You dont have javascript enabled! Please enable it!

নভেম্বর মাসের তৎপরতা

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর পাশ্চাত্যের দেশগুলাে সফর ও লন্ডনে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার রিপাের্ট ও মন্তব্য থেকে বাংলাদেশ সমস্যার একটা ত্বরিত সমাধানের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১ তারিখে লন্ডনের কনিসিয়াম থিয়েটার হলে ইন্ডিয়া লীগ আয়ােজিত এক সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, 1 feel that I am sitting on top of a volcano, and I honestly don’t know if it is going to erupt.” (The Times, Nov. 1. 1971). তিনি শরণার্থী সমস্যা এবং বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে উপরােক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে নির্যাতন হত্যাযজ্ঞ চলছে তা সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। ভারত মানবিক কারণে তার পূর্ব সীমান্ত খােলা রেখেছে এবং শত উস্কানির মুখেও শান্ত থাকতে চেষ্টা করছে। ভারতের এই ধৈর্যধারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে ব্যর্থ হয়েছে এবং পরিস্থিতি আরাে জটিল আকার ধারণ করেছে। তিনি সভায় মন্তব্য করেন যে, ভারত এভাবে আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকতে পারেনা, বরং ভারত বাংলাদেশের সমস্যার ত্বরিত সমাধান চায়। এছাড়া মিসেস গান্ধী ৯ নভেম্বর প্যারিসে এবং ১০ নভেম্বর বনে সাংবাদিকদের কাছে ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানের সৈন্য সমাবেশ এবং সীমান্ত উত্তেজনার কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, ভারত যুদ্ধ চায়। , তবে তার সীমান্ত রক্ষার্থে ভারত সব সময়ই প্রস্তুত রয়েছে।  মিসেস গান্ধীর বিভিন্ন রাষ্ট্র সফর ও সফরকালে বিভিন্ন মন্তব্য এবং উভয় দেশের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে একটা। সামরিক পদক্ষেপ অনিবার্য। এছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তে ও অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি এবং মুক্তি বাহিনীর আক্রমণকে ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর আক্রমণ বলে পাকিস্তানের অভিযােগ ইত্যাদি ঘটনা থেকেও বাংলাদেশের মুক্তি অর্জনে অত্যাসন্ন সামরিক অভিযানের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মধ্য নভেম্বর থেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তান সৈন্যদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের অভিযোেগ আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় স্থান লাভ করতে থাকে। ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে জরুরা আইন এবং যুদ্ধাবস্থা ঘােষণা করেন। একই দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গাথা। বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের সাথে মিলিত হয়ে সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দেন।

এ সকল প্রস্তুতি থেকে বাংলাদেশ ইস্যুকে নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা কূটলে মহলে ব্যাপক আলােচিত হয় এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক সে দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন লাভ করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ গুরুত্ব লাভ এমনি পরিস্থিতিতে বিলাতের প্রবাসী বাঙালীরা তাদের আন্দোলনের পূর্ববর্তী ধারা হত রাখে। ষ্টিয়ারিং কমিটি তাদের মুখপত্র ‘বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’ ও ‘বাংলাদেশ ২.ডে’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্ব কাহিনী ও তাদের সাফল্য চার করতে থাকে এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করতে থাকে। বিভিন্ন শহরে সভা ও শােভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবি পুনরায় সােচ্চার হয়। বাংলাদেশকে স্বীকতি দানের পূবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঘােষণা হয়ে গেলে বাংলাদেশ ইস্যু ধামাচাপা পড়ে। যাবে এই সন্দেহে অনেক প্রবাসী শঙ্কিত ছিল। তাই, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবস্থার মধ্যেও প্রবাসী বাঙালীরা তাদের স্বীকৃতি দানের পূর্ববর্তী দাবির প্রতি সােচ্চার থাকে। ৬ নভেম্বর “ইউনাটেড এ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর উদ্যোগে রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত ‘কনওয়ে হলে’ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। সংগঠনের সভাপতি এস, এই, আজিজের সভাপতিত্বে জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সভায় বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম. পি. পিটার শাের, বাংলাদেশ থেকে আগত এম. এন. এ. ড. মফিজউদ্দিন, রাষ্ট্রদূত এ. মােমিন, বিশিষ্ট বৃটিশ সমাজকর্মী লেডী গিফোর্ড, এ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর মিস লীন বিলী এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের রেজাউল করিম। বক্তাগণ অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার ও জনগণের কাছে আবেদন জানান। প্রধান অতিথির ভাষণে বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশে প্রতিনিধি দলের কর্মতৎপরতা ও বিশ্ব নেতাদের বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। অতিশীঘ্রই আমাদের বীর মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশের সর্বত্র বিজয়ের পতাকা উড্ডীন করতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

৭ নভেম্বর (রবিবার) লন্ডনের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় কেন্টিশ টাউনে অবস্থিত “লেডী মার্গারেট চার্চ হলে দক্ষিণ ইংল্যান্ড আঞ্চলিক সংগ্রাম কমিটি সমূহের প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ষ্টিয়ারিং কমিটির আহবায়ক আজিজুল হক ভূইয়া। উক্ত সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন প্রচারণা ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণে সাংগঠনিক অবস্থা পযালােচনা করেন। বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে এমাহাম্মদ আইউবকে আহবায়ক করে একটি সমন্বয় কমিটি’ গঠিন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পরবর্তি ৫ সপ্তাহের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ায় উপরােক্ত সমন্বয় কমিটির কোন কর্মসূচী গ্রহণের সুযােগ হয় নাই। ১২ নভেম্বর পাের্টস ‘মাউথ বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ’ এবং “পােটস মাউথ লটেকনিক ছাত্র ইউনিয়ন” এর যৌথ উদ্যোগে পলিটেকনিক ছাত্র ইউনিয়ন হলে বাংলাদেশের সমর্থনে এক সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। সমাবেশে সভাপতিতক পলিটেকনিক ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি কীথ গার্ডনার। সভায় বাংলাদেশের মুক্তি সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন প্রফেসর রজার ব্রুমলী, গাও ল্যান্ড, বি, এস, চাডার এ রাজ্জাক খান এবং সি, হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভার প্রস্তাবে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ও বিনােটা দলীয় নেতাকে নিরবতা ভঙ্গ করে বাংলাদেশকে সমর্থনের আহ্বান জানানাে হয় । ১৯ নভেম্বর ম্যাঞ্চেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে বিশ্ববিদায় মিলনায়তনে বাংলাদেশের সমর্থনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ স্টুডেন্টস (NUS) এর আঞ্চলিক সভাপতি জেফ হ্যানিম, বাংলাদেশের ছাত্রদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কবীর আহম্মদ। সভার প্রস্তাবে বলা হয়, পর্ণ স্বাধীনতাই হচ্ছে বাংলাদেশের সমস্যার একমাত্র সমাধান। বৃটেনের তথাকথিত নিরপেক্ষতা ত্যাগ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে আহ্বান জানানাে হয়। একই দিন (১৯ নভেম্বর) কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন এক সভা আহ্বান করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ইউনিয়নের সভাপতি ওয়ার উইক। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেকমন্ত্রী টেড বােলেন, সাবেক এম. পি, গুয়েভার এভেন্স এবং বাঙালীদের পক্ষে ডাঃ নুরুল হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং পূর্ব বঙ্গের’ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দানের জন্য দাবি করা হয়। 

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যেমনি সাফল্যের পথে অগ্রসর হচ্ছিল তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি এবং কূটনৈতিক সাফল্য অর্জিত হচ্ছিল। ষ্টিয়ারিং কমিটি প্রকাশিত বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’ ১২ নভেম্বর তারিখে বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাঙালি কূটনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশগ্রহণের খবর পরিবেশন করে। সুইজারল্যাণ্ডের জেনেভস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি দ্বিতীয় সচিব জনাব ওয়ালিউর রহমান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সুইজারল্যাণ্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন।  এছাড়া নেপালের পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মুস্তাফিজুর রহমান, কায়রাের হেড অফ চেলারী ফজলুল করিম, টোকিও দূতাবাসের প্রেস এটাচি এসএম মাসউদ এবং টোকিও দূতাবাসের তৃতীয় সচিব আবদুর রহিম পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যােগদান করেন। এসকল সম্পর্কচ্ছেদের ঘটনা বিলবে হলেও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করেছে। বাংলাদেশে আর যে পাকিস্তানের শাসন চালানাে সম্ভব নয় তার নগ্ন প্রকাশ উপরােক্ত সম্পর্কছিন্ন’ (Defection) ঘটনার মাধ্যমে আন্তজাতিকতা প্রচার লাভ করে। ২৭ নভেম্বর ইউনাইটেড এ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে কনওয়ে হলে স একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ৮৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ, আর, মল্লিক। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রাদলের সদস্য হিসেবে নিউইয়র্ক গমনের পথে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন।  ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ: সাঈদ চৌধুরীর  বাংলাদেশ সরকার বিলাতের স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি আবু ধরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের চার কার্য পরিচালনার জন্য প্রেরণ করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ইতােমধ্যে নিউইয়র্ক গমন করেন। ড. মল্লিক মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেশের মুক্তি অত্যাসন্ন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ২৭ নভেম্বর আমার সভাপতিত্বে যুক্তরাজ্যে ছাত্রলীগ গঠনের জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সৈয়দ মােকাররম আলীকে আহ্বায়ক এবং মােঃ মমতাজ উদ্দিন, যাত্রী ওয়াহিদ উদ্দিন আলমগীর, সৈয়দ মােজাম্মেল আলী ও মিসেস খালেদা মান্নান কে যুগ আহ্বায়ক মনােনীত করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ নভেম্বর যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বৃটিশ পালামেন্টের গ্রান্ড কমিটি রুমে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্যস্থ আওয়ামী লীগের সভাপতি গউস খানের সভপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম. পি. পিটার শাের, রেজিনান্ড প্রেনটিস, ব্রুস ডগলাস-ম্যান ও জুলিয়াস সিলভার ম্যান এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের রেজাউল করিম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বক্তাগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি জানান। 

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!