You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.05.14 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | পাটের পর এবার সুতায় আগুন | ভুয়া ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য আর কতদিন! | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৪ই মে, মঙ্গলবার, ৩০শে বৈশাখ, ১৩৮১

পাটের পর এবার সুতায় আগুন

সোনালী আঁশের আগুন এবার সুতায় সংক্রমিত হয়েছে। পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, টাঙ্গাইল জেলার এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ফলে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। কারণ স্বরূপ বলা হয়, গত ১২ই মে রোববার বিকেলের দিকে শর্ট সার্কিটের গোলযোগ থেকে প্রথমে এই আগুনের সূত্রপাত হয়। উক্ত খবরে আরও বলা হয়, এই আগুনে মিলের রোলিং, রং সুতার ও তাঁত মেশিন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া মিলের গুদামঘর ও অপর একটি ঘরের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। এব্যাপারে মিল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে কর্তৃপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি বলেও উক্ত সংস্থা জানাচ্ছে।
আমরা জানি এমন একদিন ছিল যখন এদেশের তাঁতিরা নিজস্ব চরকায় সুতো তৈরি করে নানারকম সৌখিনবস্ত্র তৈরি করত। পাট সিল্কের শাড়ি, ঢাকাইয়া জামদানি, মসলিন ইত্যাদির সুতোও তাঁতিরাই তৈরি করত। বিদেশের কাপড় ছাড়াই দেশীয় বয়ন শিল্প এদেশের চাহিদা মেটাতে পারত। এত বৈজ্ঞানিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও সুবিধা না থাকলেও তখন বাংলাদেশের মানুষ মোটা কাপড়ের আচ্ছাদনের নিজেদের আবৃত করতে পারত। একথা অনস্বীকার্য যে, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের অনেক দিয়েছে। আমরা এখন অধিকতর সৌখিন কাপড় পরিধান করি, উচ্চপর্যায়ের রাসায়নিক পদ্ধতিতে বাহারি রঙ বানাতে পারি এবং আরো নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারি। এবং কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা হওয়াতে মানুষের শ্রম ও এখন অনেক বেঁচেছে। কিন্তু সেই ইপ্সিত সুযোগ-সুবিধা কই? অর্থাৎ সস্তায় কাপড় পরার আশ্বাস কোথায়?
বলাবাহুল্য সুতাই হলো কাপড় উৎপাদনের প্রধানতম হাতিয়ার। এই সুতা তৈরি হয় তুলা থেকে। আমরা জানি, তুলা চাষে আমাদের দেশ সমৃদ্ধ নয়। ফলে কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রচুর সুতা আমাদের আমদানি করতে হয়। সেই সুতা প্রথমতঃ বন্টনের অবস্থান জনিত দুর্নীতিতে পতিত হয়। ভুয়ো পারমিটধারী ব্যক্তি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ঘৃণ্য মুনাফার লোভ সুতাকে কেন্দ্র করে অবৈধ লীলায় মেতে উঠে। তারপর আছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উদাসীন্য। ফলে লাখ লাখ টাকার সুতা আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয় এবং বস্ত্র সঙ্কটকে জিয়িয়ে রাখে।
শুধু কি তাই? বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের গুদামেও এমনি রহস্যজনকভাবে আগুন লাগে। এবং গত দু’বছরে ওই ধরনের অগ্নিকাণ্ডে দিনাজপুরের ৩৯টি জুটমিল ও গুদামে আগুন লেগে ১৭ কোটি টাকার মাল ভশ্মীভূত হয়। দৌলতপুরে বিপুল পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য পাট রহস্যজনকভাবে পুড়ে যায়। এবং কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
এমনি ধরনের আর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল চৌঠা মার্চ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু সেখানে যান এবং জরুরি পদক্ষেপ নেবার নির্দেশনাবলী জারি করেন। তারও পরে ওই ধরনের আগুনলাগা অব্যাহত রয়েছে। এবং প্রায় ক্ষেত্রেই ‘সাবোটাস’ এই কথা বলা হয়। কিন্তু তারপর ভালো-মন্দ আর কিছু জানা যায় না। যেমন রহস্যজনকভাবে আগুন লাগে তেমনি রহস্যের আধারেই কারণগুলো ঢেকে যায় একসময়। তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় বটে কিন্তু কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় না। কে বা কারা আগুন লাগার মূলে দায়ী তাদেরকে চিহ্নিত করা বা শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত রাখা হয় না। ফলে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর জাতীয় ক্ষতির বিপুল পরিমাণ অংকের নাম শুনে সাধারণের দুঃখিত হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। ভাবখানা যেন-কার কিবা আসে যায়!
এবার দেখা যাচ্ছে, সুতা পোড়ার পালা। কারণস্বরূপ যা বলা হয়েছে তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। এবং অগ্নিকাণ্ডের অন্যান্য ঘটনাবলীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কর্তৃপক্ষদের অকুস্থলে পাওয়া যায়নি। কারণ যাই হোক, ক্ষমতাটা তো দেশের তথা প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের।
দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির আমরা চাই। এ শুধু কথার কথা নয়, আন্তরিক বাঞ্ছা। অতএব সেই মোতাবেক চলতে হবে হলো সোজা কথা। কি হওয়া উচিত ছিল আর কি হয়নি এবং এই করতে গিয়ে ঐ হল-এই সব কৈফিয়ত আর আমরা শুনতে চাই না। আমরা চাই–দেশীয় সম্পদের এক কণা ও নষ্ট হবে না, পুড়বে না। দেশি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে বিন্দু বিন্দু শ্রম সহ সকল প্রাপ্ত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে। অবহেলা আর ঔদাসীন্যের কোন ক্ষমা নয়–নির্মম বিচার হোক। প্রতিটি অঘটন ও অপকর্মের তদন্ত হোক এবং প্রতিবেদন প্রকাশ পাক। এতে পোড়া পাট ও সুতা না ফিরে এলেও দুষ্টু দমন হবে। সেটাও চরম লাভ।

ভুয়া ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য আর কতদিন!

কিশোরগঞ্জ নীলফামারীর দু’টো দৃষ্টি আকর্ষণীয় সংবাদ সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। ভুয়া লাইসেন্স পারমিট অথবা লাইসেন্স পারমিট থাকলেও কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নেই এমন কাহিনী সম্বলিত হয়েছে ওই দুটো সংবাদে। কিশোরগঞ্জ শহরে বেশ কিছুদিন ধরে কাগজের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ছাত্রছাত্রীকে দুই টাকা দিস্তা কাগজ কিনে পড়াশোনা চালাতে হচ্ছিল। এর কারণ খুঁজে বের করতে গিয়ে ভিতরের খবর বেরিয়ে পড়েছে। জানা গেছে–কিশোরগঞ্জ শহরের জনৈকা মহিলার নামে কর্ণফুলী পেপার ও খুলনা পেপারের ডিস্ট্রিবিউটার শিপ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাসে আঠারো বেল কাগজ পাইকারি বিক্রি করার কথা। এজন্য শহরে ‘কাগজ বিতান’ নামে একটি ট্রেড লাইসেন্সও সংগ্রহ করেছেন। সর্বশেষ খবর নিয়ে জানা গেছে, ওই ভদ্রমহিলা নাকি কিশোরগঞ্জেরই নন, তিনি চট্টগ্রামের বাস করেন। এবং সেখান থেকেই তিনি ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও জামালপুরেও ডিস্ট্রিবিউটর হয়েছেন। কোথাও তার কোনো প্রতিনিধি বা দোকান নেই। নিলফামারীর সংবাদে প্রকাশ, এই মহাকুমার জন্য ছুটি আমদানি লাইসেন্স এর মধ্যে প্রায় সবগুলোই নাকি ভুয়া অথবা তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নেই। তারা যথাসময়ে আমদানিকৃত মালামাল নিয়ে আসেন না অথবা ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করেন না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব লাইসেন্স এর মধ্যে অনেকগুলো স্কুল-কলেজের নামে সাইকেলের খুচরা যন্ত্রাংশের লাইসেন্স, উকিলদের নামে ফটো ফিল্মের লাইসেন্স। এলাকার জনসাধারণ এই সকল ভুয়া লাইসেন্স ধারীদের কীর্তিকলাপ ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছে। দেশে যে প্রচুর পরিমানে ভুয়া লাইসেন্স রয়েছে তারা সরকারও স্বীকার করেছেন। অসংখ্য পরিমাণ ভুয়া ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান রয়েছে–এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। এদের অব্যবসায়িক কার্যকলাপে জনসাধারণের দুর্ভোগ পোহাচ্ছে তাও সত্য। কতৃপক্ষ প্রথম থেকে যদি সতর্ক হতে চান তাহলে এই নৈরাজ্য এত বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করত না। জনসাধারণের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত না। অন্য একটি সংবাদে প্রকাশ–বিসিক ও সমবায় সমিতি থেকে নির্ধারিত মূল্যে সুতা নেবার জন্য নাকি তাঁতি পাওয়া যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সেনাবাহিনীর তৎপরতার দরুন তাঁতিরা নাকি গা ঢাকা দিয়েছে। এদিকে টিসিবি ও বস্ত্র শিল্প সংস্থার গোডাউনে ৫০ হাজার বেলেরও অধিক সুতা বণ্টনের অপেক্ষায় পড়ে রয়েছে। হস্তচালিত তাঁতের জন্য সুতা সরবরাহ করার নিমিত্তে যে সকল ডিলার নিযুক্ত করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিসি এবং এসডিও গণকে নির্দেশ দান করেছেন, এসব ডিলার টিসিবিও বস্ত্র শিল্প সংস্থা থেকে সুতা উঠিয়ে খোলাবাজারে তাঁতিদের মাঝে তা বিক্রি করবে। বস্তুতঃপক্ষে সুতা বন্টনের ক্ষেত্রে এদেশে নজিরবিহীন দুর্নীতি চলেছে। হাজার হাজার ভুয়া তাঁতির জন্ম হয়েছে এবং ভুয়া ডিলার তৈরি করে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়ানো হয়েছে। আমরা ইতিপূর্বে বহুবার এ নিয়ে আমাদের মতামত জানিয়ে এসেছি। ব্যবসায় ক্ষেত্রে বিরাজমান যে ব্যাপক দুর্নীতি তা রোধ করা প্রথম থেকেই উচিত ছিল। ভুয়া লাইসেন্স ও পারমিটবাজদের দৌরাত্ম্য আজ হতে শুরু হয়নি। যখন থেকে কতৃপক্ষ এর নমুনা প্রত্যক্ষ করেছেন তখন থেকে যদি কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া যেত তাহলে আজ দুর্নীতির যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তা সম্ভব হতো না। আমরা আবারও কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব–অনতিবিলম্বে সকল ভুয়া ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে একটা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যদি দেশটি ভুয়ার আধিক্যে ডুবে যায় তাহলে কর্তৃপক্ষও একদিন জনগণের সামনে ভুয়া বলে প্রতিপন্ন হবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন