কর্তাদের বােধন কবে হবে?
একদিকে নদনদীর বন্যা আর একদিকে বাংলাদেশ থেকে আসা নিরুপায় অত্যাচারিত উদ্বাস্তুদের বন্যা পশ্চিমবঙ্গকে এই দুই বন্যা ডুবিয়ে দিয়েছে। এই দুই দুর্বিপাকে পশ্চিমবঙ্গ কেমন করে বাঁচবে সেভাবনায় আজ সবই ইকুল। এই ভয়ঙ্কর দুর্বিপাক থেকে সকলকে তুলে ধরার, সকলকে বাঁচানাের বিশাল কাজটা দেশের দু-চার দশজন হিতৈষীর দ্বার সম্ভব নয়, রাষ্ট্রকেই তার সমস্ত শক্তি সম্পদ দিয়ে মােকাবিল করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র আশ্বাসের প্রতিশ্রুতির প্রলেপ দিতে কখনও যে পশ্চাতপদ, তাদের ঘােরতর শত্রুও এমন কথা বলবে না। এক্ষেত্রেও তারা দুই ভয়ঙ্কর বন্যার সঙ্গে তাল রেখে খুবই আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি সর্বদা ঢালছেন। কিন্তু সে-সব কতখানি বাস্তব চেঞার নিচ্ছে, তা দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পচ্ছে। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য অনেক দরদী বিদেশী রাষ্ট্র কিছু সাহায্য পাঠাচ্ছেন বলে তবু কিছু যা হােক রক্ষা। কিন্তু নদ-নদীর বন্যায় প্লাবিত অঞ্চলে এবং যে-বন্যার জন্য শুধু প্রাকৃতিক অতিশয্যের উপর দায় না। চাপিয়ে আমাদের রাষ্ট্রের চরম ঔদাসীন্য কর্তব্যহানিরই অনিবার্য পনিণতি বলে সকলে ভাবছে, সেখানেও রাষ্ট্রের কর্তাদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সমতুল্য মােকাবিলার ব্যবস্থা কত সামান্য, কত অনিয়মিত কত বিলম্বিত তা লক্ষ লক্ষ নিরুপায় মানুষ চোখের উপর দেখছে। এ-নিয়ে কতনা অভিযােগ, কত না ক্ষোভ সর্ব, কিন্তু কর্তাদের নিদ্রার ব্যাঘাত হচ্ছে না। বন্যাপ্লাবিত মানুষদের সঙ্গে আজ অন্যান্য মানুষদেরও দৈনন্দিন খাওয়া-পরার সঙ্কটও কী ভয়ঙ্কর চেহা’র না নিয়েছে। একে হাজার হাজার সংসার বেকারিতে দারিদ্রে ভেবে অনটনে বিপর্যস্ত। তার ওপরে অভূত পূর্ব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দুরমুস তাদের ঘাড়ে এসে দমাদ্দম পড়ছে। তাদের ঘাড় থেকে সেই দুরমুসটা একটু সরবার মত কোনও হাত নেই আশ্চর্য।
প্রতি বছরেই বর্ষার মরশুমে আনাজপত্রের দাম কিছু বাড়ে। কিন্তু এবার আগেকার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। আলু বেগুন পটল ঝিঙে উচ্ছে ঢ্যাড়স শাকপাতা-সাধারণ বাঙালীর দৈনন্দিন সামান্য খাবারে আজ তাদের ক-জন হাত ঠেকাতে পারে? আড়াই টাকার বেগুন তিন টাকার পটল দেড় টাকা ঝিংের, তিন টাকার উচ্ছে, এক টাকার আলু, ছ টাকার সরষে তেল কিলাে-পিছু এই দামে প্রতিদিনের সামান্য নিরামিষ আহারটুকুই সংগ্রহ করার ক্ষমতা আজ কতজন মানুষের আছে? মাছ মাংস ডিম দুধের কথা দূরে থাক। ওরা মাধরষ মানুষের নাগালের বাইরে অনেকদিন চলে গেছে। অনেককাল পরে এবার ইলিশের কয়েকদিনের প্রচুর্যে কিছু লােক হয়তাে পাঁচ-ছ টাকা কিলােয় ইলিশ পেয়েছে। কিন্তু তাই বা কজন কিনেছে? দৈনন্দিন আনাজপত্রের সঙ্গে ডাল-কড়াই মসলা-পাতির সবারই দাম চড়া। অতত্রব শুধু খাবারটুকু সংগ্রহ করা আর কতজনে র সাধ্যের মধ্যে আছে?
এর ওপরে সামনে পুজো। উৎসব তাে নয় মহাবিপদ দৈনন্দিন আহারের এই অগ্নিমূয়ল্য নিয়ে বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসবে স্ত্রী-পুত্র পরিবারের জন্য পােষাক-পরিচ্ছদ সংগ্রহের দায়ের কথাটাও ভাবুন ওট তাে হাজার হাজর সংসারে উৎসবের সজ্জা কেনা নয়, সার বছরের স্রেফ লজ্জা-নিবারণের ব্যবস্থাটুকু করা। সেই ব্যবস্থা করা এই ভয়ঙ্কর ম.ি…র বাজারে কতজনের পক্ষে সম্ভব? এইসব প্রশ্নের সদুত্তর কোথায় কে দেবে? সবচেয়ে আফশােষের কথা আমাদের রাষ্ট্রের কর্তারা সবাই যােগনিদ্রায় সমাচছন্ন। বন্যার প্লাবনে কতখানি, আর হটেবাজারে মুনাফালােভী আড়তদারদের ব্যবসাদারদের ফড়েদের নষ্টামিতে কতখানি এ ভয়ঙ্কর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তার খবর আমাদের রাষ্ট্রের কর্তারা জেনেও না-জানার ভাণ করে ঘুমিয়ে আছে অকাল-বােধনের উৎসবে মা-দুর্গার ঘুম হয়তাে ভাঙবে কিন্তু ঐ জেগে-ঘুমিয়ে থাকা, কর্তব্য-ভ্রষ্ট, আপদার্থ রাষ্ট্রীয় কর্তাদের কেমন কে’র অকাল-বােধন হবে সেটাই মহাভাবনার কথা নয় কি?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১