস্ত্রসম্বরণ। ইয়াহিয়া জিতলে শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। ওরা হবেন ভারতের চিরস্থায়ী বােঝা। এ পরিণামের কথা ভাবতেও পারেন না নয়াদিল্লী। তাই তারা চান বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। তা হলেই শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন নিজেদের ফেলে আসা বাড়ীঘরে। জনাকয় কেনা-গােলামকে সামনে রেখে প্রশাসনিক কাঠামােতে চুনকাম করলে কখনই হবে না সমস্যার সমাধান। পাকিস্তান আজ দুভাগে বিভক্ত-একদিকে গণতান্ত্রিক শক্তি। এ শক্তির রূপ পেয়েছে বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনীর সংগ্রামী অভিযানে। অপরদিকে স্বৈরাচারী পশুবল। এর জীবন্ত প্রতিমূর্তি ইয়াহিয়া খান এবং ইসলামাবাদ। বিপরীতমুখী এ দুয়ের সংগ্রামে আমেরিকা কোন পক্ষে? সবাই জানেন স্বৈরাচারীর পক্ষে। ধানাইপানাই না করে সেকথা স্পষ্ট করে বললেই তাে পারেন উইলিয়ম রােজার্স। সৌদী আরব, ইরান প্রভৃতি মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রীরা তাে প্রকাশ্যেই বলেছেন সে-কথা। মাথা মুড়িয়ে তাদের দলে প্রকাশ্যেই ঢুকে পড়তে পারে আমেরিকা। গণতান্ত্রিক ঘােমটার নীচে খেমটা নাচের প্রয়ােজন নেই। ওটা পুরনাে ভাওতা। বর্তমান যুগে অচল।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৭ অক্টোবর ১৯৭১