বিলাতের পত্রপত্রিকার ভূমিকা অক্টোবর ৭১
“দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা ১ অক্টোবরের সংখ্যায় ডেভিড লােশাক প্রেরিত এক সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধা গেরিলা পরিচালিত চোরাগুপ্তা আক্রমণের বিবরণ দিয়ে বলা হয় যে, মুক্তিযােদ্ধারা আমেরিকা, চীন। রাশিয়া, বৃটেন ও ফ্রান্সের তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করছে। ২ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় পাকিস্তানে সৃষ্ট সমস্যার অবসান না হওয়া পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলাে প্যারিসে এইজ পাকিস্তান কনসােরসিয়াম’ এর সভায় পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তা অপরিবর্তিত রাখার কথা প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ব্যাংকের সভার বরাত দিয়ে উপরােক্ত খবর পরিবেশিত হয়। এর ফলে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানের অবস্থা আরাে নাজুক হয়। ৪ অক্টোবর ‘মর্নিং স্টার’ পত্রিকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফরের বিষয় গুরুত্বসহকারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মস্কো সফরে মিসেস গান্ধী ‘পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন পরিচালনার ফলে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তাতে ভারতের সামাজিক ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করে সােভিয়েত নেতৃবৃন্ধকে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল করতে সমর্থ হন। মস্কো থেকে প্রকাশিত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি উল্লেখ করে সােভিয়েত ইউনিয়নের গভীর উপলব্ধির কথা প্রতিফলিত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার যুক্ত বিবৃতিকে অভিনন্দন জানান বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ৬ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরণার্থীদের করুণ অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়তে শরণার্থী শিবিরগুলিকে পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষ হিসাবে আখ্যায়িত করে আমেরিকা কর্তৃক পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার নিন্দা করা হয়। ৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ত্রাণকার্য পরিচালনাকালে অপারেশন ওমেগা’ এর আরাে দু’জন কর্মীকে গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হয়। ৮ অক্টোবরে “ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড” পত্রিকায় অপর খবরে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনের হার পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হয়। শরণার্থী বৃদ্ধির কারণ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামরিক কর্মকাণ্ড এবং দুর্ভিক্ষাবহানে দায়ী করা হয়।
১০ অক্টোবর “দি সানডে টাইমস’ পত্রিকা পাকিস্তান হাই কমিশনের একটি গােপন লিলের ফ্যাসিমিলি প্রকাশ করে। জনেক বাঙালি আবদুল হাই ‘পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট মে পাকিস্তানের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পাকিস্তান হাই কমিশন যে তাকে অর্থ দিচ্ছে তা গাপন দলিল থেকে প্রমাণিত হয়। ১৫ অক্টোবর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় পূর্ব সানের সাবেক গভর্নর পাকিস্তানপন্থী হিসাবে পরিচিত আবদুল মোনেম খানকে হত্যার এবর প্রকাশ করে। সাংবাদদাতা ডেভিড লােশাক প্রেরিত খবরে জানা যায় যে, দু’জন গেরিলা মােনেম খানের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে অতর্কিতে গুলি করে হত্যা করে। ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ এবং ‘অক্সফাম’ এর উদ্যোগে ১৯ অক্টোবর ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের শরণার্থীদের করুণ অবস্থার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে অর্ধ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে দুর্গতদের সাহায্য ছাড়াও পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সকল মহলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানাে হয়। বিজ্ঞাপনে একটি কুপন ছাপানাে হয় এবং বাংলাদেশকে সমর্থনের নিদর্শন হিসাবে এই কুপন পূরণ করে নিজ নিজ এলাকার সংসদ সদস্যদের কাছে প্রেরণের জন্য পাঠকদের অনুরােধ জানানাে হয়। ২১ অক্টোবর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর চারদিন ব্যাপী ভারত সফরের পর প্রেসিডেন্ট টিটো ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এক যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে পূর্ববঙ্গের সমস্যা সমাধানে আওয়ামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অবশ্য প্রয়ােজনীয় বলে মন্তব্য করা হয়। বিবৃতিতে পাকিস্তানকে সাবধান করে দিয়ে বলা হয় যে, বাংলাদেশের জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করা হলে পরিস্থিতি আরাে ভয়াবহ হতে পারে। ২৫ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ভারতে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের পূর্বে বেতার ভাষণের বরাত দিয়ে এক সংবাদ সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যার ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের মতামত গ্রহণ করা প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। ২৫ অক্টোবর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় পিটার হেজেলহাস্ট প্রেরিত সংবাদ নিবন্ধে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর তিন সপ্তাহ ব্যাপী বেলজিয়াম, অষ্ট্রিয়া, ফ্রান্স, বৃটেন, পশ্চিম জার্মানী এবং আমেরিকা সফরের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলােকপাত করা হয়। নিবন্ধে বলা হয় যে, পূর্ববঙ্গে সৃষ্ট সমস্যা মূলত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরিণ ব্যাপার এবং প্রায় ৯০ লক্ষ শরণার্থী ভারতের অর্থনীতির প্রতি যে বিরাট হুমকি সে বিষয়ে সি গান্ধী পশ্চিমা নেতাদের বুঝাতে চেষ্টা করবেন। এসকল সমস্যার সমাধানের বিষয়ে। * যে আন্তরিক এবং সর্বাত্মক গুরুত্ত্ব আরােপ করছে তা প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ সফরে প্রতীয়মান হয় ।
২৬ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় মাটিন ওরাকোট এর ঢাকা থেকে প্রেরিত এ বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ “Waiting for the war to start” শিরােনামে প্রকাশি নিবন্ধে বলা হয় যে, বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী । থেকে সম্ভাব্য যুদ্ধের সকল প্রস্তুতির লক্ষণ প্রতীয়মান হয়। নিবন্ধে আরাে উ যে, ভারত সীমান্তে ভারতের সৈন্যবাহিনী ইতােমধ্যে মােতায়েন করা হত কূটনৈতিক মহলের ধারণা। বাংলাদেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি যুদ্ধ অনিন। উল্লেখ করে নিবন্ধের উপসংহারে উল্লেখ করা হয় যে, There is less optimism, about the avoidance of war in the longer term with m believing that ultimately only conventional military light bring a permanent solution.” ২৮ অক্টোবর ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় সােভিয়েট ইউনিয়নের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন এর ভারত সফর শেষে দু’দেশের প্রতিনিধিদের প্রদত্ত যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির ৯নং ধারায় ভারত বা সােভিয়েট ইউনিয়ন ততীয় দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে উভয় দেশ পরস্পরকে সামরিক সাহায্য দানের যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত আছে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়। এই ঘােষণার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে যার পরিণতি একটি অবিসম্ভাবী যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। ২৯ অক্টোবর ‘দি টাইমস্’ পত্রিকায় পাক-ভারত উপমহাদেশে উত্তেজনাময় পরিবেশ সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর যুক্তি সমর্থন করে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয় । নিবন্ধে মিসেস গান্ধীর বরাত দিয়ে বলা হয় যে, সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে শরণার্থীদের তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করেই কেবলমাত্র উপমহাদেশে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসন সম্ভব। ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়ে ভারত যে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে তাও নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়। ইয়াহিয়া খান মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে পূর্ববঙ্গে’ যে অকার্যকর পুতুল বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তার কঠিন সমালােচনা করা হয়। ৩০ অক্টোবর “দি ইকোনােমিষ্ট” এবং “দি টাইমস” পত্রিকা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গন্ধিীর লন্ডন সফরের উপর খবর ও বিশ্লেষণ ধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করে।
“দি ইকোনােমিষ্ট পত্রিকার বিশ্লেষণে মন্তব্য করা হয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তিন সপ্তাহ ব্যাপী পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে সফর করে সরকার প্রধানদেরকে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী সমস্যা এবং পূর্ববঙ্গের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে নে মুজিবকে মুক্তিসহ পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য পাকিস্তানকে চাপ সৃষ্টি লক্ষ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। ‘দি টাইমস” পত্রিকায় এক খবরে রিয়াল ইনষ্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়স ‘ এর সদস্যদের উদ্দেশ্যে মিসেস গান্ধীর বক্তব্যে পূর্ববঙ্গের এর সমাধান একমাত্র পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই করতে পারেন বলে মন্তব্য | আর তা করতে হলে শেখ মুজিবের মুক্তি অপরিহার্য বলে তিনি মন্তব্য করেন। ১ অক্টোবর “দি সানডে টাইমস্ পত্রিকায় বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের বীরােচিত গুণ এবং প্রতিরােধের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ঢাকা থেকে প্রাপ্ত বর বরাত দিয়ে বলা হয় যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে প্রায় ১ লাখ গেরিলাযােদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সক্রিয় সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। প্রতিবেদনে গেরিলাদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিরও একটি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়। ‘দি অবজারভার’ পত্রিকায় একই দিনে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের আলােচনার সংবাদ প্রকাশিত হয় । মিসেস গান্ধী। উপরােক্ত বৈঠকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং উপমহাদেশের সংকটে ভারতের নীতির প্রতি। বৃটেনের সমর্থন কামনা করেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন