বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৪শে অক্টোবর, বুধবার, ৭ই কার্তিক, ১৩৮০
কীটনাশক ওষুধ আগে ছিলনা এখন থেকেও নেই
পোকার হাত থেকে শস্যকে বাঁচানোর জন্য আমরা আগে কয়েকবারই সম্পাদকীয় নিবন্ধনে আলোচনা করেছি। এতদিন অভিযোগ ছিল যে, পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ আর ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার মতো উপযুক্ত কোন কার্যকরী ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেননি। কীটনাশক ওষুধের অভাবে ওষুধ ছিটানোর জন্য বিমানের অভাব, কীটনাশক ওষুধ নিয়ে কালোবাজারিদের টালবাহানা ইত্যাকার অনেক অভিযোগ। সম্প্রতি আরও একটি অভিযোগ আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে জানা যায় যে, পোকা বিনাশের জন্য কর্তৃপক্ষ যে ওষুধের ব্যবস্থা করেছেন তাতে নাকি কোনো ফল হচ্ছে না। ফলে দেশের প্রায় ৮ লাখ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ, আগে ওষুধ ছিল না, এখন থেকেও নেই। কারণ ফল হচ্ছে না। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর ও চৌদ্দগ্রাম, কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা ও দৌলতপুর, রংপুরের কুড়িগ্রাম ও সদর মহকুমা, বরিশালে চরফ্যাশন, মানপুরা, মেহেন্দিগঞ্জ ও হিজলা, ময়মনসিংহের জামালপুর, সিলেটের জাকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া ও হাটহাজারী এবং যশোরের মাগুরা ও নড়াইল।
জানা গেছে যে, পোকার আক্রমণে কেবল কুড়িগ্রাম মহকুমা তেই প্রায় তিন লাখ একর জমির আমন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। চাঁদপুর ও চৌদ্দগ্রামের নষ্ট হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার একর জমির ফসল।
কৃষকেরা অভিযোগ করেছে যে, বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা স্থানীয় বৃক্ষ সংরক্ষণ বিভাগ থেকে কোন কীটনাশক ওষুধ পায়নি। উপদ্রুত এলাকাতে কীটনাশক ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দেয়াতে কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী একে তাদের অপকর্মের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে এবং প্রতি মণ ওষুধ চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। এটা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উপরে বলে অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
সিলেটে প্রায় লক্ষাধিক একর জমিতে ব্যাপকভাবে মাঝরা পোকার আক্রমন শুরু হয়েছে এবং এতে বিপুল পরিমাণ আমন ফসল নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছে। সিলেটে আক্রান্ত অঞ্চল গুলির মধ্যে আছে হবিগঞ্জ মহাকুমার মাধবপুর, বানিয়াচান ও লাখাই, মৌলভীবাজার মহকুমার রাজনগর, সদর মহকুমার বিয়ানীবাজার ও গোপালগঞ্জ থানা।
এবার পোকার আক্রমণ এত প্রবল যে, প্রায় সর্বত্রই ফসল একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র হাতে মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটিয়ে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ফলে, কৃষকদের মধ্যে দারুন হতাশার সঞ্চার হয়েছে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, যে হারে আক্রমণ চলছে তাতে অগ্রহায়ণ মাসে তাদের আর কাস্তে হাতে মাঠে যেতে হবে না।
আমরা আগেও জানিয়েছি যে, পাকিস্তানি আমল থেকে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে বার্ষিক ২৩ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতির গুণে গুণান্বিত। এর উপর যে হারে প্রকার ও কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য চলছে এবং কর্তৃপক্ষের উপযুক্ত যত্নের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে অচিরেই সমস্ত ফসল বিনষ্ট হয়ে যে এ ঘাটতির পরিমাণ সাতগুণ বেড়ে যাবে, দেশে করাল দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে তা খুলে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা একটা কথা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনা, যে দেশে খাদ্যের অভাবে লক্ষ লক্ষ লোক হন্যে হয়ে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেদেশে খাদ্যশস্য সংরক্ষণে এত উদাসীনতা কেন? শস্য সংরক্ষণের যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কতটুকু উদ্যোগী হয়েছেন তা জনসাধারণ জানতে আজ বিশেষ উৎসুক।
তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আবেদন এই যে, পোকার হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতে অবিলম্বেই আক্রান্ত এলাকায় ব্যাপক ভাবে এরিয়েল স্প্রের ব্যবস্থা করুন, যেসব কর্মচারীদের ঘাপলার দরুন বিভিন্ন এলাকায় লক্ষ লক্ষ টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করুন এবং যে সব অসাধু ব্যবসায়ীরা কীটনাশক ওষুধের এমন একটি প্রয়োজনীয় বস্তু নিয়ে কালোবাজারি করছে তাদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা করুন। তা না হলে বাংলার মানুষের জীবনের আগামী সমস্ত দুর্দশার দায়িত্ব আপনাদের উপরে এসে পড়বে।
ফ্যাকড়াটা আলকাতরার!
এবার ফ্যাকড়াটা বেধেছে আলকাতরা নিয়ে। মার্জার মহোদয়ের গলায় ঘন্টা বাঁধার জন্য মুষিক কুলের যেমন যৎপরোনাস্তি সমস্যার সাগরে নিপতিত হতে হয়েছে তেমনি আলকাতরার ভান্ড বহনকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আমাদের আদমশুমারির কর্মকর্তারাও। আলকাতরা বহনের খবরটা কিন্তু খুব বিরাট একটা কিছু না। গতকালকের পত্রিকান্তরে এ সম্পর্কিত যে খবরটি বেরিয়েছে পাঠকরা হয়তো বা কিছুটা মুখরোচক বলেই এটাকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এর পেছনে যে মানসিকতা এবং সে মানসিতা অর্জনের উপাদান হিসেবে যে সমস্যাটা কাজ করেছে তা কিন্তু কোন মতেই কম মারাত্মক নয়।
ঘটনাটা হচ্ছে, আসন্ন আদম ও গৃহ শুমারি কালে যেসব বাড়ি ও বাড়ির লোকদের গণনার কাজ শেষ হয়েছে, সেসব বাড়িতে দাগ দেওয়ার জন্য একটি করে আলকাতরার পাত্র বহন করে নিতে হবে। সাধারণতঃ গায়ের স্কুল মাস্টার, সমাজকর্মী ইউনিয়ন এর বিভিন্ন কর্মচারীকে এসব গণনার কাজে এন্যুমারেটর্স হিসেবে নিয়োগ করা হয়ে থাকে। এতদিন তারাই এসব বহন করতেন। কিন্তু বর্তমানে কাপড়ের বাজারের অগ্নিমূল্যের প্রেক্ষিতে এবং পরিধেয় বস্ত্র আলকাতরার ফোটায় কলঙ্কিত ও বিনষ্ট হবার ভয় এন্যুমারেটররা এখন আর আলকাতরার ভাণ্ড বহন করতে রাজি হবেন না বলে মনে করেই বিভিন্ন জেলা কর্তৃপক্ষ এখন দেশের প্রতিটি এলাকার জন্য প্রত্যেককে মাসে দুইশত টাকা হারে এক মাসের জন্য এক লক্ষ আলকাতরার ভান্ড বহনকারী নিয়োগের সুপারিশ করেছেন। এদিকে সেই সুপারিশ অনুযায়ী হিসেব করে দেখ দেখে আদমশুমারি ওয়ালাদের তো ‘থাক ভিক্ষে তোর কুত্তা সামাল’ অবস্থা। কেননা সব শুমারির জন্যই তাদের সর্ব মোট ব্যয় বরাদ্দ হচ্ছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। তার মধ্যে ভান্ডধারীদের জন্যই দুই কোটি টাকা খরচ হবার মত। কাজেই বুঝুন অবস্থা।
ফ্যাকড়াটা এখানেই কিন্তু শেষ হয়নি। আগে এই গণনার কাজে যারা নিয়োজিত হতেন তাদের কয়েকটা কলম, কিছু খাতা ও বইপত্র এবং সামান্য কিছু যাতায়াত খরচ বা রাহা খরচ দেয়া হতো। কিন্তু এখন যদি তাদের সাথের ভান্ডধারীদের মাসে দুশ টাকা করে দেয়া হয়, তবে তাদেরও অন্তত তার বেশি এবং কমের পক্ষে আড়াই শত টাকা করে দিতে হবে। শুমারি কতৃপক্ষকে যদি সেই হিসাবটা মেনে নিতে হয় তাহলে এখানেও খরচ পড়বে আড়াই কোটি টাকার মত অর্থাৎ একুনে সাড়ে চার কোটি টাকা। মোট বাজেট থেকে এক কোটি টাকা করে বেশি। এমতাবস্থায় শুমারির কাজ নির্ঘাত লাটে উঠবে। কাজেই মার্জার মহোদয়ের গলায় মুষিক কুলের পক্ষে যেমন ঘন্টা বাধা সম্ভব হয়নি, আলকাতরার কলঙ্কময় ভান্ডটিও কি তাহলে শুমারির কর্তৃপক্ষের সকল উদ্যোগ নস্যাৎ করে দেবে?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক