You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.17 | ইরানের মধ্যস্থতার সখ | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইরানের মধ্যস্থতার সখ

বাংলাদেশ নিয়ে নাকি চলছে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিরােধ। ইরান তাদের মধ্যে মধ্যস্থায় রাজী। ভারত পাত্তা দিচ্ছে না বলেই সে এগুতে পারছে না আশা ছাড়েন নি ইরানের শাহ্ বাদশাকে নাকি শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না ইয়াহিয়া খান। নয়াদিল্লীর সঙ্গে একটা বােঝাপড়া করিয়ে দেবার জন্য তিনি নাকি ইরানী বাশার হাতে-পায়ে ধরছেন। তাই মধ্যস্থার প্রস্তাবটি একবার ডবছে, আবার ভাসছে। বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে ডুবা-ভাসার খেল মাত্র কদিন আগে ইয়াহিয়া খান গিয়ে ছিলেন ইরান সফরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলােচনা করে ফিরে এসেছেন ইসলামাবাদে। যুক্ত ইস্তাহার গতানুগতিক। আলােচনার গােপন অংশটি প্রকাশিত না হবারই কথা। ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক। হৃদ্যতা বলতে য বােঝায় তার সঙ্গে তা নেই। ঐশলামিক ব্লকের সদস্য ইরান। পাকিস্তানের প্রণের দোস্ত সে। যখনই দেখা গেছে পাক-ভারত বিরােধ তখনই সে নীরবে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের পাশে। ভারত-বিরােধী জেহাদে তার অবদানের নজির বড় কম নয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত লড়াইএ ইরান করেছিল পাকিস্তানকে সমর্থন। তার দৃষ্টিতে ভারত ছিল আক্রমণকারী। যুদ্ধের পর অস্ত্রের খোঁজে গােটা বিশব তছনছ করে বেড়াচ্ছিলেন ইসলামাদ। বাঁকা পথে শখনেক মার্কিন জঙ্গ বিমান ইরান পাঠিয়েছিল পাকিস্তানে। ঘটনাটি জানাজানি হবার পর এগুলাে ফেরত নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইরানী সরকার। বিমানগুলাে সাত্যিই ফেরত গেছে কিনা তা বিশ্বাসযােগ্য খবর এখনও অজানা। ইরানকে অঢেল অস্ত্র দিচ্ছে বৃটেন এবং আমেরিকা। ১৯৭৫ সালের মধ্যে সে হবে পশ্চিম অশিয়ার শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি। সুয়েজের পূর্বাঞ্চল থেকে বৃটিশ বাচিনীর অপসারণের পর সেই সামলাবে এ অঞ্চল। পাকিস্তান হবে তার সহযােগী।
পশ্চিমা দুনিয়ার একান্ত বিশ্বসভাজন ইরান। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আরবের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পিছু পা হননি ইরানের শাহ। ১৯৬৭ সালে আরব-ইস্রাইল লড়াই-এর সময় আরবের তৈল-রাষ্ট্রগুলাে বন্ধ করে দিয়েছিল ইউরােপে তৈল সরবরাহ। তৈল বঞ্চিত রাষ্ট্রগুলােকে অতিরিক্ত তৈলদানের ব্যবস্থা করেছিল ইরান। জাতীয়তাবাদী আরবেরা তখন শাহকে বলতেন, বিশ্ব সঘাতক। এই ইরানের দোসর পাকিস্তান বিশ্বাসঘাতকতায় সেও কম যায় না। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদী আরবের মাধ্যমে সে নিয়েছিল রাজতন্ত্রীদের পক্ষ। ১৯৭০ সালে জর্ডানে রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে আরব গেরিলাদের লড়াই এর সময় রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল পাক-সৈন্যরা। ওদের কজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল আম্মানের পথে। জর্ডান বাহিনীর সামরিক শিক্ষাদাতা এবং বাদশা হুসেনের মুখ্য উপদেষ্টারা পাকিস্তানি জর্ডান, ইরান, পাকিস্তান এবং সৌদী আসবের গােপন আঁতাত আজ প্রায় সবারই জানা। যেসব মার্কিন এবং বৃটিশ অস্ত্র যাচ্ছে ইরানে তার খানিকটা পাকিস্তানে পাড়ি জমাচ্ছে কিনা তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। ইরানী অর্থ যে পাকজঙ্গীশাসকরা পাচ্ছেন সে-সম্পর্কে সন্দেহ নেই কারও। ওটা এখন স্বীকৃত ঘটনা। এ অবস্থায় কোন পাকভারত বিরােধ মধ্যস্থতার নৈতিক অধিকার নেই ইরানের।
বাংলাদেশ সমস্যাটা পাক-ভারত বিরােধের বিষয়বস্তু নয়। এ সম্পর্কে কথা বলার এক্তিয়ার আছে শুধু স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের। ভারতে এসে পড়েছেন পচাশী লক্ষাধিক শরণার্থী। তাঁদের আগমনের বিরাম নেই। এসব মানুষ যাতে নিরাপত্তা এবং নাগরিক মর্যাদা বােধ নিয়ে স্বদেশে ফিরতে পারেন তার জন্যই নয়াদিল্লীর যত মাথা ব্যাথা। স্বাথীন সরকার ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন পূর্ব বাংলা থেকে পাক বাহিনীর সমূল উচ্ছেদের আগে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অসম্ভব। যারা ফিরবেন এটা তাদেরও মনের কথা। যদি মধ্যস্থতা করতে চায় ইরান তবে ইসলামাবাদ এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেই তার তা করা উচিত। পূর্ব বাংলার গণহত্যার প্রথম পর্যায়ে ইয়াহিয়া বলতেন—বাংলাদেশ শান্ত। শরণার্থীদের অধিকাংশ ভারতের ফুটপাতের বাসিন্দা বিশ্বের দরবারে পাকিস্তানকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নয়াদিল্লী তাদের সাজিয়ে রেখেছেন সীমান্তের আশ্রয় শিবিরগুলােতে। আসল পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নিতে তিনি রাজী। মুক্তিবাহিনীর মারের চোটে এবং আর্থিক কাঠামােতে কাপুনী লাগার ফলে পাক প্রচারের ভােল পাস্টাল কদিন পরেই। সব শরণার্থীকেই ফিরিয়ে নিতে রাজী ইয়াহিয়া খান। কিন্তু বাগড় দিচ্ছে ভারত। এটাই পাক-ভারত বিরে মূল কথা। তার জন্যই দরকার মধ্যস্থতা। এগিয়ে এলেন ঐশলামিক সংস্থার সেক্রেটরী জেনারেল টুঙ্কু আবদুল রহমান। একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে তিনি আসতে চাইলেন ভারতে। পাত্তা পেলেন না। অগত্যা তাকে আসতে হল মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে। ফিরে গিয়েই তিনি বিবৃতি দিলেন—আর কমাস কাটতে দাও। আর্থিক চাপে নতি স্বীকার করবে ভারত। দায়ে পড়ে সে ঠেলে পাঠাবে শরণার্থীদের। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান না হলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি জোর করে কাউকে ঠেলে দেবেন না জল্লাদের মুখে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আজ বাস্তব। আরও বাস্তব মুক্তি বাহিনীর প্রচণ্ড মার। স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা সংশয়াতীত। ভরাডুবী এড়াবার জন্য ইয়াহিয়ার দরকার একজন বিশ্বস্ত মধ্যস্থ। টুঙ্কু ব্যর্থ, কিন্তু ইরানের শাহ চালু। তাঁকে দিয়েই কাজ হাসিল করা দরকার। তিনিই আপাতত: তাঁর একমাত্র বন্ধু যিনি কৌশলে বাংলদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধ বলে জাহির করতে পারবেন এ খপ্পরে অবশ্যই পা দেবে না ভারত। টুঙ্কুর দশা দেখে নিরস্ত্র হােন ইরানের শাহ। ডুবন্ত দোস্তকে কখনই টেনে তুলতে পারবেন না তিনি চক্ৰন্তকারীদের কেউ ভারতের জনসাধারনের অচেনা নয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১