আশা নিরাশার দ্বন্দ্বে ভুট্টো
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়-প্রতীক্ষায় বিরাম নেই। অধীর আগ্রহে ইয়াহিয়ার মুখের দিকে চেয়ে আছেন জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো। ইয়াহিয়া হাসলে অন্তরে যাগে পুলক। ইয়াহিয়া গম্ভীর হলে মনে জাগে ত্রাস আশা নিরাশার দ্বন্দ্বে স্নায়বিক অবসাদ ঘটেছে ভুট্টোর। ক্ষমতা তার চাই। এর জন্য কি না করেছেন তিনি? ইয়াহিয়ার সঙ্গে গটছড়া বেধে গণতন্ত্রের নির্বাসন দিয়েছেন পূর্ববাংলায়। নির্বিকার চিত্তে দেখেছেস তিনি পাক সৈন্যদের গণহত্যা। জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগুরুদল আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘােষণা করেছেন ইয়াহিয়া খান। আনন্দে বগল বাজিয়ে নেচেছেন ভুট্টো। দাবী জানিয়েছেন বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগ বেআইনী। তাঁর পিপলস পার্টিই এখন বৃহত্তম দল। এ-দলের নেতা হিসাবে তিনিই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার যােগ্য অধিকারী। ভুট্টোর দাবীতে আমল দেননি ইয়াহিয়া খান। মনমরা হয়ে পড়েছিলেন জনাব ভুট্টো। জাতীয় পরিষদের ৭৯ টি এবং প্রাদেশিক আইনসভার ১৯৫ টি আওয়ামী লীগ আসন বাতিল করলেন জঙ্গী শাসক গােষ্ঠী। চিত্ত চাঞ্চল্য দেখা গেল না ভুট্টোর মধ্যে। দুবার পিছান হল নির্বাচনের তারিখ। পূর্ববাংলার গবর্ণরের আসনে বসলেন ইসলামাবাদের কুড়ান মানিক ডাঃ মালিক। অভিমানে ফেটে পড়লেন ভুট্টো। তিনি কি এতই ফেলনা? ক’দফা আলােচনা চলল ইয়াহিয়ার সঙ্গে। কপালে জুটল সানকি ধােওয়া পানি। ভুট্টো এখন কামড়াচ্ছেন নিজের আঙ্গুল এবং মাঝে মাঝে করছেন ফোস ফোস।
ইয়াহিয়ার সর্বশেষ ঘােষণা-আগামী ১২ ডিসেম্বর থেকে ২৩ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে পূর্ববাংলার উপনির্বাচন। তারপর বসবে জাতীয় পরিসদের অধিবেশন সেখানে পেশ করা হবে খসড়া সংবিধান। তার শেষ পরিণতি নির্ভর করেভ ইয়াহিয়ার মর্জির উপর। ক্ষমতা হস্তান্তর এখনও আকাশ কুসুম কল্পনা। আর স্থীর থাকতে পারছেন না ভুট্টো। ভেঙ্গে পড়েছে তার ধৈর্য্যের বাঁধ। বলছেন তিনি ডিসেম্বর মাস শেষ হবার আগেই সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর অবশ্য কাম্য। তা না হলে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কম। ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্রের সঙ্গে বহুদিন ঘর করেছেন জনাব ভুট্টো। তা সত্ত্বেও তিনি যদি তাদের চিনতে না পেরে থাকেন, তবে তা নিছক বুদ্ধির ভুল। জঙ্গীশাসকরা কখনই স্বেচ্ছায় ছাড়েন না ক্ষমতা। রাস্তায় নিক্ষিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ওরা কামড়ে থাকেন ক্ষমতার মাটি। পাকিস্তানের পক্ষে এ সত্য খুব বেশী পরিমানে স্পষ্ট। সিদ্ধি নেতার মান রক্ষার জন্য সিংহাসন ছেড়ে পথে বাসে শুধু হাওয়া খাবেন না কায়েমী স্বার্থের জিম্মাদাররা! গণতন্ত্রের জন ভুট্টোর দরদ কতখানি তা জানেন ইয়াহিয়া খান। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগুরু দলের নেতা মুজিবুর রহমানকে যখন সরকার গঠন করতে দেওয়া হল না তখন কোথায় ছিল ভুট্টোর গণতান্ত্রিক চেতনা? ইয়াহিয়ার দড়ির টানে তার উদ্দাম নৃত্যের কথা ভুলে জাননি দুনিয়ার বিবেকি মানুষ। পূর্ববাংলায়। যখন সুরু হল নারকীয় তান্ডব তখন কি করছিলেন ভুট্টো? সিন্ধুতে চালচ্ছিলেন বাঙালী নিধন। কতগুলাে বিভীষনকে রঙ্গমঞ্চে টেনে এনে উপনির্বাচনের প্রহসনের মহরৎ দিচ্ছেন ইসলামাবাদ। এর নাম কি গণতন্ত্র? স্বৈরতন্ত্রের তল্পীবাহক আজ সাজতে চাচ্ছেন গণতন্ত্রের ধারক। তার গুঞ্জন দোলা দেয়না মনে, জাগায় শুধু নিরবচ্ছিন্ন কৌতুক।
অকুল সাগরের পারে বসে আছেন ভুট্টো উত্তাল তরঙ্গে ওঠানামা করছে তার আশা-তরী। বেশী ঝামেলা করলে হয়ত বেআনী হবে তার পিপলস পার্টি। কয়েদীর বেশে শেখ মুজিবের পাশের কামরায় হয়ত স্থান নেবেন তিনি। ঝামেলা না করলেও দলে ধরবে ভাঙ্গন। তাঁর দলভুক্ত এক শ্রেনী ক্ষমতা পাগল। ছিটেফুটে পেলেই তারা খুশী। কিন্তু ভুট্টো? অল্পেতে তার মান থাকে না। প্রধানমন্ত্রীরপদ না পেলেই নয়। দেনেওয়ালারা বড়ই কৃপণ। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে না এক চামচে পানি। ভুট্টোর ভয়- শেষ পর্যন্ত ডাঃ মালিকের মত আর একটি পুতুল বসবেন কিনা পাকিস্তানে ঘাড়ে, তাই বা কে জানে? ইয়হিয়ার মতে এই হচ্ছে গণতন্ত্র এবং অসামরিক শাসন। ভুট্টোর ধারণা আলাদা যেখানে তিনি নেই সেখানে গণতন্ত্রও নেই। গণতন্ত্রের একমাত্র মাপকাঠি, ভুট্টোর প্রধানমন্ত্রীত্ব। নিশ্চিত থাকুন ভুট্টো। তার ভাগ্যে ছিড়বে না শিকে। বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রের ঘটেছে অপমৃত্যু পশ্চিম পাকিস্তানে তা কখনই হবে না জীবন্ত। জঙ্গীশাহীর বিষ দাঁত ভাঙ্গার একমাত্র পথ অস্ত্রের সার্থক প্রয়ােগ। মুক্তিবাহিনী ধরেছেন হাতিয়ার। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বাস্তব। ওরাই আনবেন পূর্বঞ্চলের গণতন্ত্র। পশ্চিমের জনতা যদি চালাতে পারেন সশস্ত্র সংগ্রামী অভিযান তবে খসে পড়বে জঙ্গী চক্রের শাসন দণ্ড। গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটবে পাকিস্তানে। কিন্তু নেতৃত্ব দেবেন। কে? সুবিধাবাদী ভুট্টো? সবাই জানেন তিনি গণতন্ত্রী নন, জঙ্গীশাহীর উচ্ছিষ্ট। তার স্থান সত্যিকারের ক্ষমতার সিংহাসন নয়, ইয়াহিয়ার বুটের তলায়।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১