বাংলার বাণী
ঢাকা : ৪ঠা অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৭৪, ১৭ই আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
বেলুচিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ : গণহত্যা
শত হুমকি হুঙ্কার বেলুচ জনগণের স্বাধিকার চেতনাকে এতটুকু খর্ব করতে পারেনি। বরং তা দিনের পর দিন আরো প্রচন্ড রূপ ধারণ করছে। এর আগে বেলুচ মুক্তি সংগ্রামীরা আত্মসর্মপণ করছে বলে পাকিস্তান সরকার যে দাবী করে আসছিল বেলুচিস্তানের সাবেক গভর্ণর জনাব আকবর বুগতি তাও স্রেফ ধাপ্পা বলে উল্লেখ বলেছেন, সেখানে আইনানুগভাবে গঠিত ন্যাপ সরকারকে উচ্ছেদ করবার পর যাদের ধরপাকড় করা হয়েছিল তাদেরই পাকিস্তান সরকার আত্মসমর্পণকারী বলে আখ্যায়িত করছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বেলুচিরা আগের চাইতে অনেক বেশী দৃঢ়তার সাথে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে সংকল্পবদ্ধ। বিভিন্ন সূত্রে সেখানকার সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে করে বেলুচিদের যে শুধু হুমকি আর হুঙ্কার ছেড়ে স্তব্ধ করা যাবেনা এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা চলে।
এদিকে জাতিসংঘে আফগানিস্তানের প্রতিনিধি কুর্ট ওয়াল্ডহেইমকে লেখা প্রধানমন্ত্রী সর্দার দাউদের একটি চিঠি সকল সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। ঐ চিঠিতে জনাব দাউদ বেলুচিস্তানে পাকিস্তান সরকারের বেপরোয়া বোমাবর্ষণের ঘটনা তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার অভিযোগ, বালুচ মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে বিশেষ করে বেলুচিস্তানের বৈধ নির্বাচিত সরকারকে বলপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই পাকিস্তান সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যার নীতি অনুসরণ করে চলেছে। আফগান সরকারের তরফ থেকে ঐ চিঠিতে আশা প্রকাশ করা হয়েছে বেলুচিস্তানে এই ন্যক্কারজনক নীতি বাস্তবায়ন থেকে পাকিস্তানকে বিরত রাখার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায় আশু ও জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
শান্তিকামী সকল মানুষ সর্দার দাউদের এই অভিযোগে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেনা। শুধু সর্দার দাউদই নয় খোদ পাকিস্তানী নেতারাও তাদের তাদের সরকারের বিরুদ্ধে ঐ একই অভিযোগ করে চলেছে। সেখানকার জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান অভিযোগ করেছেন পাক সেনাবাহিনী গত ২৫শে আগস্ট বেলুচিস্তানে চার শ’ লোককে হত্যা করেছে। পাল্টা আক্রমণও চলছে বেলুচ গেরিলাদের পক্ষ থেকে। ইতিমধ্যে বহুসংখ্যক পাক সেনা তাদের হাতে মৃত্যু বরণ করেছে।
বেলুচ এবং পাঠানদের স্বাধিকার দাবী পাকিস্তানের বয়ঃকালের মতোই পুরনো। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই বেলুচ এবং পাঠানরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দাবী করে আসছে। কিন্তু বরাবরই তাদের এ দাবীর জবাব দেয়া হয়েছে বন্দুক কামান দাগিয়ে। এতে করে সাময়িকভাবে তাদের কন্ঠ স্তব্ধ করা গেলেও পুনরায় তারা সোচ্চার হয়েছে ঐ একই দাবীতে। সর্বশেষে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধিরা যখন নির্বাচিত হয়ে সেখানে গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করেন তখন তারা আশা করেছিল তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবার সরকারী নীতিতে ঘটবে। বেলুচ সরকারও গণমুখী নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে অগ্রসর হন। এতে বিক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় চক্র সেখানকার আইনানুগ সরকারকে উৎখাত করে নিরীহ নিরস্ত্র বেলুচদের উপর চালান অমানুষিক অত্যাচার। গণতান্ত্রিক সমঝোতার পথ গ্রহণ না করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বেলুচদের ঠেলে দেয় সশস্ত্র সংগ্রামের পথে।
সেই সংগ্রাম চলছে। ভুট্টোর সরকার বলেছেন পনেরোই অক্টোবরের মধ্যে যদি গেরিলারা আত্মসমর্পণ না করে তবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করা হবে। আমরা মনে করিনা বিরোধ মীমাংসায় এই হুমকি কোনো কাজে লাগবে। সামরিক অভিযানকে আরো বলশালী করার চাইতে গণতান্ত্রিক পন্থায়ই একমাত্র বেলুচ বিরোধের মীমাংসা করা যাবে। সে পথে এগুবেন কিনা সেটা পাক সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কিন্তু সেই সরকার এবং সেখানকার রাজনৈতিক মহলে এমন অনেক লোকই আছেন যারা বেলুচ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষপাতী।
অর্থ : সার সমাচার
দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যে বাস করে ‘সারের অভাবে চাষীদের মাথায় হাত’ সংবাদ পড়বার মতো দুর্ভাগ্য সম্ভবতঃ একমাত্র বাংলাদেশের পাঠকদেরই আছে। খাদ্যাভাব ও দিনশেষে ভিক্ষুকের ঝুলি শূন্য থাকার অবস্থা থেকেই দুর্ভিক্ষাবস্থা কথার সৃষ্টি এবং সরকার ও আমরা জনগণ অচিরেই এ অচলায়তন থেকে মুক্তির পথ খুঁজছি। গত বছরের ‘বাম্পার ক্রপ’ এরপরও আমরা দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। তদুপরি সর্বনাশা বন্যা মাঠের কচি ধানগুলো ভাসিয়ে নেয়ার পর আবার নতুন কর্মোদ্যমে সেই বিরান ও শূন্য মাঠে ফসল বুনতে শুরু করেছে সর্বংসহা গ্রাম-বাংলার কৃষক। বুকে আশা, বিভিন্নমুখী সংকট আর দুর্যোগ থেকে উত্তরণের পর মাঠের কচি ধানের চারাগুলোতে আস্তে আস্তে সবুজের পরশ লেগে দু’মাস পর সুপুষ্ট ধানের শীষগুলো মাথা দুলিয়ে নবান্নের আগমনী ঘন্টা বাজাবে। এখন শুধু প্রয়োজন পর্যাপ্ত সারের। অথচ চাষীরা সার পাচ্ছে না। ঘোড়াশাল কারখানা বিস্ফোরণের পর কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের গুদাম থেকে সকল প্রকার সার সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে পরিবেশিত খবরে প্রকাশ। সরবরাহ বন্ধ করার কারণ দেখান হয়েছে প্রধানতঃ দু’টো। এক—গুদামে কত সার আছে তার হিসাব-নিকাশ করতে হবে, দুই—সরবরাহ বন্ধের আগে চাষীদের মধ্যে বিতরণের জন্য তালিকাভুক্ত ডিলারদের কাছে প্রদত্ত সার চাষীদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম এবং তা পর্যাপ্ত।
সুতরাং কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন সবদিক বিবেচনা করেই সার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং সম্ভবতঃ কর্মকর্তারা মোটামুটিভাবে আত্মপ্রসাদ নিচ্ছেন যে, তারা একটি বিজ্ঞজনচিত কাজ করেছেন। আমাদের সব চাইতে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দেশের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই কোনোদিন। তাই খাতা-কলম ও ‘থিওরী’র উপর নির্ভরশীল কর্মকর্তাদের অধিকাংশ নীতিই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে এবং ভ্রান্ত নীতির ফলে উদ্ভূত সমস্ত দায়-দায়িত্বই যেয়ে পড়েছে দেশের নিরীহ জনসাধারণের উপর।
কর্তাদের সার সরবরাহ বন্ধের আগে ভেবে দেখা উচিত ছিল, সরবরাহ বন্ধ হলেই বাংলাদেশে পণ্যসামগ্রী বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় এবং কালোবাজারে চড়াদামে বিক্রি হয়। দেশের বর্তমান এই একই অবস্থার পথ ধরে সার সরবরাহে নিয়োজিত একশ্রেণীর অসাধু ডিলার নিজস্ব গুদামে থেকে সার সরিয়ে ফেলবে এবং কালোবাজারে তা চড়াদামে বিক্রি করবে। নোয়াখালীর মাইজদীকোর্ট থেকে পাঠানো এ সম্পর্কিত একটি খবর গতকাল প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি সংবাদপত্রে। খবরে বলা হয়েছে, সস্তায় সার সরবরাহের দাবীতে নোয়াখালী জেলার কৃষকরা সেখানে মিছিল করেছেন। চল্লিশ টাকা মণ দরের সার অসাধু ডিলাররা একশ’ পঁচিশ থেকে একশ’ পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে, অথচ কালোবাজারে চড়াদামে সার কেনবার সামর্থ কৃষকদের নেই। সুতরাং বর্তমান আমন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।
অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ফল যা হয় তাই হয়েছে। অথচ হিসাব-নিকাশের দোহাই দিয়ে সার সরবরাহ বন্ধ রাখার কোনোই প্রয়োজন ছিলনা। খবরে জানা গেছে, কিছুদিনের মধ্যেই নাকি আবার সার দেয়া শুরু হবে কর্পোরেশনের গুদাম থেকে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন : অজস্র অর্থ ব্যয় করে এসব কর্মীদের পোষা হচ্ছে কেন? তারা সময়মতো হিসাব-নিকাশ রাখতে পারেননি কেন? ব্যক্তি বিশেষের শৈথিল্যের দরুণ দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষককে আজ সারের অভাবে মাথায় হাত দিতে হচ্ছে কেন? এই সারের অভাবজনিত কারণে সারাদেশে আগামী বছরের খাদ্য ঘাটতিতে কর্পোরেশনের বিজ্ঞ কর্মকর্তারা কতখানি প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করলেন তা তারা একটুখানি ভাবুন তো! হিসাব-নিকাশের জন্য সমগ্র দেশে সার সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত একটা বালখিল্য আচরণ ছাড়া আর কিছু নয় আমাদের কাছে এবং আমরা জানতে চাই এই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় তারা দিলেন কেন?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক