You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিলাতের পত্র পত্রিকার ভূমিকা নভেম্বর ‘৭১

১ নভেম্বর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর সম্মানে ইন্ডিয়া লীগ আয়ােজিত সভায় তার বক্তৃতার বরাত দিয়ে বলা হয় যে, ৯০ লক্ষ শরণার্থী রক্ষণাবেক্ষণ ও সীমান্ত পরিস্থিতি এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। মিসেস গান্ধী অবস্থাকে আগ্নেয়গিরির সাথে তুলনা করে বলেন যে তার বিস্ফোরণ যে কোন সময় ঘটতে পারে। দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একই দিনে ডেভিড লােশাক প্রেরিত এক সংবাদ সমীক্ষায় একের পর এক পাকিস্তান সরকারের হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান যে একটি চরম সংকটে নিপতিত হয়েছে তার বিস্তারিত আলােচনা করা হয়। ৩ নভেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ কর্তৃক প্রেরিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ ও আক্রমণের ফলে পাকিস্তানী ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয় যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৪০ হাজার মুক্তিযােদ্ধা গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীকে ব্রিত অবস্থায় রেখেছে। শহর অঞ্চলেই মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে গড়ে ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হচ্ছে এবং জনসমর্থনের কারণে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্ষমতা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও খবরে মন্তব্য করা হয়। ৪ নভেম্বর একই পত্রিকায় ঢাকা থেকে প্রেরিত খবরে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪টি ইউনিটের মধ্যে ৩টি ইউনিট বিধ্বস্ত হওয়ার সংবাদ প্রচারিত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ইউনিফরম পরিধান করে ছদ্মবেশে এই দুর্দান্ত আক্রমণ পরিচালনা করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিধ্বস্ত হওয়ায় ঢাকা ও আশেপাশের শিল্প এলাকা অকেজো হয়ে যায়। এই খবরে প্রবাসীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।  ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় ৮ নভেম্বর তারিখে উপমহাদেশে উত্তেজনা এবং মিসেস গান্ধী ও মিঃ ভুট্টোর আন্তর্জাতিক সফরের মূল্যায়ন করে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে বলা হয়, মিসেস গান্ধী তার সফরকালে বাংলাদেশ সমস্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি লাভ করেছে বলে প্রতিয়মান হয়। পক্ষান্তরে মিঃ ভুট্টো চীন সফর শেষে পাকিস্তানের সরাসরি সমর্থনে চীনের কোন সরকারী বিবৃতি আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ায় উপমহাদেশের সংকটে পাকিস্তানের কূটনৈতিক বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরা হয়।

৯ নভেম্বর দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় উপমহাদেশে সৃষ্ট ঘটনা প্রবাহ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে পাকিস্তানের সেনাপতিদের একগুয়েমি ও নির্বুদ্ধিতার জন্য তারা আজ ধ্বংসের শেষ উপনীত হয়েছে  এখন আলােচনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে বিদায় নিতে হবে।  নতুবা যুদ্ধ ঘোষণা করে পরাজিত হতে হবে। বাংলাদেশ সমস্যা এমন এক যার ফলে পাকিস্তানের কাছে বিকল্প তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নাই বলে পর্যায়ে এসেছে যার ফলে পাকিস্তা সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়।  ৯ নভেম্বর ‘দি ডেইলি নভেম্বর “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী আগ্রাসনের সর্বশেষ সুতি নিয়ে একটি সম্পদকীয় ছাপা হয়। সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, ইয়াহিয়া খান আন্তর্জাতিকভাবে ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছে। তাই ইয়াহিয়া খানের উচিৎ শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সাথে একটি রাজনৈতিক সমাধানের নতুন প্রচেষ্টা চালানাে। পূর্ববঙ্গে প্রতিনিয়ত যেভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে তাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার জন্য। পাকিস্তান হয়তাে কাশ্মীর সমস্যাকে সামনে এনে সেই ফ্রন্টে যুদ্ধ ঘােষণা করতে পারে। কিন্ত তার সম্ভাবনা ও ক্ষীন হয়ে গেছে মি, ভূট্টোর ব্যর্থ চীন সফরের পর। সম্পাদকীয়ের এক অংশে বলা হয়েছে— Fortunately. it looks as though Mr. Bhutto’s mission to Peking has failed to produce any chinese undertaking to provide diversionary relief on India’s northern frontier in such an event, as china did before. Unlike last time. India has now mutual defence pact with Russia against attacks by third parties.•••••” রক্ষণশীল পত্রিকা নামে পরিচিত দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ তাদের সম্পাদকীয় মন্তব্যে যে ভবিষ্যতবানী করেছিল তার যথার্থতা প্রমাণিত হলাে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। ভারত ও পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ ঘােষণা করলে পাকিস্তানের পক্ষে কাশীর বা পাঞ্জাব ফ্রন্টে যুদ্ধ সম্প্রসার করা সম্ভব হয় নাই। 

১১ নভেম্বর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পূর্বাভাস হিসাবে নােয়াখালী জেলার বেলুনিয়া এলাকায় সীমান্ত যুদ্ধে ১০২ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাবির খবর প্রকাশিত হয়। সংবাদে বলা হয় যে, উভয় সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তান সৈন্য সমাবেশ জোরদার করছে এবং যে কোন সময় পূর্ণ যুদ্ধ ঘােষণা হতে পরে। ১২ নভেম্বর দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সংবাদদাতা ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ কর্তৃক পাকা থেকে প্রেরিত খবরে ঢাকার জি. পি, ও, এর কাছে মুক্তিযােদ্ধারা একটি শক্তিশালী। বােমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে হতাহত ও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে বলে প্রকাশিত হয়। পন্ডন থেকে প্রকাশিত পত্রিকা সমূহে এই মাসব্যাপী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং সামান্ত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণের খবরা খবর প্রাধান্য পায়। ৩ নভেম্বর “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ তাদের প্রতিনিধি মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ কর্তৃক কে প্রেরিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইয়াহিয়া খান। ” “তানকে টিকিয়ে রাখতে সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসাবে “পূর্ব পাকিস্তানে” ১২ থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেন। প্রতি উল্লেখ করা হয়, উপনির্বাচনের পর মুসলিম লীগ নেতা নূরুল আমীনকে পাট প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােজিত করা হবে এবং মন্ত্রীসভায় বাঙালীদের প্রাধান্য থাকবে বলে দেয়া হয়। ইয়াহিয়া খানের এই চাল কোন ফলপ্রসু পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে গত বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণের কাছে আরেকটি ষড়যন্ত্র বলে প্রতীয়মান হত মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের মাত্রা আরাে বৃদ্ধি পায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় নভেম্বর “দি সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদ বিবরণীত যায়, পূর্ববঙ্গে সফররত জাতিসংঘের এ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারী জেনারেল মার্ক হেনরী তার সফর সংক্ষিপ্ত করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টকে জানানাের জন্য নিউইয়র্ক ফিরে গিয়েছেন। খবরে বলা হয়, পূর্ববঙ্গে’ যে সকল বিস্তীর্ণ এলাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নাই সে সব এলাকায় জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী বিতরণ সম্ভব নয় বলেই মি. হেনরি ঢাকা ত্যাগ করেন। একই দিন (১৪ নভেম্বর) “দি অবজারভার” পত্রিকায় ঢাকা থেকে প্রেরিত খবরে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের বিবরণ প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় বলা হয় মুক্তিযােদ্ধারা লিপেট মাইন’ ব্যবহারে করে জাতিসংঘের চিহ্নধারী একটি খাদ্যশষ্য বহনকারী জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

১৫ নভেম্বর “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” এর বিশেষ সংবাদদাতা মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে প্রেরিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাব থাকলেও তাদের মনােবল শক্ত এবং তাদের মধ্যে মাতৃভূমি স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়, উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরাে বলা হয়, ঢাকার আশে পাশে হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান নিয়েছে এবং আগামী এক মাসের মধ্যে ঢাকা আক্রমণের ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মুক্তিযােদ্ধারা সংবাদদাতাকে অবহিত করেন। একই দিন (১৫ নভেম্বর) দি টাইমস’ পত্রিকার এক খববে জানা যায় যে, চালনা বন্দরের কাছে “সিটি অফ সেন্ট অলবান্স” নামের একটি মালবাহী জাহাজ মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দু’টি গানবােট ব্যবহার করে মুক্তিযােদ্ধারা জাহাজের উপর গােলা নিক্ষেপ করে বলে সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। এই খবরে প্রতীয়মান হয় যে, মুক্তিযােদ্ধারা স্থল ও জলপথে চতুর্মুখী আক্রমণের জন্য শক্তি অর্জন করে চূড়ান্ত আঘাতের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ১৫ নভেম্বর ‘দি টাইমস্ এর সংবাদদাতা পিটার হেজেলহাষ্ট্র ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের সম্ভাবনার বিষয় একটি বিশ্লেষণ মূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। নিবন্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর বরাত দিয়ে বলা হয় যে, পূর্ববঙ্গ সমস্যা সমাধানের বিষয় আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ কিছু দিনের মধ্যে ব্যর্থ হলে ভারতে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভারত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। এই ইংগিতের মাধ্যমে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে তার শীঘ্রই দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!