সেই কুঠিবাড়ি
বিজনকুমার ঘােষ
প্রতিটি ছুটিতে দেশে যাওয়াটা ছিল একটা নেশার মত। কুষ্টিয়া স্টেশনে নেমেই দৌড়ে চলে যেতাম খেয়াঘাটে। ওখানে গড়াই নদীর মাঝি ইউসুফ মিয়া এক পলক দেখেই চিনতে পারত, মাণিকবাবু বাড়ি আসেন। কথা বলার সময় নেই তখন। কয়েকটা লগি ঠেললেই ওপারে কয়া গ্রাম, বিল্পবী বাঘা যতীনের জন্মস্থান। কয়া থেকে শিলাইদহ পাকা তিন মাইল- আমার জন্মভূমি। সাদিপুর গ্রামে থেকে কুঠিবাড়ির সেটে দুটো বিশাল ঝাউগাছ দেখা যেত। এই সময় মনটা দুলে উঠত হঠাৎ। আরেকটু এগােলেই কুঠিবাড়ির চুড়া। এখানে এসে দু পায়ে স্পীড অসম্ভব বেড়ে যেত। সদর রাস্তা থেকে বাবলাগাছে ঢাকা একটা সরু রাস্তা পেরিয়ে কুঠিবাড়ির গেটে এসে শেষ হয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক বার মনে হত বাংলাদেশে বুঝি আমার চাইতে সুখী বালক আর একটিও নেই।
কেয়ারটেকার আমীর খা বাবার বন্ধুর হাতে মস্ত বড় চাবির গােছা। কুঠিবাড়িতে সব সময় তখন তালাচাবি পড়ে থাকত। আমাকে দেখতে পেয়েই আমীর চাচা বলত, এই নাও চাবি, দেখা হলে ফেরত দিয়ে যাবে। আমার যে বিশেষ দুর্বলতা আছে আমীর চাচা তা জানে।
৬২ বিঘা জমির পর কুঠিবাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে অতি উৎকৃষ্ট কলমের আম ও অন্যান্য ফলের বাগান। ঢেউ খেলানাে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। তিনি তলার ছাদে দাঁড়ালে দেখা যেত বিশাল পদ্মা নদী। রঙীন পাল তুলে পশ্চিমের বড় বড় নৌকা গােয়ালন্দের দিকে চলেছে। রাত্রি বেলায় ঝাউবনের আড়ালে পদ্মার ওপরটা লাল হয়ে যায়। পাবনা শহর। তিন তলার কারুকাজ করা উঁচুনিচু ছাদ, তার যেখানে খুশি দাঁড়ালে দেখা যেত মাইলের পর মাইল শুধু ধানক্ষেত। মাথার ওপর চব্বিশ ঘণ্টা পেজা তুলাের মেঘ ভেসে যাচ্ছে। প্রাচীরের পাশ দিয়ে শিশু গাছের সারি। বাতাসের মধ্যে দোলাদুলি করাই ওদের একমাত্র কাজ। হ্যা, কবিতা লেখার জায়গাই বটে ! চকিতে চলে যেতাম তিন তলার একমাত্র বড় ঘরখানায়। এখনাে শ্বেত পাথরের টেবিল, খান তিনেক প্রীং-এর চেয়ার স্মৃতিভারে পড়ে আছে। যেন লিখতে লিখতে এই মাত্র বাইরে চলে গেছেন। সুদুর কারুকাজ করা ব্রাকেট। এই তাে এখানেই ঝােলানাে থাকত তাঁর সেই বিখ্যাত আলখাল্লা।
দোতলার পূর্ব দিকের ঘরখানা বাবুমশাই-এর (শিলাইদহের লােকেরা রবীন্দ্রনাথকে বাবুমশাই বলে ডাকত) শােবার ঘর ছিল। আমীর চাচার মুখে শােনা। দোতলার তিন দিকেই লম্বা বারান্দা। হ্যা, এখান থেকেও ইচ্ছে মত পদ্মা নদী ধানক্ষেত আর আকাশ দেখা যাবে। ঘরে ঘরে ঠাকুরবাড়ির সৌখিন রুচির আসবাবপত্র। নিচের তলায় শিলাইদহ এসটেটের অফিস ছিল কিছু দিন। মনে পড়ে বর্ষার দিনে বাবুরা ধানক্ষেতের ভিতর নৌকা ঠেলে অফিসে আসছেন। কিছু দিন শিলাইদহের পােস্ট অফিসও ছিল এখানে “পােস্ট মাস্টার” গল্পটি আপনারদের নিশ্চয়ই মনে আছে।
দেখা শেষ হলে আমীর চাচার হাতে চাবি দিয়ে চলে আসতাম। বাড়ির কাছাকাছি হালের অফিস বাড়ির পাশে পড়ে আছে ডানা ভাঙ্গা সেই বােটখানা। ফি শনিবারে কলকাতা থেকে স্যার জগদীশচন্দ্র বােস, লেডী অবলা বােস এসে পদ্মায় যেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হতেন। প্রত্যেক বারই বুক ভেঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসত !
আনন্দ বাজার : ১৩.৪.১৯৭১
Reference:
গণমাধ্যমে-বাংলাদেশের-মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন