You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৩ই অক্টোবর, শনিবার, ২৬শে আশ্বিন, ১৩৮০

আগ্রাসনে নৌবহর আর ন্যায়ের পথের রণতরী

ছয়ই অক্টোবর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছেম প্রথমে মিসর-সিরিয়া ও লিবিয়া ইসরাইলি বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে যৌথ কমান্ডের প্রতি আক্রমণ চালিয়েছিল। এরপর থেকে সকল আরব রাষ্ট্র ইসরাইল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। মরক্কো সুদান ইয়েমেন প্যালেস্টাইন গেরিলা প্রত্যেকেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সহযোগিতা নিয়ে মিশর ও সিরিয়া পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আক্রমণ প্রতিআক্রমণ যখন দ্বিতীয় দিনে পদাপর্ণ করেছে এবং ইসরাইলি বাহিনী যখন চরম প্রতিরোধের মুখে পিছু হটছে তখনই আমরা জানতে পারলাম মার্কিন নৌ-বহর ভূমধ্যসাগরের ক্রীট দ্বীপের অভিমুখে এগিয়ে চলছে। ইসরাইলের প্রভু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ হেন ভাবে সশস্ত্র নাক গলাবেন তা আমরা যুদ্ধ শুরুর প্রথম এই অনুমান করেছিলাম। ইসরাইলের এতদিনের দাম্ভিক আচরণের এবারের যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনেই শোচনীয়ভাবে প্রশমিত করে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় দেশই ইসরাইলের এ ধরনের আক্রমনকে তীব্রভাবে নিন্দা করেছে। এতদ্বসত্ত্বেও মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহর প্রেরণ করার উদ্দেশ্য যে কত ঘৃণ্য এবং বিশ্বশান্তি পরিপন্থী তা সহজেই অনুমেয়। আরব বাহিনীর চরম আক্রমণের দরুন সুয়েজের পূর্বতীর মিশরের দখলে আসে এবং পরে সিনাইয়ের আলকানতারাও তারা দখল করে নেয়। এহেন নাজুক অবস্থার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দাসানুদাস ইসরাইলকে সর্বাত্মক সাহায্য দেয়ার জন্য ষষ্ঠ নৌবহর প্রেরণ করেছে। এদিকে বিশ্বের সকল শান্তিকামী বিবেকবান মানুষ মার্কিন নীতির প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে চলেছে। গত দশই অক্টোবর এর এক সংবাদে জানা গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি রণতরী মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। অনুমান করা হচ্ছে সোভিয়েত রণতরী আরব রাষ্ট্রগুলোর ন্যায় সঙ্গত অধিকার আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রামের পাশে গিয়ে ভিড়বে। বিশ্ব রাজনীতিতে বহু দিন ধরে একটি সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে-তা হলো মার্কিন পেন্টাগন সবসময়ই বিশ্ব শান্তি ও জীবন বিনষ্টের মূলে আর সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক শক্তি শান্তি স্থাপনের স্বপক্ষে। আমরা মর্মে মর্মে এ সত্য অনুধাবন করেছি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কালে। মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বাংলার অসহায় মানুষের জীবন ও সম্পদের বিনষ্টি স্বাধীন করেছিল তখন ভারত মহাসাগরের অদূরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধংদেহি চরিত্রের প্রকাশ করেছিল তা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে লেখা থাকবে। তখনো সোভিয়েত রণতরী সপ্তম নৌবহরকে সতর্ক করে দিয়ে পাহারায় মোতায়েন ছিল সাগরে। সেই কারণেই সেদিন নিজেদের দাসানুদাস পাক সৈন্যকে নাজুক অবস্থায় ফেলে রেখে সপ্তম নৌবহর পিছু হটেছিল। আরব রাষ্ট্রে সমর্থনে যদি সোভিয়েত রণতরী এগিয়ে থাকে তাহলে তা ষষ্ঠ নৌবহর রুজভেন্টের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। অবশ্য এখনও যদি ১৯৬৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী দখলকৃত আরব এলাকা ছেড়ে দিয়ে ইসরাইল সরে দাঁড়ায় তাহলে আরো পক্ষের প্রতিরোধ সংগ্রাম প্রশমিত হতে পারে বলে আমাদের ধারণা। অন্যথায় আরব রাষ্ট্রের পণ ইসরাইল কর্তৃক অন্যায় ভাবে দখলকৃত তাদের মাতৃভূমি উদ্ধার না করা পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আর সেই মরণপণ ন্যায় সংগ্রামে পাশে দৃপ্ত অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সোভিয়েত রণতরী। সেখানে ষষ্ঠ নৌবহর যত শক্তিশালীই হোকনা কেন আঘাত হানলে তার সমুচিত জবাব তারা পাবে বলে আমাদের ধারণা। কেননা অন্যায় চিরদিন টিকতে পারেনা।

পোকার হাত থেকে শস্য বাঁচান

শস্যখেত বিরান হচ্ছে, আর কর্তারা উড়ে বেড়াচ্ছেন। তথ্যটা চাঞ্চল্যকর। এবং গত কালকের বাংলার বাণীতে প্রকাশিত এই খবরটি যদি সত্য হয় তবে তা মর্মাদ্ভদ। শুধু মর্মদ্ভদই নয়, নিদারুণ খাদ্য সংকটে জর্জরিত এই দেশের জন্য আত্মহননকারী ও বটে। বাংলার বাণীর ওই খবরে বলা হয়েছে যে, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্তারা কৃষি দপ্তরের বিমানগুলো অন্য কাজে ব্যবহার করছেন। তাই কীটনাশক ওষুধ সরাবার জন্য বিমান পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে কৃষিক্ষেত্রে কিসের আক্রমণে প্রায় আট লাখ একর জমির আমন ফসল নষ্ট হতে চলেছে এবং এসব জমির সম্পূর্ণ ফসল যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে দেড়শ’ কোটি টাকার মতো।
গ্রাম বাংলার শস্য ক্ষেতে এখন আমন ফসল। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে যে আমনের রোপা শেষ হয়েছিল তা এখন বাড়ন্ত। আশ্বিনের শেষ এবং কার্তিকের প্রথমে তাতে থোড় বেরুবে-তারপর ধানের গোছা গুলো ফলবতী হয়ে নুয়ে পড়বে। আর সেই নুয়ে পড়া ধানের গোছা বাংলার কৃষকের প্রাণের নতুন আশার সঞ্চার করে মুখে হাসি ফোটাবে। বিগত দিনের ক্ষুৎ-কাতরতা ভুলে হয়তো ভবিষ্যতে রঙিন স্বপ্ন দেখবেন তারা। কিন্তু পোকার আক্রমণে অন্যান্যবারের মতো এবারও তাদের সেই ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলো যখন কীটদষ্ট হচ্ছে, ঠিক তখনই খবর পাওয়া গেল কর্তাদের খেয়ালিপনার-খবর এলো গায়ের কৃষকের বুকের ধ্বংস করার জন্য আনীত বিমানগুলো তারা ফুর্তির কাজে ব্যবহার করছে। কাজেই তাদের এই অপরাধ অমার্জনীয়-অবশ্য যদি কোনো অপরাধবোধ তাদের থেকে থাকে। বাংলার বাণীর ওই খবরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যথা চাঁদপুর, চৌদ্দগ্রাম, দাউদকান্দি, নবীগঞ্জ, কমলগঞ্জ, মাধবপুর, জাকিগঞ্জ, চৌগাছা, লোহাগড়া, মাগুরা, ভেড়ামারা, দৌলতপুর, জয়পুরহাট, মিরেশ্বরাই, সাতকানিয়া, পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া, ডবলমুরিং, মোহনগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, রামগঞ্জ, রায়পুর এবং পরশুরামের যে ভয়াবহ অবস্থা বর্ণিত হয়েছে তাতে কৃষি বিভাগের তো বটেই অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত বিমান ও হেলিকপ্টার গুলা জরুরিভিত্তিতে ওষুধ ছিটানোর জন্য অনেক আগেই পাঠানো উচিত ছিল। উল্লেখযোগ্য যে, আমরা এর আগেও এমন একটি দাবি করেছিলাম-কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় সম্ভবত কান দেননি তাতে।
খাদ্য ঘাটতি আর খাদ্য সংকটের এই দেশ আমাদের। পাকিস্তানি আমল থেকে বার্ষিক ২৩ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। তাছাড়া বর্তমানে সারাবিশ্বে খাদ্য ঘাটতি বিশেষ করে ধান উৎপাদন যে ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে কোন ভয়াবহ পরিস্থিতি তাতে সৃষ্টি হয় ভবিষ্যতই তা বলতে পারে। সেই ক্ষেত্রে যদি এই দেশের ৮ লক্ষ একর জমির ধান মাত্র কিছুসংখ্যক আমলার ঘাপলায় আর নেহাত ফুর্তির জন্য বিনষ্ট হয় তবে সে দুঃখ রাখবার স্থান কোথায়? আমরা মনে করি এখনো সময় আছে, জরুরী ভিত্তিতে ওষুধ সরবরাহ ও ওষুধ ছিটানোর মাধ্যমে এই ৮ লক্ষ একর জমির আক্রান্ত আমন রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। কৃষি বিভাগের কর্তারা কি একটু সচেষ্ট হবেন?

আবার লঞ্চ দুর্ঘটনা

মুন্সীগঞ্জের অদূরে আবার যাত্রীবাহী লঞ্চ নিমজ্জিত হয়েছে। খবরে প্রকাশ এম, এল, জর্জ ভোর রাত্রি ৫ টার দিকে মুন্সিগঞ্জ ত্যাগ করে কিছুদূর এগিয়ে গেলে খুলনা থেকে আগত উর্বশীর সঙ্গে ধলেশ্বরীতে সংঘর্ষ ঘটে। প্রকাশ, দুইটি লঞ্চের একটিতেও হেডলাইটে আলো ছিল না উপরন্ত সে সময় মুষলধারে বৃষ্টি শব্দের সঙ্গে লঞ্চের শব্দ একাকার হয়ে গিয়ে এই দুটো লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এতে এম, এল, জর্জের প্রায় দু’শ জন যাত্রী প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং মাত্র ৫০ জন যাত্রী তীরে উঠে আসতে সমর্থ হয়েছে।
খবরে আরো প্রকাশ, ঘটনার দেড় ঘন্টা পরে নিমজ্জিত লঞ্চ থেকে তীরে উঠে আসা যাত্রীর কাছ থেকে মুন্সিগঞ্জ কর্তৃপক্ষের কাছে খবর পৌঁছে সত্বেও তারা লঞ্চটি উদ্ধারে ব্যাপারে ত্বরিত কোনো ব্যবস্থা নেননি। অপর এক তথ্য অনুসারে নিমজ্জিত লঞ্চটি উদ্ধারের জন্য দমকল বাহিনীর অগ্নিবীণা ঘটনাস্থলে গমন করে কিন্তু অগ্নিবীণা যান্ত্রিক গোলযোগের তাকে ফিরে আসতে হয়। পরে আই ডব্লিউ টি এর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজাকে সেখানে পাঠানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কিছুদিন আগেও মুন্সীগঞ্জের কাছে আরেকটি লঞ্চ ডুবিতে বহুসংখ্যক যাত্রী প্রাণহানি ঘটেছে এবং সে লঞ্চ ডুবির পেছনে কারণ ছিল অধিক যাত্রী বোঝাই, লঞ্চের হেডলাইট না থাকা ইত্যাদি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একই ধরনের কারণে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অথচ আলোবিহীন যানবাহন চলাচল যাত্রী বহন ইত্যাদি পরিবহন আইনে বেআইনি কাজ। অথচ অহরহ এই ত্রুটি সংঘটিত হওয়া সত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন বা যাত্রীদের উদ্ধার কাজেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যে কর্ম তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে তাও দুঃখজনক। প্রকাশিত খবর অনুসারে জানা যায় দুর্ঘটনার দীর্ঘ দেড় ঘন্টা পরে উদ্ধারকাজে দমকল বাহিনীর যে জাহাজ প্রেরণ করা হলো, তাও যান্ত্রিক গোলযোগের দরুন কাজ করতে পারল না। কল কব্জার ব্যাপারে হঠাৎ করে বিকল্প হতে পারে এ কথা স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয় ‘ইমারজেন্সি’ অনুসারে ব্যবহৃত যানবাহনগুলো যান্ত্রিক গোলযোগ তাকে সহজে মেনে নেয়া যায় না।
যাই হোক, এম এল জর্জের নিমজ্জিত হওয়ার কারণকে উপলক্ষ করে সেইসঙ্গে অতীতের দুর্ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে এমনতর মর্মান্তিক ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!