আসামে পাক নাশকতা
পকিস্তানের চদিমারি ত্রিপুরা। এই রাজ্যটিকে অবশিষ্ট ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সােজা। সীমান্তের কাছ দিয়ে চলে গেছে রেলপথ। ওপার থেকে নাশকদল এসে এ পথটি অল্পায়াসেই এসে উড়িয়ে দিতে পারে। গত বুধবার রাত্রে ঘটেছে তাই। করিমগঞ্জ থেক ছিল ধর্মনগরগামী একটি ট্রেন। দূর সিগনালের কাছাকাছি জায়গায় রেল লাইনের নিচে পোঁতা ছিল একটি প্লাসটিক বােমা। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে লাইনচ্যুত হয় গাড়ী। হতাহতের সংখ্যা সতের জন। গত ক’মাস ধরেই আসাম এবং ত্রিপুরার উপর চলছে পাক নাশক দলের আক্রমণ। হামেশাই রেল লাইনের উপর পাওয়া যাচ্ছে বােমা। রেল কর্মিরা এবং সৈন্যদল সতর্ক। তাই দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে অনেকগুলাে ট্রেন। চঞ্চল হয়ে উঠেছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রের কাছে তিনি আরও চেয়েছেন সি আর পি। সীমান্ত রক্ষীদলের শক্তিবৃদ্ধির দাবীও জানিয়েছেন তিনি। গােটা রাজ্যে পাকচক্রীরা ছড়াচ্ছে গুজব। তার প্রতিকারের জন্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী সীমান্তে জোরালাে বেতারযন্ত্র বসাবার পক্ষপাতী। তাঁর মতামতের যৌক্তিকতা অনস্বিকার্য। এসব ব্যবস্থা গতানুগতিক প্রতিরােধ পর্যায়ভুক্ত। সমস্যাটা আরও জটিল।
আসাম পাক-গুপ্তচরদের আনাগােনা দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি তাদের সংখ্যা বেড়েছে। শরণার্থীর ছদ্মবেশে অনেকেই ঢুকেছে আসামে এবং ত্রিপুরায়। তাদের বেছে বার করা মুশকিল। বেশি কড়কিড়ি করতে গেলে চেচামেচি শুরু হবে চারদিকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠবে সাম্প্রদায়ীকতার প্রশ্ন। বহিরাগত বিতাড়ন নিয়ে এসময় কঠোর সমালােচনার মুখে পড়েছিলেন আসাম সরকার। একথা সত্য যে, স্থানীয় অদিবাসীদের একাংশের সহয়ােগীতা না পেলে সাশক দলের নাশকবৃত্তি চলানাে সহয নয়। কাশ্মীরে দেখা গেছে পাক প্রেমিকেরা আড়াল করে রাখে গুপ্তচরদের। এদের সমর্থকদের শাখা শাখা প্রশাসন দপ্তরের উঁচু মহল পর্যন্ত প্রসারিত। আসামে এতটা না হলেও ওখানে পাকপ্রেমীকের অভাব নেই। ওদের গােপন মদৎ পায় পাকিস্তানি দুশমনরা। এই শ্রেনীর দেশদ্রহী রয়েছে রয়েছে কমবেশী সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই। টাকার লােভে দেশকে বিলিয়ে দিতেও তারা রাজী। বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা যত বাড়বে আসাম এবং ত্রিপুরায় পাকনাশকদলও তত সক্রীয় হয়ে উঠবে। মুক্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী হামেশাই মােকাবিলা করছেন ইয়হিয়ার ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে। দেশ এবং স্বজনদ্রহীতার খেসারত ও দিতে হচ্ছে তাদের। তবু ওদের নষ্টামী থেকে রেহাই পাচ্ছে না বাংলাদেশ সরকার। ইসলামাবাদের সঙ্গে যুদ্ধরত এ সরকার। পাক এজেন্ট উচ্ছেদে এরা যতটা কঠোর হতে পারেন ততটা পারেন না আসাম এবং ত্রিপুরা সরকার। বাংলাদেশে এসব দুষ্কৃতকারীর কার্যকলাপ অনেকখানি প্রকাশ্য; কিন্তু ভারতে তা গুপ্ত। শুধুমাত্র সন্দেহের বশে কোন ভারতীয় নাগরিক যাতে হয়রানি না হােন সে-দিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি সজাগ। তার উপর ভারতে চালু রয়েছে আইনের শাসন। সন্দেহভাজন ব্যক্তিও আইনের রন্ধ্রপথে বেরিয়ে আসতে সক্ষম। সুতরাং আগাছা বাছার কাজ বড়ই ঝঞ্জাটে। ভারতের এ অঞ্চলের সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। যুদ্ধের সময় এই সীমান্ত অঞ্চলই হবে শত্রুর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। দুর্বল যােগাযােগের উপর প্রথম আগাত হানবে বৈরীপক্ষ। অবরুদ্ধ অবস্থায় রেখে তাকে পিশে মারার চেষ্টা করবে সে।
সবচেয়ে দুর্বল ব্যুহ ত্রিপুরা। তার ভৌগলিক অবসস্থান প্রতিরক্ষার একটি জটিল সমস্যা। আপতকালে তার যােগাযােগ ব্যবস্থা বজায় রাখা মুস্কিল। আগামী দিনগুলাে খুবই উদ্বেগজনক। মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতীর সঙ্গে সঙ্গে বেপরােয়া হয়ে উঠবে পাকিস্তান। বসার পর মুক্ত অঞ্চলের উপর জোরদার আক্রমণের পরিকল্পনাও নাকি তার তৈরী। সম্ভাব্য অগঠনের মােকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে ভারতকে। যদি ইয়াহিয়ার মাথায় উন্মাদের রােখ চাপে তবে তিনি প্রতমেই বিচ্ছিন্ন করতে চাইবেন ত্রিপুরাকে। তারপর আসামের সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের যােগাযােগ ব্যবস্থা বেঙ্গে ফেলার উদ্যমে হাত দেবেন। ত্রিপুরা রক্ষার জন্য অন্ততঃ মাস তিনেকেরে রসদ এবং অতিরিক্ত সৈন্যদল মজুত রাখা দরকার। পাকিস্তান যদি ভারত আক্রমণের দুঃসাহস দেখায় তবে দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ববাংলা খসে পড়বে ইসলামাবাদের থাবা থেকে। অবরুদ্ধ ত্রিপুরা মুক্ত হবে সঙ্গে সঙ্গেই। ওখানে সাময়িকভাবে পাকধ্বজা উড়াবার সুযােগ পাবেন না ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও সংগ্রামেরও সমাপ্তি ঘটবে পক্ষকালের মধ্যে। ইসলামাবাদের হঠকারিতাই ত্বরানিকত করবে তার স্বাধীনতা। সামরিক আদমী ইয়াহিয়া খান। সামরিক বাস্তববােধ তার অবশ্যই আছে। এ পথে তিনি পা দেবেন বলে মনে হয়না। তাঁর মাথার উপর ঝুলছে ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তির খাড়া। তিনি জানেন হাড়ি কাঠে মাথা গলানাে চরম মূর্খতা। যুদ্ধের চেয়ে নাশকদলকেই অধিকতর সক্রিয় করে তুলবে। পাকিস্তান। এটা হবে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান সামরিক অগ্রগতীর প্রতিশােধ। ইসলামাবাদের ধারণা, মুক্তিবাহিনী ভারতের সাহায্যপুষ্ট। নয়াদিল্লীর আস্কারা পেয়েই মারের চোটে তারা অস্থির করে তুলছেন দখলদার পাক-বাহিনীকে। গায়ের জ্বালা মিটাবার জন্যই পাকিস্তান ব্ৰিত রাখবে ভারতকে। নাশকদল তার হাতিয়ার। এর ব্যবহার চলবে ব্যাপকভাবে। এ অবস্থায় কঠোর না হয়ে উপায় নেই। রাষ্ট্রের নািপত্তার জন্যই ওটা দরকার। যারা পাক-নাশকদলকে আশ্রয় এবং মদৎ দেবে তারা দেশের শত্রু। চরম শাস্তি তাদের প্রাপ্য। জীতীয় সংকটে জনসাধারণের দায়িত্ব বড় কম নয়। সন্দেহভাজনদের ধরিয়ে দেওয়া তাদের রাষ্ট্রিয় কর্তব্য। এ কর্তব্যে অবহেলার অর্থ ভারতের নিরাপত্তা বিপন্ন করে তােলা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১