বাংলার বাণী
ঢাকা: ১২ই এপ্রিল, শুক্রবার, ২৯শে চৈত্র, ১৩৮০
ত্রিপাক্ষিক চুক্তি বনাম মানবিক সমস্যা
নয়াদিল্লিতে ত্রিপাক্ষিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক একটি নির্দিষ্ট গতি লাভ করেছে। উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি বিধানের শরিক হয়ে তিন দেশের নেতারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ঔরসজাত মানবিক সমস্যাগুলির সমাধানের পথ খুঁজছিলেন। ১৯৭৩ সালের ২রা জুলাই স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি, ১৯৭৩ সালের ২৮শে আগস্ট দিল্লি চুক্তি, অবশেষে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের খটকা সর্বশেষ ১৯৭৪ সালের ৯ই এপ্রিল তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে একটি নিষ্পত্তিতে পৌঁছেছে। আমরা এই চুক্তি গুলোকে শান্তির উদ্যোগ বলে বারবার সমর্থন দিয়ে এসেছি। এবারও সমর্থন ঘোষণা করছি।
৯ই এপ্রিল স্বাক্ষরিত তিন মন্ত্রীর চুক্তিতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত মানবিক সমস্যাবলী নিষ্পত্তিতে দৃষ্টিদান সম্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। ভিত্তিদান শব্দটিকে যদি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ এই ‘ভিত্তির’ ওপর নির্ভর করে আমরা অবশিষ্ট মানবিক সমস্যাগুলির মীমাংসার জন্য অগ্রসর হতে পারবো এবং সুন্দর স্বাস্থ্যকর একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা পরিবেশ এই উপমহাদেশে গড়ে তুলতে সক্ষম হব। কিন্তু কোন পক্ষ যদি এই চুক্তির বলে ধরে নেন যে, সকল মানবিক সমস্যার মীমাংসা হয়ে গেছে তাহলেই বাঁধবে অনর্থ। যুদ্ধবন্দীরা (১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সহ) স্ব স্ব দেশে ফিরে যাচ্ছেন, আটক বাঙালিরা দেশে ফিরে আসছেন। সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের যারা বসতি গড়ে ছিল, সাবেক পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী ও তাদের পরিবার বর্গ এবং ডোমিসাইল নির্বিশেষে সকল বিচ্ছিন্ন পরিবারের সদস্যরা পাকিস্তানের ছাড়পত্র পেয়েছেন এই চুক্তির মধ্যে। কিন্তু লাখ লাখ অবাঙালি পরিবার যারা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে দাবি করছে অথচ বাংলাদেশে আটকে পড়েছে রয়েছে তাদের জীবনের গতি কি হবে চুক্তির মধ্যে তার কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। আর নেই তাদের সম্পর্কে যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নরমেধ যজ্ঞের শিকার হয়েছিল, বাংলাদেশের সেই ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের মুক-মৃঢ় ম্লান মুখী সদস্যদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। অথচ ১৯৭২ সালের লড়াইয়ে এরাই হয়েছিল সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত।
পাকিস্তান কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ। তাই আমরা সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। দেশি দালাল আর বহিরাগত ঘাতক কাউকেই আটকে রাখিনি। কারণ আমরা মানবিক সমস্যার সমাধান চাই। আমরা উপমহাদেশের শান্তি চাই। কিন্তু সমস্যা তো আর মাত্র কয়েক লাখ বন্দীর বা আটকে পড়া ব্যক্তিদের বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের হাজার হাজার ও অবাঙালি বাস্তুহারা, যারা পাকিস্তানের নাগরিক বলে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন তাদের সমস্যাও মানবিক সমস্যা আর লাখ লাখ শহীদ পরিবার, আর লাখো মা-বোন, যারা লাঞ্ছিত হয়ে ‘বীরঙ্গনা’ উপাধি ধারণ করে সমাজে ছিন্নমূল জীবন ধারণ করছে, তাদের সমস্যা মানসিক সমস্যা। তাদের জীবনের সদগতিই তিন দেশের নেতাদের করতে হবে। তাদের জীবন যাতে অর্থবহ হয়, শান্তির অন্বেষণকারী দেন চুক্তিটিকে অর্থবহ করে তুলতে হলে সেদিকটাও দেখতে হবে। কেবল মানবিক সমস্যা সমাধানের বেদী নির্মাণ করে বসে থাকলে সমস্যা দূর হবে না।
চুক্তির রাজনৈতিক দিকটি আলোচনা করার জন্য যে ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য দরকার সে তথ্য আমরা এখনও পাইনি। তাই আপাততঃ উপরোক্ত দুটি সমস্যা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমরা প্রার্থণা জানাবো পর পর তিনটি সফল চুক্তির মাধ্যমে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে আমরা সবাই যেন সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার জন্য এগিয়ে যেতে পারি। অর্থবহ করে তুলতে পারি।
কাঁচামালের ন্যায় সঙ্গত মূল্য
বহু আলোচিত আকাঙ্ক্ষিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আরম্ভ হয়েছে গত ১০ই এপ্রিল। এ অধিবেশনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উৎপাদিত কাঁচামালের মূল্য প্রাপ্তির বিষয়টি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। অধিবেশনের প্রথম দিন আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়েরী বুমেদীন বিতর্কে সূচনা করেন। তার মতে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করার জন্য কাঁচামাল বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাঁচামালের ন্যায় সঙ্গত মূল্যের প্রশ্নটিই নতুন নয়। সম্প্রতি আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে কাঁচামালের বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয় এবং সেখানে এ সম্পর্কে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা প্রস্তাবটির গৃহীত হয়।
উল্লেখ্য যে, যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক সংকট ও কাঁচামালের ন্যায় সঙ্গত মূল্যের বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। ইতিমধ্যে তার মতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিজস্ব স্বার্থেই কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির প্রয়োজন। বলা যায় জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন এর আশু ফলস্বরূপ সাধারণ পরিষদে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের প্রধান সম্পদ কাঁচামালের মূল্য দাবি করছে। আমরা জানি যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্পায়িত নয় বলেই কাঁচামাল দিয়ে তারা দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে না। ফলে উন্নত দেশগুলোর কাছে কাঁচামাল বিক্রি করতে হয়। এতে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়-যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শুধুমাত্র বাঁচার প্রশ্নে অপরিহার্য।
অপরদিকে আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদীন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাঁচামালের ন্যায় সঙ্গত মূল্য দাবি প্রসঙ্গে বলেছেন যে, বিশ্বে বর্তমানে কাঁচামালের ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ কাঁচামাল বিক্রি করা যেমন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আবশ্যিক, তা ক্রয় করে উৎপাদনের স্বার্থে ব্যবহার করাও তেমনি উন্নত দেশগুলির জন্য অবশ্য গ্রহণীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় পারস্পারিক প্রয়োজনে আবশ্যকতা থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি জটিল ও ঘোলাটে।
এই প্রসঙ্গে ইজভেস্তিয়ার মন্তব্য হলো যে, আজকে পরিবর্তনশীল বিশ্বকে গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল জাতিগুলোর ঐক্য ও তৎপ্রসুত সমৃদ্ধি নির্ভর করছে। কারণ বহুদিনের প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে যদিও আজ উন্নয়নশীল দেশগুলো মুক্ত তবু পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের স্বপ্ন জাল থেকে এই দেশ গুলো আজও মুক্তি পায়নি। শোষণের পদ্ধতির রদবদল হয়েছে মাত্র।
আজকে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির এলাকা হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলো। আমরা জানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তার ফলে অনুন্নত দেশগুলোর মারাত্মক রকমের মুদ্রাস্ফীতি শিকার হয়েছে। ফলে ধার্যকৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র এবং আমাদের দেশে তার দুঃখজনক দৃষ্টান্ত আজ দৃশ্যগোচর হচ্ছে।
এমনিতেই উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রধানতঃ খাদ্যের ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এই খাদ্য তাদেরকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে ক্রয় করতে হয়। আর তাদের এই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান মাধ্যম হলো কাঁচামাল। তাই যদি শুধুমাত্র খাদ্য আমদানি করতে তাদের বহু কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ ব্যয় করতে হয় তাহলে উন্নয়নের কাজ পরিচালনা করা অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো ক্রমশঃ বিত্তশালী দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে যার পরিণতি ভয়ঙ্কর।
এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা হিসাব করে বলেন যে, বিশ্বের সংশ্লিষ্ট উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অসম বিনিময় ফলে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া ওয়ালারা বছরের চৌদ্দ অথবা পনেরো বিলিয়ন ডলার মুনাফা লুটছে। এই টাকা পেলে বহু লোকের প্রাণ বাঁচানো যেত। বলা যায়, উক্ত হিসাবের দিকে লক্ষ রেখে উন্নয়নশীল দেশ সমূহ আজ নিজেদের স্বার্থেই ন্যায্য দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তাদের খন্ড শক্তির যতটুকু জোর থাকুক-ঐক্যবদ্ধ শক্তির যে প্রচণ্ড চাপ আছে, তেল পরিস্থিতিতে তাদের জয়লাভ তারই প্রমাণ।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে মন্তব্য রাখতে গিয়ে ইরানের অর্থমন্ত্রী জামশেদ আমুজেনার সাংবাদিকদের জানান যে, কাঁচামালের ন্যায় সঙ্গত দাম দেওয়া ছাড়াও তাদের স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দানের উদ্দেশ্যে দু থেকে তিনশ কোটি মার্কিন ডলার প্রাথমিক পুঁজি করে একটি বিশেষ উন্নয়ন তহবিল গঠনের জন্যও এই অধিবেশন প্রস্তাব রাখবে।
অতএব বলা যায়, সমৃদ্ধি ও স্বয়ংস্মভয়তার প্রশ্নে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সুসংহতিই আজ তাদের সবচেয়ে বড় রক্ষক। বিশেষ করে সামগ্রিক সমস্যায় যে দেশগুলো আজ আকন্ঠ নিমজ্জিত-পরিস্থিতির উপলব্ধি উপরেই তাদের আন্দোলন ও কাঁচামালের মূল্য প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিহিত আছে। আর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশেরও সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নে কাঁচামালের ন্যায়সঙ্গত মূল্য দাবির পক্ষেই সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপন করছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক