ডিসেম্বর মাসের তৎপরতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্ভাবনা নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে স্পষ্ট হয়ে ও… নভেম্বরে পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘােষণা এবং একই দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইনি গান্ধীর বিশেষ কেবিনেট সভা আহ্বান ও সার্ভিস প্রধানদের সভায় সতর্ক থাকায় আহ্বান বিলাত প্রবাসীদের কাছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঘােষণার প্রস্তুতি বলে প্রতীয়মান হয়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই পাকিস্তান ও ভারত সীমান্তে ছােট-খাট-সংঘর্ষ ও সৈন্য মােতায়েনের খবর আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সংগ্রামের প্রেক্ষপটে একটি যুদ্ধ আশংকায় পত্র-পত্রিকা নানা মন্তব্য প্রকাশ করে। বিশ্ব জনমত যুদ্ধকে পরিহার করে শান্তিপূর্ণ পন্থায় বাংলাদেশ ও শরণার্থী সমস্যা সমাধানের পক্ষ অবলম্বন করে বাংলাদেশ সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণকে পাকিস্তান ভারতীয় অনুপ্রবেশ বলে বারবারই আখ্যায়িত করেছে এবং মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণের নামে ভারতীয় সীমান্ত লংঘনের বহু ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ২৪ নভেম্বর দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ভারতীয় মন্ত্রী ভিসি শুকলার বরাত দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় বয়রা সীমান্তে পাকিস্তানের তিনটি জেট বিমান ভূপাতিত করার খবর প্রকাশ করে। পাকিস্তান ঘটনাকে ভারতের অঘােষিত যুদ্ধ বলে অভিযােগ করে। ভারতের পার্লামেন্টে শুকলা পাকিস্তানের বৈমানিক। ফ্লাইট লেফটেন্টে পারভেজ মেহেদী ও ফ্লাইং অফিসার খালিদ আহমদকে উক্ত বিমান যুদ্ধে আটক করার কথা বলেন। এ সকল ঘটনা থেকে পাশ্চাত্যের কূটনৈতিক মহল ভারত। পাকিস্তানের মধ্যে একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা অনিবার্য মনে করেন। আমেরিকা এ যুদ্ধ বাধার ব্যাপারে ভারতকে প্রধানত দায়ী করে ৬ ডিসেম্বর আমেরিকা কর্তৃক ভারতে প্রদত্ত সাহায্যের এক-তৃতীয়াংশ (৮৭৬ মিলিয়ন ডলার) স্থগিত করার ঘােষণা প্রদান করে। এর ফলে প্রবাসী বাঙলীরা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের উপর যে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির কথা ছিল তা উল্টো ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলাে। বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন জানান। ৬ ডিসেম্বরে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের খবর লন্ডনের সকল পত্র-পত্রিকায় গুরুত্ব সহ প্রকাশিত হয়।
উক্ত স্বীকৃতির খবরে বিলাতে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার এ যায়। যাদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তি সম্পর্কে দ্বিধা ছিল তাদের কাছেও বাংলাদেশর” স্বাধীনতা লাভ অনিবার্য হয় পাকিস্তান ভারতের সাথে অঘােষিত শক্রতা প্রকাশ ছড়িয়ে পড়ল। প্রবাসী বাঙাল লাভ অনিবার্য হয়ে গেল। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উক্ত স্বীকৃতি ঘােষণার সাথে সাথে ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে । এই ঘােষণার ফলে এতদিনের ; শত্রুতা প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ লাভ করলাে। ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তেও যুদ্ধ ডল। প্রবাসী বাঙালীরা প্রতিদিন যুদ্ধের অগ্রগতি পত্র-পত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনে গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রেখে বিলাতে বিভিন্ন প্রচার কার্য অব্যাহত রাখে। ডিসেম্বর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে’ যুক্তরাজ্যস্থ ন্যাপ ফফর) এবং ‘পিপল্স ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট যৌথভাবে এক সমাবেশের আয়ােজন করে। সমাবেশে সভাপিতত্ব করেন যুক্তরাজ্যস্থ ন্যাপ (মােজাফফর) এর সভাপতি খায়রুল দা। সভায় অতিথি বক্তা হিসাবে বক্তব্য রাখেন লর্ড ক্লকওয়ে, বৃটিশ কমিনিষ্ট পটির জ্যাক এদিস, ‘মর্নিংষ্টার’ পত্রিকার সহকারী সম্পদক উইলিয়াম ওয়েলরাইট এবং ন্যাপ (মােজাফফর) নেতা ডাঃ নুরুল আলম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বামপন্থী চিন্তাধারায় জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতােমধ্যে বাংলাদেশের বিশাল অংশ মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে, মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রা যখন অব্যাহত, মুক্তিযুদ্ধে যখন বিজয়ের প্রহর গুনছে—তখন লন্ডনে ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’ গঠন একটি অযৌক্তিক প্রয়াস হিসাবে গণ্য হয়। ৬ ডিসেম্বর বার্মিংহাম বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জগলুল পাশার সভাপতিত্বে বিভিন্ন বক্তা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দানের জন্য ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানান। ৭ ডিসেম্বর ম্যাঞ্চেষ্টার বাংলাদেশ এসােসিয়েশন স্থানীয় একটি হলে সমাবেশের আয়ােজন করে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এম. এ. মতিন। সভায় বক্তব্য রাখেন মাঞ্চেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি জেফ হ্যারিস এবং বাঙালী নেতা লতিফ আহম্মদ, মকসুদ আলী ও কবীর চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বক্তারা বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্যের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ দখলদার মুক্ত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মহিলা সমিতির আয়ােজনে লন্ডনের হাইড পার্ক স্পীকার্স কণীরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মহিলা সমিতির সভানেত্রী জেবুন্নেছা বখতের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম. পি. ব্রুস লাস-ম্যান, ষ্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমি (ক), মহিলা সমিতির লুলু বিলকিছ বানু, আনােয়ারা খানম, রাবেয়া ভূইয়া, ফেরদৌস ” ৬ মনােয়ারা রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বক্তাগণ বাংলাদেশের নিশ্চিত বিজয় “শপকে মন্তব্য করে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের অভিনন্দন জানান। সমাবেশ শেষে শট বিরাট মিছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাস সমূহে পশকে স্বীকৃতি দানের দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করে। মিছিলটি ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে গিয়ে সমাপ্ত হয় এবং সেখানেও একই দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি বটি প্রধানমন্ত্রীর সমীপে পেশ করে। একই দিনে (১০ ডিসেম্বর) “ইউনাইটেড এয়া বাংলাদেশ” পূর্ব লন্ডনের টয়েনবি হলে একটি জনসভার আয়ােজন করে। সভায় সভাপতি করেন আবদুস সামাদ খান এবং বক্তব্য রাখেন স্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদল বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহম্মদ এবং সংগঠনের নেতা এস এম আজিজ, নর চৌধুরী ও ওমর ফারুক চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বক্তাগণ শীঘ্রই স্বাধীন .. সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ভারতের পরপর ভুটান বাংলাদেশের সার্বভৌম সরকারকে স্বীকৃতি দান করলেও আমি কোন দেশ স্বীকৃতি ঘােষণা করেনি। তাই এদিকে বিশ্ব জনমতকে আকর্ষণ করার জন্য। বিলাতের সগ্রাম পরিষদসমূহের কেন্দ্রীয় ষ্টিয়ারিং কমিটি ১২ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বীকতি। ও শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির দাবিতে হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্নারে এক সমাবেশ ও মিছিলের আয়ােজন করে। এই মর্মে প্রচারপত্র ও পত্রিকার মাধ্যমে ঘােষণা দানের পর গ্রেট বৃটেন আওয়ামী লীগও একই দিনে একই সময়ে এবং একই স্থানে অনুরূপ সামবেশ ও মিছিলের কথা ঘােষণা দেন। ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দ্বিধার ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত ষ্টিয়ারিং কমিটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিলনা। তাই নেতৃত্বের প্রশ্নে ষ্টিয়ারিং কমিটির সাথে আওয়ামী লীগের ঠাণ্ডা লড়াই অব্যাহত ছিল। স্বাধীনতার উষালগ্নে ঠান্ডা লড়াইয়ের নগ্ন প্রকাশ লাভ করল।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রবাসী বাংলাদেশীরা নিজেদেরকে স্বাধীন বলেই মনে করত। ১২ ডিসেম্বরের সমাবেশ ও মিছিলকে কেন্দ্র করে প্রবাসী বাঙালীদের এতদিনের সংঘবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য ম্লান হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ সময়ে ষ্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা ও বিলাতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার কার্য পরিচালনার জন্য জাতিসংঘে (নিউইয়র্কে অবস্থান করছিলেন। তাই লন্ডনে উপরােক্ত পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করার জন্য বিচারপতি চৌধুরীর টেলিফোন নির্দেশ মােতাবেক স্টিয়ারিং কমিটির নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে সমঝােতা সভা অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে তাদের সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড় থাকায় বিচারপতি চৌধুরীর নির্দেশে ষ্টিয়ারিং কমিটি নেতৃবৃন্দ সমাবেশ অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকেন এবং তাতে যােগদান করেন। ১২ ডিসেম্বরের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গভ খান। হাইড-পার্কের উক্ত সভায় বক্তাগণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান ও বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবব রহমানের মুক্তি দাবি করেন। সমাবেশ শেষে এক বিরাট মি স্বীকৃতির বিভিন্ন শ্লোগানসহ ১০ নং-ডাউনিং স্ট্রীটে গমন করে এবং তথায় বৃটিশ প্রধান কাছে উল্লেখিত দাবিসমূহ সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের কাংক্ষিত স্বাধীনতা লাভের দিনে ঢাকায় পাকিস্তান নায়কের আত্মসমর্পণের খবর লন্ডনের বৈকালিক পত্রিকাসমূহে শিরােনাম লাভ করে। সময়ের ব্যবধানে লন্ডনের বৈকালিক পত্রিকাসমূহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য ওঠার প্রথম প্রহরে বিস্তারিত ঘটনা প্রকাশিত হয়। লন্ডনসহ বিলাতের সকল শহরের লীরা ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিজয় উৎসব অনুষ্ঠান করেন। লন্ডনের গার স্কোয়ারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সন্ধ্যার সময় হাজার হাজার বাঙালি একত্রিত হয়ে বিজয় বের মাধ্যমে দীর্ঘ দশমাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ কালের উৎকণ্ঠা ও প্রত্যাশার শুভ সমাপ্তি লাষণা করে। একই দিনে পূর্ব নির্ধারিতভাবে লিংক ফেরাম’ আয়ােজিত বাংলাদেশের সমর্থনে লন্ডনের কনওয়ে হলে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভা যদিও বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উক্ত সভা বিজয় সভায় রূপান্তরিত হয়। উক্ত সভায় ভারতীয় হাই কমিশনার অপা পান্ত এবং বাংলাদেশ মিশনের রেজাউল করিম উপস্থিত ছিলেন। স্বতঃস্ফূর্ত বিজয় উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৫ মার্চের কালাে রাত্রিতে যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তার শুভ সমাপ্তি হলাে, ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন