You dont have javascript enabled! Please enable it!

টিক্কা খান অমর রহে?

রাস্তার বা শহরের নাম পরিবর্তন করে ইতিহাস পরিবর্তনের চেষ্টা কিছু নতুন নয়। অমন যে ইতিহাস বিখ্যাত স্তালিনগ্রাদ, যেখানে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রচণ্ডতম লড়াই হয়েছিল, তারও নাম পাল্টে একদিন। ভলগােগ্রাদ করা হল। কারণটা আর কিছুই নয়—ঐ সময় সােভিয়েট রাশিয়ায় স্ট্যালিন-পূজার অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় স্ট্যালিনােচ্ছেদের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। যারা সেদিন অত্যুৎসাহে স্ক্যালিনগ্রাদের নাম পরিবর্তন করেছিলেন তারা ভেবেছিলেন শুধু ঐ শহরের নাম পাল্টালেই বুঝি জোসেফ স্তালিনের নামটা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে। অবশ্যই সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় নি। শােষিত মানুষের ত্রাণকর্তা অথবা দুরন্ত ডিটেক্টর যে-ভাবেই দেখুন না কেন তাকে মনে না রেখে উপায় কই? স্তালিনগ্রাদের উদাহরণটা অবশ্যই একটা চূড়ান্ত উদাহরণ, কিন্তু অহরহ রাস্তার নাম পাল্টানােটা অন্ততঃ কলকাতার মানুষের কাছে কিছু নতুন অভিজ্ঞতা নয়। এই মহানগরীর পৌরপিতারা আর কিছু পারুন বা না-পারুন, তড়িঘড়ি রাস্তার নাম পাল্টাতে তাদের যে জুড়ি নেই এ-কথা তাদের শত্রুরাও স্বীকার করেন। অনেক অতিপরিচিত রাস্তার নাম তারা অপ্রয়ােজনে পাল্টাচ্ছেন, এ-কথ ঠিক, কিন্ত অনেক ক্ষেত্রেই দেশের বরেণ্য নেতাদের স্মৃতিরক্ষাও যে তাদের উদ্দেশ্য ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। ক্লাইভ, কর্ণওয়ালিশ বা ডালহােসির নাম নিশ্চয়ই আমাদের কাছে সুভাষচন্দ্র, বিধানচন্দ্র অথবা বিনয়-বাদল-দীনেশের চেয়ে প্রিয়তম নয়।
পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের মানুষ যদি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাস্তার বা শহরের নতুন নাম রাখেন তাতে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না যদি না অবশ্য তার মধ্যে ইতিহাসের স্বেচ্ছাকৃত বিকৃতি ঘটাবার চেষ্টা থাকে। এখন অবশ্য বাংলাদেশে চলছে ইয়াহিয়ার জঙ্গী চেলাদের শাসন, সুতরাং জননির্বাচিত প্রতিনিধিদের কিছু করবার উপায় নেই। তাই রাস্তার নাম পরিবর্তনের গুরুভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন স্বয়ং জেনারেল টিক্কা খান। তিনি এক ফরমান জারী করে রাতারাতি পাল্টে দিয়েছেন একটি নয়, দুটি নয়, একেবারে ২১০ টি রাস্তার নাম। টিক্কা খান তাঁর সাকরেদরা যদি পাক নেতাদের সম্মানিত করতে চান তা করতে পারেন, কিন্তু তার এই ঘােষণার পিছনে রয়েছে কুট উদ্দেশ্য। নাম পাল্টাবার অভিযানে তিনি প্রথমেই বেছে নিয়েছেন হিন্দুদের নামঙ্কিত রাস্তা। কিছু জাতীয়তাবাদী মুসলমানের সঙ্গে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়েও তা হলে টিক্কা খানের সাঙ্গোপাঙ্গোদের আক্রোশ মেটেনি দেখা যাচ্ছে। হিন্দুদের মন্দির ধ্বংসের খবর আগেই পাওয় গেছে। এখন রাস্তার নাম থেকে চিত্তরজ্ঞনের মতাে বরেণ্য মানুষদের নাম মুছে দিয়ে তারা তাদের পবিত্র ঐশ্লামিক কর্তব্য সমাপন করতে চলেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য, সব হাঙ্গামার মূলেই যে হিন্দুরা, এই কথাটা বাংলাদেশের মানুষকে বােঝানাে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এতে ভুলবে, এ আশা করা মূড়তা।
তবে আরাে মূঢ়তার উদাহরণ টিক্কা খান সাহেবের এ ফরমানেই আছে। তিনি ঢাকার একটি রাস্তার নতুন নাম রেখেছেন নিজেরই নামে। শাঁখারি বাজার রােডের নাম এখন থেকে টিক্কা খান রােড। অমরত্নের বাসনা মানুষের সহজাত এমনকি টিক্কা খানের মতাে দুৰ্বত্তেরও যে সে-বাসনা থাকবে না এমন কোনাে কথা নেই। কিন্তু সেই বাসনা চরিতার্থ করার এমন স্থূল অপচেষ্টা বড় একটা চোখে পড়ে না। টিক্কা খান কি ভাবছেন, লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করে তিনি যে অমরকীর্তি স্থাপন করেছেন সেজন্যেই বাংলাদেশের মানুষ তার নাম চিরকাল মনে রাখতে চাইবে? অত্যাচারী আত্তিলা বা তৈমুরলঙের নাম এখনও ইতিহাসের পাতায় আছে ঠিকই, কিন্তু তাদের নির্মমতার মধ্যে নিশ্চয়ই টিক্কা খাঁ-এর মতাে কাপুরুষতা ছিল না। টিক্কা। খা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তাঁর মতাে মানুষের নাম শুধু জলেই লেখা থাকে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ জুলাই ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!