You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.19 | ডাঃ মালিকের সংসার | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ডাঃ মালিকের সংসার

সংসার পাতিলেন ডাঃ মালিক। গড়লেন দশজনের মন্ত্রীসভা। নামে মন্ত্রীসভা, কাজে ইয়াহিয়ার তাবেদারী। একজন আবার শপথ নিতে পারেন নি। কেন পারলেন না, তার কারণ অজানা। হয়ত মরণকালে ইষ্টনাম জগতে তিনি নারাজ। মার্শাল ল এখনাে চালু। অসামরিক মন্ত্রীসভার ক্ষমতাই বা কতটুকু? সামরিক শাসনের উপর দরকার অসামরিক কাটিং। নইলে ইজ্জত থাকে না ইয়াহিয়া খানের। গত আটাশে জুনের বেতার বক্তৃতায় অসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তিনি প্রতিশ্রুত। এই প্রতিশ্রুতিরই কার্যকর রূপ -পূর্ব বাংলার গবর্নর পদে ডাঃ মালিকের আবির্ভাব। বেছে বেছে বাল লােক বার করেছিলেন ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশে তার প্রয়ােজন ছিল একজন ভাড়াটিয়ার। এদের সংখ্যা সেখানে খুবই কম। প্রতিযােগীতা সামান্য। বেশী বেগ পেতে হয়নি ডাঃ মালিকের। তার গলার বাধা ম্যাজিক সুতাে৷ ওঠা ধরে আছেন খেলােয়াড় ইয়াহিয়া। পুতুল রাজাকে নামিয়েছেন তিনি আসরে। কর্তার টানে নাচছেন পুতুল। দর্শকের সংখ্যা খুবই কম। সেদিন চুয়ডাঙ্গায় দেখান হয়েছিল খেল। রঙ্গমঞ্চ একেবারেই ফাঁকা। গ্রামাঞ্চলে ঝেটিয়ে মাত্র শ’দুই লােককে জড় করেছিল পাকসৈন্যরা। তাতে মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন মালিক সহেব। বাংলাদেশে পুতুল নাচের দর্শকের বড় অভাব। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে দুজন দলছুট। আর প্রায় সবই হেরাে নেতা। গত নির্বাচনে পিজরাপােলে তাদের ফেলে দিয়েছিলেন জনসাধারণ। সেখান থেকে অনাথদের কুড়িয়ে এনেছেন। ডাঃ মালিক। ইসলামাবাদের বড় কর্তা বুকের ঠোক্করে করেছেন অনুমােদন। বান্দা মালিককে আর পায় কে? ব্যবস্থাটা নাকি সাময়িক। নির্বাচিত প্রতিনিধরা আসরে নামলেই সরে যাবেন পুতুলের দল। মানুষ নেবেন রঙ্গমঞ্চ। অমানুষদের বড় ভয় মানুষ। ইয়াহিয়া নিজে অমানুষ। মানুষকে ক্ষমতা দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব। পূর্ব বাংলায় নির্বাচন আকাশকুসুম কল্পনা।
ঘরশত্রু বিভীষন। প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে এরা সাংঘাতিক। বাইরের শত্রু আঘাত হানে সামনের দিক থেকে। আর বিভীষনের দল ছুরি চালায় পেছন থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার অবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন। মুক্তিবাহিনীর মার সমভাবেই পড়ছে পাকসৈন্য এবং তাদের স্থানীয় সহযােগীদের উপর। অনেক রাজাকার নাকি এখন ভেল পাল্টাতে ব্যস্ত। মারের চোট যত বাড়বে ভােল পাল্টাবার ব্যস্ততা তত বেশী দেখা দেবে। তা স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের পাক অধিকৃত অঞ্চলের প্রশাসন ব্যবস্থার এই বাহ্যিক পরিবর্তন আনবে হরেক রকমের জাটিলতা। বড় গলায় বলবেন ইসলামাবাদ পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা শান্ত। অসামরিক শাসন ব্যবস্থা তার প্রমাণ। শরণার্থীরা নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে পারেন স্বদেশে। ডাঃ মালিক ও আহ্বান জানিয়েছেন তাদের। বাইরের দুনিয়াকে ধোকা দেবার জন্যে জুটবে নতুন হাতিয়ার। পাক দোস্তরা সরােগােল তুলবে। সঙ্গে সঙ্গে হাই তুলে তুড়ি দেবেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। রাষ্ট্রসঙ্ঘে হয়ত উঠবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ সেখানে জলঘােলা হবে অনেক। প্রচারের নতুন অস্ত্র নেবে পাকিস্তান। তাতে গাবড়াবার কিছু নেই। একটা জাতীর জীবন মরণ সংগ্রামের সময় জঙ্গীশাসকরা সব সময় খুঁজে বার করেন বিভীষনদের। তাতে শেষ রক্ষা হয় না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে অধিকৃত এলাকার পুতুল নাচ দেখিয়েছিলেন হিটলার এবং মুসােলিনী। পরে খেলােয়াড়দের সঙ্গে গুড়াে হয়েছিল পুতুলের মাথাগুলাে। বাংলাদেশেও ঘটবে এই ঐতিহাসিক ঘটণার পুনরাবৃত্তি। মুক্তিবাহিনীর বিজয় সম্পর্কে নেই কারাে সংশয়। গােটা জাতী যেখানে রক্তস্নাত এবং সংকল্পবদ্ধ। মুষ্টিমেয় ভাড়াটিয়া সেখানে পথচুলার শুধু জঞ্জাল।
যেসব রাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক পঁয়তারা তাদের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক সমাধান বলতে তারা বুঝেছে- জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা অর্পন। এ সম্পর্কে ভারতের বক্তব্য স্পষ্ট। তার দায়িত্বের বােঝাও সবার চাইতে বেশী। পঁচাশী লক্ষের কোঠা ছাড়িয়ে গেছে শরণার্থীর সংখ্যা। ওদের আসার বিরাম নেই। প্রতিদিন খরচ হচ্ছে প্রায় তিন কোটি টাকা। বাইরের সাহায্য নগণ্য। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ও’দের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অবশ্যকাম্য। ইয়াহিয়া যাদের কাছে আংশিক ক্ষমতা অর্পনের ভান করছেন তারা কারা? কাউন্সিল অফ মুসলীম লীগ কনভেনশন মুসলিম লীগ, জমিয়তেই-ইসলামী প্রভৃতি দর্মান্ধ সামপ্রদায়িক দলের পান্ডা। পাক-সৈন্যদের সহযােগীতায় ওরাই জ্বালিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, পাইকারী হারে করেছে নরহত্যা, নারী ধর্ষন এবং লুণ্ঠন। শরণার্থীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছে নিজেদের সমর্থকদের মধ্যে। এদের খপ্পরে পা দেবেন কোন শরণার্থী? সমস্যা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। দিন দিন বাড়বে আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা। ইয়াহিয়ার ধূর্তামীর একমাত্র উত্তর-মুক্তিবাহিনীর সংগ্রামের তীব্রতা বাড়িয়ে তােলা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা।তা না হলে শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। এই মহাব্রত উদযাপনের জন্যই সরকার ডাঃ মারিকের পাতা সংসার ছারখার করে ফেলা। বাংলাদেশে এসব বিভীষণের অস্তিত্ব জাতীয় কলঙ্ক। জাতীদ্রোহীদের রক্তেই এ কলঙ্কের অপনােদন কাম্য। মুক্তিবাহিনীর সামনে সময় পরীক্ষা অপেক্ষামাণ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১