You dont have javascript enabled! Please enable it!
ইন্দিরা-তাজ ঐতিহাসিক বৈঠক | স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
বিরোধিতা | কূটনীতি | নেপথ্যের চরিত্র
=============
এই পরিস্থিতিতে আমাদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল স্বাধীন বাংলাদেশের মুখপাত্র হিসেবে ভারতের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে তাদের কাছ থেকে কী সাহায্য পেতে পারি তার ব্যবস্থা করা। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা ভারতের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করব। আমরা তৌফিক এবং মাহবুবকে নিয়ে সাথে আরাে কয়েকজন সশস্ত্র ছেলেসহ বেতনাপুর নামক সীমান্তের বিওপি-র দিকে যাই। পথে দেখি মানুষ এত সজাগ হয়ে গেছে যে পাকিস্তানি আর্মি যাতে না আসতে পারে তাই সব জায়গাতে তারা চেক করছে। আমাদের জীপটাও তারা কয়েকবার চেক করল। মানুষের মধ্যে আর্মির বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করলাম। বিওপি-র কাছাকাছি এসে আমাদের জীপটা বাংলাদেশের ভেতরেই থামানাে হল। তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমাদের সিদ্ধান্ত, আমরা আত্মগােপন করে সীমান্ত অতিক্রম করব না, আমরা সীমান্ত অতিক্রম করব স্বাধীন দেশের সরকারের মুখপাত্র হিসেবে। তখন তৌফিক এবং মাহবুবকে বলা হল, তােমরা স্বাধীন দেশের অফিসার, তােমাদেরকে আমরা ভারতে পাঠাচ্ছি, তােমরা গিয়ে বলবে, স্বাধীন বাংলাদেশের যে হাইকমান্ড তার প্রতিনিধি তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমীর-উল ইসলাম সাহেব এসেছেন। একটি স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিদেরকে যেভাবে সম্মান দিয়ে গ্রহণ করতে হয়, সেইভাবে তারা আমাদেরকে গ্রহণ করতে রাজি আছে কিনা জানালে আমরা ভেতরে যাব।’ তৌফিক, মাহবুব সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে গেল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি। হয়ত তারা দিল্লীর সাথে, কলকাতার সাথে যােগাযােগ করতে সময় নিচ্ছে। এদিকে এই জায়গায় একটা কালভার্ট ছিল, দু’পাশে বসবার মত জায়গা ছিল সেখানে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, প্রচণ্ড গরম, বসে থেকে থেকে আমরা শুয়ে পড়েছি, এমন সময় পাশের ঝােপের ভেতর থেকে ভারি বুটের শব্দ ভেসে এল। ওরা এসে আমাদেরকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘স্যার, ইউ আর ইনভাইটেড টু কাম টু আওয়ার ক্যাম্প।’ ঠিক যেভাবে বিদেশী রাষ্ট্রের সম্মানিত অতিথিকে গার্ড অফ অনার দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদেরকেও সেইভাবে আমন্ত্রণ জানানাে হল। আমরা ভেতরে গিয়ে শুনলাম ইস্টার্ন কমান্ডের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আইজি আমাদের সাথে দেখা করার জন্য ইতােমধ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষণের ভেতরেই গােলােক মজুমদার এলেন। তাঁর সাথে আমাদের আলােচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল যে, আমরা জানি পশ্চিমবঙ্গের লােকদের বাঙালি হিসেবে আমাদের প্রতি একটা সহানুভূতি আছে এবং থাকবে, কিন্তু আমরা সর্বভারতীয় অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের রেসপন্স চাই। এবং ভারত সরকার আমাদেরকে সেইরকম আশ্রয়, স্থান দেবে কিনা, যেখানে আমরা ট্রেনিং নিতে পারব, নিয়ােগ করতে পারব, অস্ত্রশস্ত্র পাব এমন নিশ্চয়তা। এই কথা শুনে গােলােক মজুমদার বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর শুধু একজনই দিতে পারেন, তিনি।আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তবে আমি তার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়ে দিতে পারি। এছাড়াও এখানে আসবার আগে আমি দিল্লীতে যােগাযােগ করেছিলাম, সেখান থেকে আজ রাতেই একজন আসছেন আপনাদের সাথে দেখা করতে।’ আমরা গােলােক মজুমদারের কথায় রাজি হলাম। গাড়িতে কথা প্রসঙ্গে জানলাম, গােলােক মজুমদার ইতিহাসের ছাত্র। তিনি বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি কবিতাটি শুনিয়ে বললেন, বাংলা এমনই একটা জায়গা যেখানে বহিরাগতরা কোনদিনই পেরে ওঠেনি। মান সিং-এর কথা, আরাে কয়েকজনের কথা বলে তিনি বললেন, ‘ওরাও পারেনি, এবং এই যে আজ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আপনাদেরকে ধ্বংস করতে নেমেছে, দেখবেন তারাও পারবে না, জয় আপনাদের সুনিশ্চিত।’ এমন আশ্বাসবাণী শােনাতে শােনাতে তিনি আমাদেরকে সােজা নিয়ে গেলেন দমদম এয়ারপাের্টে, যেখানে প্লেন থামে ঠিক তার কাছাকাছি জায়গায়। প্রায় ৬ ফুটের মত লম্বা একজন লােক প্লেন থেকে নেমে এলেন। আমরা জীপ থেকে নেমে একটা কালাে অ্যাম্বাসেডার গাড়িতে উঠলাম, সাথে সেই ভদ্রলােক এবং গােলেক মজুমদার । এই ভদ্রলােক ছিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রধান রস্তামজী। আমরা একসাথে ‘অসম ভবনে’ (আসাম হাউস) গেলাম। সেই রাতেই পশ্চিম বঙ্গের পুলিশ চীফ, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সেখানে আনা হল এবং তাদের সাথে আমাদের বৈঠক হল। তাজউদ্দীন সাহেব বিস্তারিতভাবে আমাদের আন্দোলন থেকে শুরু করে সমস্ত পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সবই আমাদের মুক্ত এলাকা ঘােষিত হয়েছে এবং আমরা কী পরিস্থিতিতে এখানে এসেছি তাও বললেন। প্রত্যেকটি সীমান্ত জেলার সাথে আমাদের যােগাযােগের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা একটা লিস্ট তৈরি করলাম, তাতে সীমান্ত জেলাগুলাের সমস্ত এমপি ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নাম দেয়া হল যাতে এঁদের সাথে যােগাযােগ করা যায় এবং তাদের নিরাপদ এলাকায় নিয়ে আসা যায়। ওইসব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে যােগাযােগ করে দেয়ার ব্যবস্থার জন্য বললাম। সেই রাতেই অয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর চলে গেল সীমান্তবর্তী নেতৃবৃন্দকে খোঁজ করতে এবং আমাদের সাথে খবর আদানপ্রদানের জন্য। এছাড়াও অয়্যারলেসের মাধ্যমে পরদিনই চুয়াডাঙ্গায় যােগাযােগ করিয়ে দেবার আশ্বাস দিলেন রুস্তামজী। আলােচনা করতে করতে ভাের রাত হয়ে গেল। আমাদের কাপড়চোপড় কিছু নেই, রুস্তামজী তার পায়জামা-পাঞ্জাবি দিলেন। তিনি মস্ত লম্বা মানুষ, কোন রকমে তার কাপড় পরে আমরা ঘুমাতে গেলাম।পরদিন ওঁরা আমাদের জন্য কিছু কাপড় এবং প্রয়ােজনীয় জিনিস কিনে দিলেন। সকালে চুয়াডাঙ্গায় আবু ওসমান চৌধুরী এবং ডা, আসহাবুল হকের সাথে ফোনে কথা হল। এদিকে আমরা তখন যে সিদ্ধান্তে এসেছি তা হচ্ছে যে, সমস্ত বাংলাদেশব্যাপী আমাদের যে প্রস্তুতি আমরা দেখে এলাম পথে পথে, তা যথেষ্ট নয় একটা সৈন্যবাহিনীকে সম্মুখসমরে পরাস্ত বা মােকাবেলার জন্য। অতএব এই সমস্ত ছেলেদের একটা জায়গায় নিয়ে এসে একত্রিত করা, ট্রেনিং দেয়া, তাদের। হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া এবং তারপর যুদ্ধটাকে পরিচালনা করা, এই হল আমাদের চিন্তা। কিন্তু যারা ফিল্ডে আছে, যুদ্ধ করছে, তাদেরকে কথাটি বােঝাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারা সবাই বলছে, না আপনারা অস্ত্র নিয়ে আসেন, আমরা সব দখল করে ফেলব। যাই হােক, ৩০ তারিখ দিনের বেলা আমাদেরকে কলকাতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি দেখানাে হল যেখানে আমরা অফিস করতে পারি। সে দিনই ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের বাড়িটা আমরা দেখি। এদিকে কলকাতায় পৌছবার পর তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ২৫ মার্চের আগে একদিন ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু যখন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ মণি, তােফায়েল আহমদ এদেরকে বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন সেই সময় হঠাৎ সেই ঘরে ঢুকতে গিয়ে তার কানে আসে বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতাদের বলছিলেন ‘১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডে গেলে খবর পাওয়া যাবে।’ আরও একটি নাম শুনেছিলেন ‘চিত্ত সূতার’। সেই অলক্ষ্যে শােনা কথার সূত্র ধরে তাজউদ্দীন সাহেব গােলােক মজুমদারকে বললেন ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডে নিয়ে যেতে। আমরা সেই বাড়িতে গেলাম, কিন্তু সেখানে কেউ চিত্ত সূতার বলে কাউকে চেনে না। আমরা ফিরে এলাম। পরে জেনেছিলাম, ওই চিত্ত সূতার ছদ্মনামে সেখানে থাকেন এবং ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর মাধ্যম হিসেবে কলকাতায় কাজ করেন। ৩১ তারিখে আমরা সীমান্ত বিওপিতে গিয়ে আবু ওসমানের সাথে দেখা করে তার হাতে অল্প কিছু অস্ত্র তুলে দেই। এই অস্ত্রটুকু দেয়া বিএসএফ-এর এক্তিয়ারে ছিল। সেখানে একটা মেশিনগান চালানাের ট্রেনিং দেয়া হল। এই সময় অয়্যারলেসে খবর এল বিশাখালিতে যুদ্ধ-অবস্থা, আবু ওসমান চৌধুরী যেন তাড়াতাড়ি চলে যান। আবু ওসমান চৌধুরী সেখান থেকে চলে গেলেন। আমরাও পরে ফিরে এলাম। সেই রাতেই আমরা দমদম এয়ারপাের্টে গেলাম, দিল্লী যেতে হবে। যে প্লেনে আমাদেরকে যেতে হল সেটা কোন সাধারণ প্লেন নয়, ভারতীয় আর্মির কার্গো প্লেন। খুব ধীরে চলে, ফলে কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে, ভেতরে কোন সীটের ব্যবস্থা নেই, খুব প্রচণ্ড রকমের কম্পন এবং শব্দ হয়। মূলত গােপনীয়তা রক্ষা করার জন্যই এভাবে যাবার ব্যবস্থা। আমাদের সাথে গােলােক মজুমদার, শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় ও আর একজন আছেন। দিল্লীতে যখন পৌছলাম তখন ভাের হয়ে এসেছে। সেখানে বিএসএফ-এর একটা গেস্ট হাউসে আমাদেরকে নেয়া হল। সেখানে আমাদের সাথে কর্নেল মেনন এবং ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান কাটল দেখা করতে এলেন আলাদা আলাদাভাবে। পরে শুনেছি, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমাদের দেখা হওয়ার ব্যাপারে র’ চেষ্টা করছিল কিছুটা বাধার সৃষ্টি করতে। আমার মনে হয় এখানে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছিল। যেমন বিএসএফ-এর সাথে আমাদের যােগাযােগ হয়েছে, আমরা বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করছি, বিএসএফ-এর এই যে কৃতিত্ব, এতে যেন অনেকটাই ‘র’-এর পরাজয় হয়ে গেছে—বলতে পারি এটা তাদের দুই ডিপার্টমেন্টের প্রতিযােগিতা। আর দ্বিতীয়ত, যেহেতু চিত্ত সূতারের মাধ্যমে আমরা আসিনি তাই একটা ঝামেলা বাধাবার চেষ্টা করেছে ‘র’। আবার যখন শেখ মণি ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডে পৌছে এবং জানতে পারে তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমি দিল্লীতে চলে গেছি, তখন তারাও বােধ হয় এই ব্যাপারে খুশি হতে পারেনি। কাজেই সব কিছু মিলে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারটা কিছুটা বিলম্বিত হয় এবং বড় করে একটা প্রশ্ন ওঠে, এরাই যে তাজউদ্দীন বা আমীর-উল ইসলাম তার প্রমাণ দিল্লীতে কে দিতে পারে ? এদিকে সেই একই সময় আগরতলা থেকে সেখানকার প্রাদেশিক সরকারের সহায়তায় এম, আর, সিদ্দিকী দিল্লীতে পৌছেন। অ্যাডভােকেট সিরাজুল হক, তিনিও দিল্লী পৌছেন এবং উত্তরবঙ্গ থেকে আব্দুর রউফও দিল্লীতে এসেছেন। এঁদের তিনজনকে যখন ‘র’ থেকে জিজ্ঞেস করেছে যে এখানে তাজউদ্দীন সাহেব এসেছে—তখন তিনজনই বলেছেন তাজউদ্দীন সাহেব মূল ব্যক্তি, যদি তিনিই হন তবে ঠিক আছে। তারপর সিরাজুল হক বাচ্চুকে নিয়ে এসে বােধ হয় একটা দরজার ফাক দিয়ে তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখানাে হয়। তখন সে কনফার্ম করে ইনিই তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ হয়। যতদূর মনে হয় ৪ তারিখের দিকে ইন্দিরা গান্ধী নিজে এসে তাজউদ্দীন সাহেবকে রিসিভ করেন। তাঁকে প্রথম প্রশ্ন করেন, ‘শেখ মুজিব কেমন আছেন?’ তখন তাজউদ্দীন সাহেব বলেন, ‘আমার যখন তার সাথে শেষ দেখা হয় তখন তিনি সমস্ত বিষয় পরিচালনা করছিলেন। তার যে পরিকল্পনা ছিল সে মতই আমাদের কাজ চলছে এবং হাইকমান্ড হিসেবে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। যার যেটা দায়িত্ব সেভাবে কাজ করছি এবং আমি আমার দায়িত্ব হিসেবে এখানে এসেছি।’ তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর এই আলােচনায় একটা কথা তাজউদ্দীন সাহেব খুব স্পষ্ট করে বললেন, এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই। এই ক্ষেত্রে আমাদের যা দরকার হবে তা হচ্ছে, আমাদের মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার জন্য আপনার দেশের আশ্রয়, ট্রেনিংয়ের সমস্ত রকম সুবিধা এবং সে ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য-সহযােগিতা এবং অস্ত্র সরবরাহ। এসব আমাদের জরুরী প্রয়ােজন হবে। আর আমরা যে রকম পরিস্থিতি দেশে দেখে এসেছি তাতে মনে হয় যে দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর শরণার্থী এদেশে ঠাই নেবে, তাদের আশ্রয় এবং আহারের ব্যবস্থা ভারত সরকারকে করতে হবে। বহির্বিশ্বে আমাদের স্বাধীনতার কথা প্রচারের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখবেন এটা আমরা আশা করি।’ এই সবগুলাে ব্যাপারেই শ্রীমতি গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন সাহেবের একটা একাত্মতা গড়ে ওঠে। এই উদ্দীপ্ত কথাটিতেই বােধ হয় শ্রীমতী গান্ধী আরাে বেশি আকৃষ্ট হন যে, এই স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের। এই যুদ্ধটার আন্তর্জাতিকীকরণ যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকা দরকার। এই যুদ্ধকে যেন হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের লড়াই হিসেবে কেউ না দেখায়, কিংবা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ লড়াই হিসেবে কেউ না দেখায়, যা পাকিস্তানের প্রচেষ্টা হবে, সেই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এরপর দ্বিতীয় যে বৈঠক হয় সেখানে শ্রীমতি গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবকে জানান যে, বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে গেছেন। এই কথা শুনে তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যা কিছু করণীয় তা করতে শ্রীমতি গান্ধীকে অনুরােধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী আশ্বাস দেন তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন কূটনৈতিক ক্রিয়াকাস্ত্রে মাধ্যমে এবং তঙ্কালীন সভিয়েট ইউনিয়নের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের উপরে চাপ দেয়া হয় যাতে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে।
শ্রীমতি গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবের মতের সাথে একাত্মতা পােষণ করবার পর মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশের ভেতরে-বাইরে এবং ভারতবর্ষের সাথে সাহায্য-সহযােগিতার সম্পর্ক প্রসারিত করবার প্রয়ােজন এবং সেই সমস্ত দিক বিবেচনায় একটি সরকার গঠন করা অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। সেই সরকার গঠনের ব্যাপারেই আমরা এম, আর, সিদ্দিকী, আব্দুর রউফ এঁদের সাথে আলােচনা করেছি। তারা সবাই একমত হলেন একটা সরকার গঠন এখনই প্রয়ােজন। দিল্লীতে বসেই আমরা কিছু চিঠিপত্র পেলাম। যেমন সৈয়দ সুলতান সাহেবের কাছ থেকে, ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগ সভাপতি রফিক উদ্দিন ভূঞার কাছ থেকে। এই চিঠিগুলােতে লেখা ছিল যেন অবিলম্বে সরকার গঠন করা হয় এবং তাজউদ্দীন সাহেব যেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তখন আমরা সবাই একমত হলাম যে, হাইকমান্ড হিসেবে যেটা কাজ করছিল সেটাই এখন ক্যাবিনেট হিসেবে কাজ করুক এবং তাজউদ্দিন সাহেব তার প্রধানমন্ত্রী হােন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেবের প্রচণ্ড দ্বিধা ছিল নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করানাের বিষয়টিতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি তাে আওয়ামী লীগকে চেনেন না, এটা নিয়ে আওয়ামী লীগে কিন্তু নানা রকম ভুল বােঝাবুঝির চেষ্টা করানাে হবে।’ আমি বললাম, কিন্তু সরকার গঠন করা ছাড়া এই মুহূর্তে তাে আর কোন উপায় নেই। এরপর আমাদের হাইকমান্ডের মতাে করেই আমরা একটি সরকার গঠন করি। আমরা যে সরকার গঠন করেছিলাম তা ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির। যুদ্ধ পরিচালনা করার মত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকারের পরিধি ছােট রাখাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। প্রফেসর রেহমান সােবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান তখন দিল্লীতে উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব, রেহমান সােবহান এবং আমি একসাথে মিলে বক্তৃতার একটা খসড়া তৈরি করি। তাজউদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন, যার কিছু অংশ রেহমান সােবহান এবং কিছুটা আমি লিখি । এই সময় তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কথাবার্তা বলে মিলিয়ে দেখা হচ্ছিল যে বক্তব্যের কথাগুলাে রাজনৈতিকভাবে ঠিক হচ্ছে কিনা। তিনি নিজেও কোন পয়েন্ট যােগ করছিলেন, কোনটা বাদ দিচ্ছিলেন। এভাবেই আমরা একটি খসড়া বক্তৃতা প্রথমে ইংরেজিতে লিখি, তারপর বাংলায় অনুবাদ করা হয়। দিল্লীতে বসেই বক্তৃতাটি টেপে ধারণ করা হয়। এই টেপটির মুখবন্ধে আমার কণ্ঠে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ধারণ করা হয়। দিল্লীতেই সীলমােহর তৈরি করা হয় যেটা আমারই হাতের আঁকা, চারিদিকে গােলচক্র, মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র। তাজউদ্দীন সাহেব এটি অনুমােদন করেন। আমরা সেই মনােগ্রামসহ লেটারহেড ছাপিয়ে ফেলি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লিখে। একটি সরকারের প্রাথমিক যে বিষয়গুলাে থাকে তার প্রায় সব ঠিক করে ফেলি। আমরা যাতে যােগাযােগের জন্য সীমান্ত এলাকাগুলােতে যেতে পারি সেই জন্যে মিসেস গান্ধী একটা ছােট প্লেনের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল নগেন্দ্র সিংকে আমাদেরকে সমর বিষয়ে সহায়তা করার জন্য উপদেষ্টা হিসেবে দিলেন।
Reference:
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এর সাক্ষাৎকার
তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অন্ততধারা | সিমিন হোসেন রিমি
সংগ্রামের নোটবুক
ড্রয়িং – গৌরব, সংগ্রামের নোটবুক
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!