You dont have javascript enabled! Please enable it!

উ থান্টের বিলম্বিত উপলব্ধি

এক ইঞ্চি রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট। এই পথটুকু পাড়ি দিতে তার সময় লেগেছে ছমাস। প্রথমে তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। তাতে নাক গলাবে না র আর শরণার্থী সমস্যাটা আন্তর্জাতিক। ওদেরর ভরণপােষনের দায়িত্ব গােটা বিশ্বের। এখন মতটা একটু পাল্টিয়েছে। তিনটি ভাগে বাংলাদেশ সমস্যা ভাগ করেছেন উ থান্ট পূর্ব বাংলার লড়াই পাকি পর ঘরােয়া ব্যাপার, শরণার্থী সমস্যা আন্তর্জাতিক এবং তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তণের সমস্যা কনকারেন্ট অর্থাৎ ঘরােয়া এবং আন্তর্জাতিক। শরণার্থাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তণের পথ সুগম করা আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। অথচ পাকিস্ত ানের ঘরােয়া সমস্যা বাংলাদেশের লড়াই। ওটা না থামলে দুর্ভাগারা ফিরতে পারবেন না নিজেদের বাড়ী ঘরে। তার জন্য উ থান্টের সুপারিশপারস্পরিক বােঝাপড়া এবং মানবিক নীতির ভিত্তিতে পূর্ববাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। প্রস্তাবিত বােঝাপড়ার পক্ষগুলাে কারা – এ সম্পর্কে রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল নীরব। ইসলামাকাদের মতে, বাংলাদেশ শান্ত। সেখানে ধাপে ধাপে প্রতিষ্টিত হতে চলেছে। অসামরিক শাসন। শরণার্থীরা অনায়াসেই ফিরে আসতে পারে স্বদেশে। কিন্তু বাগড়া দিচ্ছে ভারত। তবে অপপ্রচারের জন্য তারা ফিরছেন না পূর্ব পাকিস্তানে। ভারতের বক্তব্য আলাদা। ভাগ্যহীন মানুষগুলাে নিজেদের দেশে জঙ্গী শাসকদের দ্বারা নির্যাতীত। প্রাণের দায়ে তারা আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। মানবিক কারণেই কোন সভ্য রাষ্ট্রজোর করে ঠেলে দিতে পারেনা নেকড়ের মুখে। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাদে ক্ষমতা এলেই শরণার্থীদের মনে জাগবে নিরাপত্তা বােধ। তখন তারা ফিরবেন স্বদেশে। বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এরাই সসম্মানে ফিরিয়ে নিতে পারেন শরণার্থীদের। এই অবস্থায় উ থান্টের প্রস্তাবিত বােঝাপড়ার শরিক হওয়া উচিত বাংলাদেশ সরকার এবং ইসলামাবাদ।
শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তণে আগ্রহী উ থান্ট। ইয়াহিয়া খান তাঁদের ফিরে আসা জন্য আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু মেলেনি কোন সাড়া।এসব কথা স্বীকার করেছেন রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল। তিনি বলেছেন পূর্ব-বাংরার লড়াই এবং বিপর্যস্ত আইন ও শৃঙ্খলা এর জন্য দায়ী। এ অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠায় ইয়াহিয়ার উদ্যম ব্যর্থ। এই সত্য কথাটি গােপন রাখেন নি উ থান্ট। তিনি আশঙ্কা করেছেন -শীৰ্গই পূর্ব বাংলায় দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ। পর্যাপ্ত সাহায্যের ব্যবস্থা না হলে বাড়বে জনগণের দূর্গতি। রাজনৈতিক অবস্তার উন্নতি ছাড়া ত্রাণ কার্য অসম্ভব। এ দিকে অবস্থার উন্নতির নেই কোন লক্ষণ ! বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের সমূল উচ্ছেদ মুক্তিবাহিনীর চরম লক্ষ্য। তার আগে অস্ত্র সম্বরণ করবেন না তাঁরা। যে কোন উপায়ে মাটি কামড়ে থাকতে ইয়াহিয়া খান দৃড় সংকল্প। তার জন্য ছল চাতুরী এবং গণহত্যা-সব পথই নেবেন তিনি। অদূর ভবিষ্যতে সংগ্রাম বিরতির নেই কোন সম্ভাবনা। বছরের পর বছর ঢললেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। উ থান্ট নিজেই বলেছেন -শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টি আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট সরকার এবং জনগণকে এ সম্পর্কে সাহায্য করা বিশ্বসভার কর্তব্য। উ থান্ট বর্ণিত কর্তব্যের পরিধি যদি এতদূর বিশ্বস্ত হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তারে ঘরােয়া ব্যাপার রইল কি করে? পঞ্চাশী লক্ষাধিক শরণার্থী যদি ভারতে আশ্রয় না নিতেন তবে সমস্যার প্রকৃতির ভিন্ন ব্যাখ্যা চলত। গণগন্ত্রের গলা টিপে মারবেন ইয়াহিয়া খানএবং চালাবেন পাইকারীহারে হত্যা, লুণ্ঠন এবং নিপীড়ন আর তার ফলভােগ করবে গােটা দুনিয়া, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টির প্রধান প্রতিবন্ধক ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকগােষ্ঠী। যতদিন এদের শাসনের অবসান না ঘটবে পূর্ব বাংলায় ততদিন শরণার্থীর বােঝা নামাতে পারবেন না রাষ্ট্রসংঘ। এ পথে পা না দিয়ে শুধু নাকি কান্নায় কি সমাধান হবে বাংলাদেশ সমস্যা?
উ থান্ট বিশ্বাস করেন, পূর্ব বাংলার বর্তমান অবস্থা ব্যাপক সাহায্য বিতরণের প্রতিকূল। তার রিপাের্টে পায়াে গেছে এই বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি। এই ধারণার মধ্যে যদি থেকে থাকে কোন আন্তরিকতা তবে কি রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিক সাহায্য পাঠান হল পূর্ব বাংলায়? বিভিন্ন মহল থেকে উঠছে অবিযােগ-বিম্বসভার সাহায্য ব্যবহৃত হচ্ছে ইয়াহিয়ার সৈন্য পােষনে। দুর্গতদের সেবার বদলে এগুলাের রূপান্তর ঘটছে দূর্গত হত্যায়। সেক্রেটারী জেনারেলের কথায় এবং কাজে ধরা পড়েছে বিরাট ফারাক। গােড়ায় ভুল করেছেন উ থান্ট। এতগুলাে মানুষ ভিটা মাটি ছেড়ে কেন আশ্রয় নিলেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে- এ প্রশ্নটি তােলার সৎসাহস দেখাতে পারেন নি তিনি। যদি পারতেন তবে রােগ নির্নয় হয়ে যেত অনেক আগেই। আমেরিকার মুখ চেয়ে কাজ করার অভ্যাস ছাড়তে পারেননি তিনি। তাই প্রতি পদক্ষেপেই চলছে গোঁজামিল। দায়ে পড়ে তিনি এখন চাচ্ছেন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান! তার দৃষ্টিতে এই সমাধানের অর্থ -পারস্পরিক বােঝাপড়া। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন কতগুলাে বিভীষনের সঙ্গে বােঝাপড়া করে ফেলেছেন ইয়াহিয়া খান। তাতে হয়নি মুসকিল আসান এবং তা হবার সম্ভাবনাও নেই। বাকি রইলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। তাদের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানকে বােঝাপড়া করতে বলেন উ থান্ট। তা যদি পারেন তবে স্পষ্টই হয়ে উঠবে তাঁর বক্তব্যের বিষয়বস্তু। এখন তিনি তা পারবেন না। প্রকৃত অবস্তার উপলব্ধিতে আরও সময় লাগবে। সবই নির্ভর করছে মুক্তিবাহিনীর মারের উপর। এই মার যত প্রবল হবে উ থান্টের উপলব্ধির ক্ষমতাও তত বাড়বে। শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাও তরান্বিত হয়ে উঠবে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!