You dont have javascript enabled! Please enable it!

চীন-ভারত বােঝাপড়া কি আসন্ন?

ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে প্রায় দু’মাস আগে। এর মধ্যে পাওয়া যায় নি চীন সরকারের প্রতিক্রিয়া। স্বার্থান্বেষী মহল অবিরাম প্রচার চালাচ্ছিলেন—এ চুক্তি চীনা-বিরােধী। নয়াদিল্লী এবং মস্কো বারবার বলেছেন-ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই নয়। যে কোন শান্তিকামী দেশের সঙ্গেই তারা এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনে ইচ্ছুক। তাদের কথায় কান দেয় নি কায়েমী স্বার্থবাদীরা। সম্প্রতি জানা গেছে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর অভিমত। পিকিং-এর ধারণা, ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি চীনা বিরােধী নয়। তারা ভারত এবং সােভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে আলাপ আলােচনায় রাজী। মনে হয়, চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে সুরু হয়েছে নবযুগ। চরম পথ থেকে তার পদক্ষেপ ঘটছে নরম পথে। চৌ এন লাই বলছেন-আলােচনা বৈঠক আরম্ভে চীনা ঔৎসুক্যের অর্থ এই নয় যে, সে ঢিলা দেবে সমর প্রস্তুতিতে। শক্তির ভিত্তিতে দাড়িয়ে চীন করবে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বােঝাপড়ার চেষ্টা। আর যদি সে আক্রান্ত হয় তবে তার মােকাবিলার জন্য তৈরী থাকবে সৈন্যবাহিনী। নিজের ভৌগােলিক সীমানা অক্ষুন্ন রাখাই চীনের মুখ্য উদ্দেশ্য। পররাজ্য গ্রাস তার মৌল নীতিবিরােধী।
চীনা প্রধানমন্ত্রী এ কথাগুলাে বলেছেন মার্কিন পর্যটকদের কাছে। এই পর্যটক দলে ছিলেন মার্কিন ব্ল্যাক প্যান্থার নেতা হুয়ে নিউটন এবং তার জনাকয় সহকর্মী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় সংগ্রাম বলতে পিকিং কি বুঝেন তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। তাঁর মতে, জাতীয় সংগ্রামের অর্থ শ্রেণীসংগ্রাম। তবে চীনের অভিমত কারও উপর জোর করে চাপিয়ে দেবার পক্ষপাতী নন পিকিং। এ ধরনের কথাবার্তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যুগে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলােতে সশস্ত্র বিপ্লবের উস্কানী দিত চীন। এখন হয়ত তাতে পড়বে ভাটা। ফলে গড়ে উঠবে পারস্পরিক বােঝাপড়ার অনুকূল ক্ষেত্র। শুধু কথা নয়, কাজের দ্বারা প্রমাণ করতে হবে চীনা আন্তরিকতা। সােভিয়েট রাশিয়া সম্পর্কে চৌ এন লাই খুবই স্পষ্ট। এ রাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে চীনের সীমান্ত বিরােধ। সংঘর্ষ ও হয়ে গেছে কবার। আবার উভয়ের মধ্যে চলছে শান্তি বৈঠক। মীমাংসার সূত্র বের করতে পারছে না কেউ। চৌ এন লাই বলছেন উনবিংশ শতাব্দীর আঞ্চলিক চুক্তিগুলাের ভিত্তিতে আপােষ-আলােচনা চালাতে চীন গররাজী নয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সীমান্ত খানিকটা রদবদল করে নিলেই হতে পারে একটা মীমাংসা। এর জবাব মস্কো কি দেবেন তা তারাই জানেন। সােভিয়েট রাশিয়া অমিত শক্তিধর রাষ্ট্র। শক্তির ভিত্তিতে আপােষ-আলােচনা চালাতে সে বেশী সক্ষম। মস্কোর স্ট্র্যাটিজী শুধু চীন সীমান্তে সীমাবদ্ধ নয়। গােটা দুনিয়া জুড়ে তা বিস্তৃত। চীন এবং আমেরিকা নিজেদের প্রভাবের আওতায় এশিয়া মহাদেশকে ভাগাভাগি করে নেবে-এমন ব্যবস্থায় কখনই সম্মতি দিবে না সােভিয়েট রাশিয়া। কারণ এ রাষ্ট্রটি সমভাবেই এশীয় এবং ইউরােপীয়। এশিয়ার রাজনৈতিক ঘটনাস্রোতের নীরব দর্শক হয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হ্যানয় সফররত সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পােদগর্ণি সরল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন, মস্কোর এশীয় নীতির।
ভারতের কথা আলাদা। দুনিয়ার কোন অঞ্চলে সে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযােগী নয়। চীনের সঙ্গে তার সীমান্ত সংঘর্ষ মাত্র আট বছরের আগের ঘটনা। “হিন্দী-চীনী ভাই ভাই” এর ভাবালুতার পর এ ধরণের সংঘর্ষ প্রত্যাশা করে নি ভারত। পুরানাে দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা শ্ৰীমতী গান্ধীর বাস্তব বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে ফেলে নি। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যুগে শত চীনা উস্কানী সত্ত্বেও নয়াদিল্লী সযত্নে রক্ষা করেছেন বাংযম। আন্ত রিকভাবেই নয়াদিল্লী চীনের সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনে ইচ্ছুক। ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি দুটি সার্বভােম রাষ্ট্রের নিজস্ব সমঝােতা। তার তাৎপর্য অন্য রাষ্ট্রকে গায়ে পড়ে বােঝাবার দরকার ছিল না তাদের ! চীন যাতে ভুল না বুঝে তার জন্য ভারতের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ওটা দুর্বলতা নয় প্রতিবেশীর প্রতি সদিচ্ছার প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী একাধিকবার দিল্লী-পিকিং আলােচনা আরম্ভের যৌক্তিকতা স্বীকার করেছেন। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রদুত পর্যায়ের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনেও তিনি রাজী। এতদিন পরে মুখ খুলেছেন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। তার নরম সুর আশা জাগিয়ে তুলেছে সবার মনে। এখন দরকার সতর্ক কূটনৈতিক তৎপরতা, এ পাঁয়তাড়া দীর্ঘস্থায়ী হলেও ক্ষতি নেই। শান্তির পথ মসৃণ নয় বন্ধুর। এর সার্থক সমাপ্তি সবার কাম্য। কারণ, তার উইরই নির্ভর করছে এশিয়ার শান্তি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ অক্টোবর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!