বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৪শে সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ৭ই আশ্বিন, ১৩৮১
শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন–
দেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতীয় উৎপাদন নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে শ্রমজীবী মানুষ তাদের বক্তব্য রেখেছেন। পাশাপাশি বক্তব্য এসেছে অন্যান্য মহল থেকেও। কেউ বলেছে অপদার্থ প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের ফলে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, কেউ বলেছে শ্রমিকদের অলসতা এবং অকর্মতাই উৎপাদন হ্রাসের কারণ। কাঁচামালের অভাব এবং প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানিতে সরকারি ব্যর্থতাকেও দায়ী করেছে অনেকে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা তথা তার উন্নতি এবং অবনতির উপায় ও কারণ নিয়ে গোটা জাতির অভিমত বিভক্ত। সুযোগ বুঝে তালবাজরা মোক্ষম কথাটা ছুড়ে মারতেও কসুর করেনি। তাদের মতে সব ব্যবস্থার মূল কারণ সরকারের জাতীয়করণ নীতি।
আমরা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বক্তব্যকে সবসময় অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ আমরা জানি হাওয়ায় পাঞ্জাবি উড়িয়ে যারা হরহামেশাই উৎপাদন সমস্যার নানা সমাধান দিয়ে থাকেন তারা প্রায় সবাই চিমনির ধোঁয়া এড়িয়ে যাওয়ার লোক। শিল্পাঞ্চলের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তাদের কোনো পরিচয় নেই। পুঁথিগত বিদ্যা আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটা পূর্বধারণাকে সামনে রেখে তারা বক্তব্য ঝাড়তে অভ্যস্ত। আমাদের এই বিশ্বাস সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনই যখন দেখা গেছে নিজেদের অযোগ্যতা এবং অসাধুতার ঢাকা দেবার জন্য প্রশাসক আমলাদের একটা বড় অংশ সকল দোষ শ্রমিকদের ঘাড়ে চাপাবার অপচেষ্টা চালিয়েছে। রাষ্ট্রায়াত্ত কল কারখানার মালিক বলতে চান এমন লোকেরা যখন জাতীয়করণকেই এই সব সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। আর রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেই শ্রমিক শ্রেণীর অংশীদারিত্ব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার জন্য একশ্রেণীর লোক গোটা শ্রমজীবী মানুষকে দায়িত্বজ্ঞানহীন অসৎ বলে চিহ্নিত করবার প্রয়াসের মেতেছেন। শ্রমিক সমাজ পূর্বাপর দুটি বিষয়কে উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করে আসছেন। তাদের মতে শিল্প ব্যবস্থাপনা সৎ আদর্শনিষ্ঠ প্রশাসন কর্মী নিয়োগ ও শ্রমিকদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা এবং কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতি সরবরাহ অব্যাহত রাখা একমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে।
আমরা তাদের এই বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণরূপে একমত। স্বাধীনতার পর থেকে এই কথাই আমরা বারবার বলে আসছি। অবশ্য একশ্রেণীর শ্রমিক নামধারী টাউটদের অসাধুতা এবং উশৃংখলতা জন্য যে কোন কোন স্থানে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে না সে কথা আমরা বলি না। তবে তা প্রতিরোধের জন্য সুষ্ঠু সাংগঠনিক এমনকি প্রয়োজনে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গৃহীত হতে পারে।
গত রোববার শ্রমিকলীগের দু’দিনব্যাপী কার্যকরী সংসদের অধিবেশন শেষে উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ পুনরায় গুরুত্ব আরোপ করে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। বলা হয়েছে শিল্পাঞ্চলের শান্তি অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা।
জাতীয় উৎপাদনের গুরুত্বের কথা স্মরণে রেখে সরকার কলকারখানায় ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু একশ্রেণীর প্রশাসক সেই নিষিদ্ধ আদর্শের সুযোগ গ্রহণ করে একতরফাভাবে কলকারখানায় লে-অফ ঘোষণা করেছেন। এটা শিল্পাঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করার ব্যাপারে ইন্ধন যোগাবে বলে আমাদের ধারণা। অবিলম্বে সরকারের এদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেয়া উচিত।
এমনিতে বাজারের অবস্থা কল্পনারও বাইরে। হু হু করে দাম বাড়ছে চাল, ডাল, তেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির। এমতাবস্থায় শ্রমিকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের যেসব সংস্থান মজুরি কমিশনের রিপোর্টে দেখা হয়েছিল তাও কার্যকর হয়নি। আমরা আশা করব অবিলম্বে তাদের সে সরকার ঘোষিত সুযোগ-সুবিধা টুকু অন্তত দেয়া হবে।
উৎপাদন আসলেই আমাদের দেশের এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ দিকটির দিকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব নিয়ে নজর দেয়া হয়েছে বলে আমরা মনে করি না। আজ পর্যন্ত একটা শ্রমনীতি ঘোষণা করা হয়নি। শ্রমিকদের নিয়ে ম্যানেজমেন্ট করার চেয়ে সরকারি নীতি সেই স্বাধীনতার গোড়ার দিকে ঘোষণা করা হয়েছিল তা বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী সরকার যে যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি করেছেন তাও আমলাতান্ত্রিক ফর্মালিটিজ এর হাত গলিয়ে সঠিক সময় কারখানায় গিয়ে পৌঁছেছে না। এসব ব্যাপারে সুষ্ঠু কর্মোদ্যোগ ও নীতি প্রণয়ন করে শুধু আহ্বান জানিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। শ্রমিক লীগের কার্যকরী সংসদের সভায় শ্রমজীবী মানুষের বক্তব্য আর একবার সবার সামনে এসেছে। সেই বক্তব্য উপলব্ধি করবার সময় এক্ষুণি। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ দিকটা ভেবে দেখবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক