বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৪শে আগস্ট, শনিবার, ৭ই ভাদ্র, ১৩৮১
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
‘সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের কবলে মুন্সিগঞ্জ’ এই শিরোনামে গতকাল অত্র পত্রিকায় দুর্বৃত্তদের সম্প্রসারিত সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কে রিপোর্ট পরিবেশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে লৌহজং থানায় বেলতলী গ্রামের দুই শতাধিক সশস্ত্র ব্যক্তি ১১ শত মণ গমবাহী একটি নৌকা লুট করে। সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে লৌহজংয়ের এলএসডি গুদামে এই গম নিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। ওই একই দিন মুন্সিগঞ্জ মহাকুমাধীন শ্রীনগর থানার ভাগ্যকুল বাজারস্থিত জনতা ব্যাংকের উপর আরেকটি সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের হামলা চালায়। কিন্তু ব্যাংক কর্মীদের সাহসিতায় তাদের সে আক্রমণ প্রতিহত হয় বলে খবরে প্রকাশ।
গতকাল ঢাকার আর একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, গত মঙ্গলবার রাতে যশোর বড়বাজার রেলস্টেশনে একদল দুস্কৃতিকারীরা ওয়াগন ভেঙ্গে গম চুরি করে এবং এর সাথে জড়িত সন্দেহে স্টেশনের ৮ জন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই খাবারের পাশাপাশি পত্রিকাটির পরিবেশিত আরেক সংবাদ বিবরণী প্রকাশ, গত বৃহস্পতিবার রাতে নোয়াখালী জেলার রামগতি তোরাবগঞ্জ বাজারে ৩০ থেকে ৩৫ জনের একটি সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের হামলা চালায় এবং মালামালসহ ৫০ হাজার টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। খবরের এখানেই শেষ নয়। মুন্সিগঞ্জ মহাকুমার টঙ্গীবাড়ী থানা জনতা ব্যাংকের বেতকা শাখা থেকে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত কর্তৃক নগদ ৫৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়ার খবর পরিবেশিত হয়েছে কয়েকদিন আগে। ১৭ই আগস্টের খবরের কাগজে রায়েরবাজার জেলেপাড়ায় জলবন্দি মানুষের উপর ডাকাতদলের হামলার খবর জানা গেছে।
গতকাল বাংলার বাণীতে ‘বেগবতী ক্রুদের স্বীকারোক্তি’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার পথে বেগবতী জলযানের নাবিকদের ভাল পাচারের সময় নৌ বাহিনীর লোকদের হাতে গ্রেপ্তারকৃত জলজানটির ক্রুরা স্বীকার করেছে যে, তারা ৫৭ বার জাহাজ থেকে খাদ্যশস্য খাদ্যশস্য বিক্রি করেছে। তাদের স্বীকারোক্তি মতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে তাদের বহনকৃত সরকারি মাল গোপনে বিক্রির প্রধান কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, বরিশালের হিজলা এবং চাঁদপুরের নীলকমল এলাকা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে সম্প্রতিককালে এবং খবরের কাগজের একটা বড় অংশ ইদানিং এই সমস্ত খবরই দখল করে রাখছে। এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি এ বছরের গোড়ার দিকের কথা অথবা গত সালের শেষদিকের দিনগুলোকে। সে দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে ছিল ওই সময় এবং সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারকে বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছিল বাংলাদেশের সর্বত্র গত ২৪শে এপ্রিল থেকে। গতকাল একটি সংবাদপত্র গত ৩৩ মাসের দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে ৪ জন এমপিসহ ৫২৪ জন আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হওয়ার খবর পরিবেশিত হয়েছে। খবরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হবার হিসাব দেওয়া হয়নি। সুতরাং মোট হিসাব না পাওয়া গেলেও এই সমস্ত হত্যাকান্ডের বেশিরভাগ এই যে ঘটেছে ১৯৭২ সালের প্রথম থেকে ‘৭৪ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ এ বছর ২৪শে এপ্রিল সেনাবাহিনী নামানো থেকে অন্ততপক্ষে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছিল তা সংবাদপত্রের পাঠক তথা গোটা দেশবাসী জানেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিত আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছি না। এমনিতে বন্যার সারাদেশ অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আহার, বাসস্থান, চাষাবাদ ইত্যাদির সমস্যায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ জর্জরিত। এ সমস্যা ও সংকটের ধাক্কা এসে শহরে যে লাগেনি এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থাটা কি হবে? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য এখনও সেনাবাহিনী দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। সেনাবাহিনীর কর্মরত থাকা অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তাহলে জনগণের একদিকে দুশ্চিন্তার অবধি থাকবে না, অপরদিকে দুষ্কৃতিকারীরা সেনাবাহিনীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করবার চেষ্টা করবে ক্রমাগত। যেকোনো দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার শেষ ভরসা হলে সেনাবাহিনী এবং সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে যাতে দুস্কৃতিকারীরা থোড়াই কেয়ার না করে সেটাই জনগণের একমাত্র কামনা।
কাগজের সংকট
কাগজ নেই। লেখারও নেই। ছাপারও নেই। এই সরকার প্রবর্তিত নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ আদেশ আরোপিত হবার আগে পর্যন্ত অন্ততঃ একটা অবলম্বন ছিল নিউজপ্রিন্ট। তাও নেই। ফলে সংকটটা উভয় ক্ষেত্রেই বেড়েছে। এমনিতেই তো সারা বছর ঘুরলে সাদা কাগজ পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার সঙ্গে গোদের উপর বিষফোড়ার চন্দ্রঘোনা কাগজ উৎপাদন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী কাগজের কলে দৈনিক ১ শত টন উৎপাদনের জায়গায় ৩০ টন উৎপাদন হচ্ছে। কস্টিক সোডা, সোডিয়াম সালফেট, চুন, সালফিউরিক অ্যাসিড এবং কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। প্রতিবেদন সূত্র আরও বলা হয়েছে যে, এলসি’র মাধ্যমে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানির ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও সময়মতো এসে না পৌঁছায় এই বিভ্রাট দেখা দেয়। অবশ্য কাগজ সংকটটা বাংলাদেশের জনগণ কিছু নতুন নয়। চলতি বছরের জুলাই মাসে কাগজ সংকট দেখা দেয়। এ নিয়ে তখন প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। ‘যথা পূর্বং তথা’-ই রয়েছে।
একথা আজ বাস্তব সত্য যে, নিউজপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ করার ফলে স্বভাবতই সাদা কাগজের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে লেখাপড়ার যাবতীয় কাজ, সাধারন পুস্তক প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল কাজেই সাদা কাগজের চাহিদা অধিকতর বৃদ্ধি পাবার কথা। এর প্রেক্ষিতে সাদা কাগজ উৎপাদনের আশঙ্কাজনক ঘাটতি আমাদেরকে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগাকুল করে। একেতো লেখাপড়ার ব্যাপার মাত্র গত তিন বছরের তুলনায় এখন অনেক গুণ বেড়েছে। খোলাবাজারে সাদাকাগজ কিনতেও এখন বেশি পয়সা লাগছে। তাও সব সময় বাজারে সাদা কাগজ মেলে না। কারণ জানতে চাইলে দোকানি সরবরাহের অভাবের কথা বলে।
কাগজ উৎপাদনের পর তার সুষ্ঠু বিতরণের প্রশ্ন আছে। কাগজপত্র সরবরাহের কোনো নিয়ম-কানুন আজ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। নির্ধারিত এলাকায় হিসেব মতো বিতরণের জন্য সৎ ডিলার নিয়োগ না করে খেয়ালখুশিমতো এবং উদ্দেশ্যমুলকভাবে কাগজ বন্টনের রেওয়াজ আজও চালু রয়েছে। ফলে কাগজ উৎপাদন যখন যেমনই হোক শুধুমাত্র সরবরাহে দুর্নীতি থাকার জন্য কাগজ সংক্রান্ত নৈরাজ্য এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত বাস্তব।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, উত্তরবঙ্গে একটা সাদা কাগজ উৎপাদনের কারখানা আছে। বছরে সেখানে ১৮ হাজার টন কাগজ উৎপাদন হবার কথা। চলতি বছরের সেখানেও মাত্র ৩ হাজার টন সাদাকাগজ উৎপাদিত হয়। অভিযোগ একই প্রয়োজনীয় কাঁচামালের একান্ত অভাব, কতিপয় কর্মচারীর নির্মম খামখেয়ালিপনা ও অক্ষমতা। অর্থাৎ একদিকে কাঁচামালের অবাঞ্ছিত অভাব, অপরদিকে কাগজবণ্টনে দুর্নীতি-এই দুই মিলে একদা কাগজ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশে আজ মর্মান্তিকভাবে কাগজ সংকট দেখা দিয়েছে।
সব ব্যর্থতারই কৈফিয়ৎ থাকে। কাগজ শিল্প সংকট সম্বন্ধেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কৈফিয়ৎ অবশ্যই আছে। কিন্তু তারা শুনে আমাদের কোন লাভ নেই।
তাই দিনের পর দিন সাদা কাগজের দুষ্প্রাপ্যতা, মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদন হ্রাস তথা সার্বিকভাবে শিক্ষা ও প্রকাশনা ক্ষেত্রে এই যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে চলেছে তার ভবিষ্যৎ সমাধান কি- সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে আমাদের প্রশ্ন সেইটি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক