পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সফর বিরােধী আন্দোলন
পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সফরের প্রতিবাদ ও বাধা সৃষ্টির বিষয়ে সহযােগিতার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দক্ষিণ-আফ্রিকার বর্ণবাদী ক্রিকেট টীমের বৃটেন সফরের বিরুদ্ধে নেতত প্রদানকারী নেতা যুব ইউনিয়নের সভাপতি পিটার হেইনের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে। ঘােষিত প্রােগ্রাম মােতাবেক ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১ বিকেল ৪টায় পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের লন্ডন অবতরণের কথা ছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও এ্যাকশন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের আগমনের প্রতিবাদে হিথরাে বিমান বন্দরে সমাবেশ ও বিক্ষোভের আয়ােজন করে। ধারণা করা হয় যে, বিমান বন্দরে অপ্রীতিকর ঘটনাকে এড়ানাের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান তাদের টীমের আগমন তারিখ স্থগিত ঘােষণা করে। লন্ডনে ক্রিকেট সফরের বিরুদ্ধে আয়ােজিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রেস কনফারেন্স এবং পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের আগমন স্থগিত করার খবর বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় একই দিনে প্রকাশিত হয়। বাধাবিপত্তি এড়ানাের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান টীম গােপনে তাদের আগমনের তারিখ নির্ধারণ করে। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের আগমনে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যথাযােগ্য কর্মসূচী গ্রহণ করে। পূর্ব নির্ধারিত তারিখের পরিবর্তে ২৭ এপ্রিল সকালে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের লন্ডন অবতরণের পরিবর্তিত সময়সূচী বাঙালীদের যে কোন পদক্ষেপকে এড়ানাের জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাঙালীদের চেতনা তখন এতই প্রখর ছিল যে, শীতের সকালের আমেজকে পরিহার করে প্রত্যুষেই শত-শত বাঙালি পাকিস্তান টীমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য হিথরাে বিমান বন্দরে উপস্থিত হন। বিলাতের পত্র-পত্রিকা পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের বৃটেন সফর বিরােধী প্রবাসী বাঙালালে প্রতিরােধ কর্মসূচীর খবর প্রকাশ করায় পাকিস্তান দূতাবাস বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সহযােগিতায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে।
এয়ারপাের্টের আগমন পথে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানাের জন্য এয়ারপােটের ভেতর থেকেই গাড়ীতে করে পেছনের পথ দিয়ে পাকা” টমিকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ খবর যখন অপেক্ষমান বিক্ষোভকারীরা জানতে তখন বিক্ষুব্ধ বাঙালীরা হিথরাে বিমান বন্দরে অবস্থিত পি. আই. এ’ এর কাউন্টার করে তা তছনছ করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের ফাঁক দিয়ে তুমুল বিক্ষোভের পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের আগমনের খবর বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আহ, এ’ এর কাউন্টার আক্রমণ। ইমুল বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে পর্ব নির্ধারিত ২৪ এপ্রিলের পরিবর্তে ২৮ এপ্রিল পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সম্মানে a স্পীকিং ইউনিয়নের উদ্যোগে এক সংবর্ধনার আয়ােজন করা হয়। ইতােপূর্বে ছাত্র শাম পরিষদ হত্যাকারী পাকিস্তানের টমিকে মানবতার কারণে সংবর্ধনা না দেয়ার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সেই অনুরােধ উপেক্ষা করে ইংলিশ স্পীকিং ইউনিয়ন তাদের নির্ধারিত সংবর্ধনা বাকলী স্কোয়ারের কাছে ২৭ নং চার্লস স্ট্রীটে আয়ােজন করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং এ্যাকশন বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে চার্লস স্ট্রীটে ইউনিয়ন অফিসের সামনে সন্ধ্যা ৬ টায় পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের বিরুদ্ধে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। লন্ডনের শত শত বাঙালি এবং এ্যাকশন বাংলাদেশের স্থানীয় সদস্যরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে সংবর্ধনায় গমনের গেটে অবস্থান গ্রহণ করে। প্ল্যাকার্ডে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ কর’ ইয়াহিয়া খান ধ্বংস হােক ক্রিকেট রাজনীতি বন্ধ কর” এবং “বাংলাদেশের। মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে চল” ইত্যাদি শ্লোগান লিখিত ছিল। নির্ধারিত সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেট টীম সংবর্ধনা স্থলে উপস্থিত হলে বিক্ষোভকারীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। বৃটিশ পুলিশ পাকিস্তান টীমকে সংবর্ধনা স্থল থেকে দূরে একটি ছােট স্কোয়ারে অপেক্ষা করতে বলেন। এসময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের বেস্টনী অতিক্রম করে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমকে আক্রমণের চেষ্টা চালায়। বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের ধস্তাধস্তিতে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় এবং এই পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্য থেকে মিস সুরাইয়া খানম ও মিসেস রাজিয়া চৌধুরী পুলিশের বেস্টনী অতিক্রম করে ছুটে গিয়ে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের অধিনায়ককে নাজেহাল করে। পুলিশের হস্তক্ষেপে সুরাইয়া খানম ও রাজিয়া চৌধুরীকে নিবৃত্ত করা হয় । বিক্ষোভের মারমুখী চরিত্র দেখে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সংবর্ধনা স্থলে মহিলা পুলিশসহ আরাে অধিক পুলিশ ডেকে পাঠান। সংবর্ধনা স্থলের গেট থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ ব্যাটন চার্জ করেও সফল হতে পারেনি।
অতঃপর পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের খেলােয়াড়দেরকে ছােট ছােট গ্রুপে ভাগ করে পুলিশ ঘেরাও (কর্ডন) করে তাদেরকে গেট দিয়ে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। এসময় পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ধস্তাধস্তিতে বিশংখলা সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে কয়েকজন খেলােয়াড় বিক্ষোভকারীদের হাতে নাজেহাল হয়। সংবর্ধনায় নিমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক নাসিম আহমেদ (পরবর্তিকালে ভুট্টো সরকারের মন্ত্রী) সংবধনা স্থলে পৌছলে বিক্ষোভকারীদের হাতে চরমভাবে লাঞ্ছিত হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, নাসিম আহমেদ বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী মহলে বাংলাদেশের গণহত্যাকে সমর্থন করে পাকিস্তান “রের পক্ষে বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়ে বাঙালীদের কাছে অত্যন্ত বিরাগভাজন ব্যক্তি হিসাবে। পরিচিত ছিলেন। লশের সাথে সংঘর্ষ, পুলিশের ব্যাটন চার্জ ও পাকিস্তানী খেলােয়াড়দের সংবর্ধনা স্থলে যশে বাধাদানকালে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্য থেকে মােট ৩৫ জনকে পুলিশ তার করে। পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করা হলেও বিক্ষোভকারীরা পিছপা হয়নি এবং তারকে বরণ করে নিয়ে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছে। গ্রেফতারকৃত ৩৫ জনকে পরের দিন অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল কোর্টে হাজির করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা সকলেই কৃতকর্মের কথা স্বীকার করে বিবৃতিতে বলেন যে, যখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গ্রুপ পরিচালনা করছে তখন ক্রিকেট টীমকে পাঠিয়ে পাকিস্তান বিশ্বজনমতকে অন্য এ প্রবাহিত করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই বিক্ষোভকারীরা বিশ্বকে পাকিস্তান সরকারের হত্যাকারী পরিচয়কে তুলে ধরার জন্যই বিক্ষোভ করেছে এবং পুলিশের গ্রেফতারকে মেনে নিয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা আরাে জানায় যে, তারা বৃটিশ আইন অমান্য করার উদ্দেশ্যে না বরং জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানীদের প্রতি ঘণ প্রকাশের লক্ষ্যে বিক্ষোভে জংগী রূপ ধারণ করেছিল। অতঃপর কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক গ্রেফতারকৃতদের দেশপ্রেমিক স্বীকাররােক্তিতে খুশি হয়ে প্রত্যেককে নামমাত্র ৫ পাউন্ড জরিমানা আদায় করে মুক্তি দানের আদেশ প্রদান করেন। ২৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ক্রিকেট সফর বিরােধী বিক্ষোভের ছবি এবং মন্তব্যসহ খবরাখবর বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় (দি টাইমস, ২৯-৩-৭১)। ২৫ মার্চের পর পর্যায়ক্রমে কয়েকদিন বাংলাদেশের খবর পত্র-পত্রিকায় স্থান পাওয়ার পর প্রবাসী বাঙালীরা ২৯ এপ্রিল পুনরায় বাংলাদেশের ইস্যুকে বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রথম পাতায় স্থান করে দেয়। বিলাতে ইতিমধ্যে সংগঠিত বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের ক্রিকেট সফরের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণ করে।
বৃটেনের বিভিন্ন শহরে পাকিস্তান ক্রিকেট দল যেন নির্বিবাদে বা বাধাহীনভাবে খেলতে না পারে তার জন্য প্রত্যেক খেলার দিনে মাঠের বাইরে বিক্ষোভ ও কালাে পতাকা প্রদর্শন এবং মাঠের ভেতরে প্রতিরােধ সৃষ্টি করার কৌশল গ্রহণ করা হয়। প্রথম শুভেচ্ছামূলক খেলাটি অনুষ্ঠিত হয় ১ মে, বিলাতের একটি ছােট শহর উরসেস্টারে। উক্ত শহরে বাঙালি বসবাসকারীদের সংখ্যা নগণ্য। হওয়ার কারণেই সম্ভবত প্রথম শুভেচ্ছা খেলাটি এই শহরে আয়ােজন করা হয়। বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বিলাতের বাঙালি আন্দোলনরত সংগঠনসমূহ উরসেসটারে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে দলে দলে উরসেসটারে গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। খেলার দিনে উরসেসটারে তুমুল প্রতিবাদ ও বিক্ষাভের মুখে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে খেলা শুরু করতে হয়। প্রথম দিনে এই খেলায় বিক্ষোভের কর্মসূচী দু’ভাগে নেয়া হয়। সমবেত বাঙালি বিক্ষোভকারীদের একটি দল মাঠের বাইরে সর্বক্ষণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন এবং পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞের ও বর্বরতার কাহিনী সম্বলিত লিফলেট দর্শকদের মনে বিতরণ করেন। অপর একটি দল টিকেট ক্রয় করে মাঠের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং পকেটে কালাে পতাকা ও কম দামের ক্রিকেট বল নিয়ে দর্শকদের গ্যালারিতে অবস্থান অ করে। পাকিস্তান দল প্রথমেই ব্যাট করতে নামলে তাদের বিরুদ্ধে কালাে পতাকা প্রদ করা হয়। পাকিস্তানের ওপেনিং ব্যাটসম্যানকে লক্ষ্য করে যখন প্রথম বলটি ছোড়া হয় তখন শত শত ক্রিকেট বল গ্যালারী থেকে মাঠে প্রবেশ করে এমতাবস্থায়, কিছু সময়ের জন্য। খেলা স্থগিত করতে বাধ্য হয়। মাঠের অভ্যন্তরে অধিক সংখ্যক পুলিশের ব্যবস্থা করে খেলা পরিচালনা করা হলেও বেশ কয়েকবার খেলা বাধার সম্মুখীন হয়। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে এই নবতর ভাষা বিলাতের পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়।
৩ জুন, ১৯৭১ইং তারিখ থেকে বার্মিংহামের এজবাষ্টনে পাকিস্তানের ক্রিকেট টেষ্ট খেলা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৫ সপ্তাহ পূর্বে পাকিস্তান টীমকে প্রেরণ করে বিভিন্ন শহরে শুভেচ্ছা খেলার আয়ােজন করে বিলাতে জনমতকে পাকিস্তানের গণহত্যা’ থেকে অন্য খাতে পরিচালনা করার এক কূটনৈতিক কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই পাকিস্তানের এই কূটকৌশলকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে প্রবাসী বাঙালীরা পাকিস্তান ক্রিকেট সফরকে প্রতিবাদ ও সর্বত্র নাজেহাল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বার্মিংহামের এসবেষ্টনে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ক্রিকেট দলের প্রথম টেষ্ট খেলা উপলক্ষে হত্যাকারী পাকিস্তান দলের সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য ৫ জুন, ১৯৭১ তারিখে বার্মিংহামে এক সমাবেশ ও গণমিছিলের আয়ােজন করা হয়। বার্মিংহামের। এডওয়ার্ড রােডে “ক্যালথােৰ্প পার্ক” এর সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বার্মিংহামের বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি জগলুল পাশা। ইতােপূর্বে কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূইয়া এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খন্দকার মােশাররফ হােসেন (লেখক) উক্ত সমাবেশে ও গণমিছিলে যােগদানের জন্য লন্ডন ও বার্মিংহামের আশেপাশের শহরের বাঙালীদের কাছে আহ্বান জানান। লন্ডনসহ বিভিন্ন শহর থেকে উক্ত সমাবেশে হাজার হাজার বাঙালি যােগদান করেন এবং সমাবেশ শেষে বিরাট গণমিছিল। এ্যাসবেষ্টন ক্রিকেট মাঠের চতুর্দিকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে বাঙালীদের বিক্ষোভ ও সমাবেশ বার্মিংহামের জনগণের মধ্যে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর ফলে বার্মিংহামের লর্ড মেয়র এ্যালডারম্যান ভিক্টর চারটন প্রথম টেষ্ট খেলার ব্যাটটিতে উভয় দলের অধিনায়কদের অটোগ্রাফ নিয়ে তা নিলামে বিক্রি করে তার অর্থ বাঙালি উদ্বাস্তু শিবিরে ‘কলেরা রিলিফ ফাণ্ডে’ প্রেরণের এক মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই মহান উদ্যোগে সাড়া দিয়ে বৃটিশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক অটোগ্রাফি প্রদান করেন। কিন্তু পাকিস্তান দূতাবাসের নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক অটোগ্রাফ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অগত্যা এক দলের অটোগ্রাফ নিয়েই ব্যাটটি নিলামে দেয়া হয় এবং তার থেকে সংগৃহিত অর্থ বাঙালীদের সাহায্যার্থে রিলিফ ফাণ্ডে প্রেরণ করা হয়। এই ঘটনায় পাকিস্তানীদের হীনমনােবৃত্তির জন্য বিলাতের পত্র-পত্রিকা “ম সমালোচনা করে। ইয়ং লিবারেল দলের রাজনৈতিক ভাইস চেয়ারম্যান সাইমন ২৬৮ উপরােক্ত ঘটনার মন্তব্য করতে গিয়ে পাবিস্তানের কর্তৃপক্ষকে হীনমানসিকতাপূর্ণ। অমানবিক আখ্যায়িত করে বলেন যে, উক্ত সফরের বিরােধিতা করে বাঙালীরা যে নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তা যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত। (দি গার্ডিয়ান, ৯-৬-১৯৭১)। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অপর উল্লেখযােগ্য টেষ্ট খেলা অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে । লন্ড টেষ্ট খেলার প্রতিবাদ জানানাের জন্য বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও কেন্দ্রীয় স্টিয়ারি কমিটির যৌথ উদ্যোগে ১৯ জুন, ১৯৭১ তারিখে হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে জনসভা, বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ভ্রাম্যমান বৈদেশিক প্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বৃটিশ এম, পি, ও প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শাের, ইয়ং লিবারেল দলের সভাপতি পিটার হেইন, বিলাতে সফররত মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি এম, এন, এ, আবদুল মান্নান, | শ্রমিক লীগের মােহাম্মদ শাহজাহান এবং বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ শেষে একটি বিরাট বিক্ষোভ মিছিল শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এছাড়া লন্ডনের টেস্ট খেলার বিরােধিতা করে লর্ডস ক্রিকেট মাঠের সামনে গউস খানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কাউন্সিল ফর লিবারেশন অব বাংলাদেশ” এর উদ্যোগে এক | বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন গউস খান, তৈয়বুর রহমান ও আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ২৬ জুন, ১৯৭১ তারিখে মানচেষ্টারে অনুষ্ঠিত লাংকাশায়ারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অপর এক খেলার দিনে ম্যানচেষ্টার সংগ্রাম পরিষদ অনুরূপ বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করে। বাঙালীরা ম্যানচেষ্টার শহর কেন্দ্র থেকে মিছিল করে ওলড ট্রাফোর্ড ক্রিকেট মাঠে সমবেত হয় এবং ক্রিকেট দলের সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এমনিভাবে বিলাত সফরকালে পাকিস্তান টীম সর্বত্র বাধার সম্মুখীন হয় এবং বাঙালীরা পাকিস্তানের রক্তমাখা চেহারা তুলে ধরতে সমর্থন হন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন