You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ২০শে আগস্ট, মঙ্গলবার, ৩রা ভাদ্র, ১৩৮১

ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতার আহ্বান

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত রোববার রাতে বেতার ও টেলিভিশন থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন যে, স্বাধীনতার পর ৩২ মাসে আমরা যতটুকু এগিয়েছিলাম, দেশের সাম্প্রতিক বন্যা আমাদের ততটুকু পিছিয়ে দিয়েছে। সর্বনাশা বন্যার ভয়াবহতায় নিমজ্জিত ভুক্তভোগীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমরা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এখনো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিনি, কিন্তু তবুও আমরা আজ জরুরি অবস্থার আওতা বহির্ভূত নই।
সমগ্র দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জলবন্দি আর্ত মানবতার ডাকে সাড়া দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা যেমন শত্রুকে ভয় পাইনি, তেমনি আমরা ঝড় এবং বন্যার বিপদ দেখেও যেন হতাশ না হই; আমরা যেনো নিদারুণ দুর্দিনেও সাহসের সঙ্গে বেঁচে থাকার সংগ্রামে সামিল হতে পারি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব বিরাজিত থাকলে কোন দুর্যোগেই আমাদের জাতীয় অস্থিত্বের ধ্বংস সাধন করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে একথা সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষনা করেছেন যে, ক্ষুধার্ত, বন্যার্ত, মানুষের মুখের গ্রাস যারা কেড়ে খায়, তারা মানুষ না, মানুষরূপী পশু। তাই তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রিলিফ নিয়ে কোনোরকম ছেলেখেলা বরদাস্ত করা হবে না। জনগণের দুর্দশার সুযোগ নিয়ে যারা মুনাফার পাহাড় জমায়, সেই সমাজ শত্রুদের বিরুদ্ধেও বঙ্গবন্ধু কড়া সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সরাসরি বলেছেন, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মজুদদার এবং চোরাকারবারীদের বাংলার মাটি থেকে সমূলে বিনাশ করতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে দেশবাসীর সাহায্য ও সহায়তা কামনা করেছেন।
বঙ্গবন্ধু এবারের বন্যাকে ‘এক মহা জাতীয় দুর্যোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এবং বলেছেন, এ দুর্যোগে হতাশ না হয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর এখন প্রতিটি সুনাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। বঙ্গবন্ধু দেশের বন্যা পরিস্থিতির আলোকে সমগ্র দেশের অর্থনীতির একটা চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমরা একটা না একটা বিপদের মোকাবিলা করে চলেছি। পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজ শেষ না হতেই দেখা দিয়েছিল খাদ্যাভাব এবং মুদ্রাস্ফীতি। বিদেশী পত্রিকা প্রকাশ করেছিল যে, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে এবং এর দুর্ভিক্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, দুর্ভিক্ষ হয়নি। আমরা সাধ্যমত দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করেছি। কিন্তু সাইক্লোন, সামগ্রিক জলোচ্ছ্বাস, স্থানীয় বন্যা এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী টেন সংকটের ধকল আমরা এড়াতে পারিনি। আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা বাংলাদেশের গায়েও এসে লেগেছে। বঙ্গবন্ধু তাই বলেছেন, আমি জানিনা, পৃথিবীর অন্য কোন নব্য স্বাধীন এবং গরীব দেশ আমাদের মত একটার পর একটা পৌনঃপুনিক এ ধরনের নতুন বিপদের ঝুঁকি সামলাতে পেরেছে কিনা। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থাই করেননি। ফলে ২৭ বছরে বন্যা সমস্যা আরো জটিল হয়ে উঠেছে। একটা গরীব দেশের পর্বতপ্রমাণ সমস্যা স্বাধীনতা লাভের ৩২ মাসের মধ্যে সমাধান করা সম্ভব নয়। তবুও আমরা চেষ্টার কার্পণ্য করিনি। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটকে সমাজ শত্রুরা আরো ঘনিভূত করে ফেলেছে। ফলে, আমরা প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারি ও চোরাচালানিরা সরকারি উদারতাকে দুর্বলতা মনে করে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বেসামরিক প্রশাসন এবং সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানের ফলও পাওয়া যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, অতীতে আমরা পরাজিত হইনি। বর্তমানেও আমরা পরাজিত হবো না। শুধু চাই ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতা।
বন্যার্তদের মরণপণ সংগ্রামের কাহিনী বঙ্গবন্ধুর অজানা নয়। তিনি দুঃখী মানুষের পাশে রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বিশ্বব্যাপী মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বাংলাদেশের মানুষকে উৎপাদন বাড়াতে হবে। ভোগবিলাস দিতে হবে বিসর্জন। সমাজ শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আর অর্থহীন সমালোচনা সমস্যার সমাধান হবে না। নিজ নিজ দায়িত্ব পালন এবং কাজ করার মধ্যেই রয়েছে এ সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি। বঙ্গবন্ধু বন্যার পর পুনর্বাসনের সমস্যাটি নিয়েও উদ্বিগ্ন রয়েছেন। কোটি কোটি ছিন্নমূল সহায়-সম্পদের মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়, জনগণেরও। বন্যার পর চাষী ভাইয়েরা যাতে আবার মাঠে মাঠে সোনার ফসল ফলাতে পারে সেজন্য সরকারি কৃষি বিভাগ এবং ত্রাণ তহবিল থেকে সাহায্য দেয়া হয়েছে। মহামারী রোধেও সরকার সাধ্যমত সাহায্য দেবে। বঙ্গবন্ধু জল বন্দীদের নিরাপত্তা ও বিপদ মুক্তির জন্য সর্বসাধারণের সহযোগিতা প্রার্থনা করেছেন। তার প্রতিটি কথায়ই দেশ এবং দেশের দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের করুণ অবস্থা নিবারণের প্রতিশ্রুতি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর্ত-মানবতার সেবায় সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে তার মহানুভবতার উদাহরণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তার এই আহ্বানের প্রতি তার কোন নাগরিকেরই পৃষ্ঠপ্রদর্শন এর উপায় নেই। আমরাও আশা করি, দুর্যোগের কাল একদিন কেটে যাবেই।

কেঁচো খুঁড়তে সাপ

আর্চবিশপ মেকারিয়াসের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি পছন্দ হয়নি সাম্রাজ্যবাদী চক্রের। তাই সাইপ্রাস প্রেসিডেন্ট মেকারিয়াসকে উৎখাত করার জন্য ভেতরে ভেতরে চক্রান্ত জাল ও ছড়ানো হল। একদিন দেখা গেল গ্রিসের সামরিক জান্তার আশীর্বাদপুষ্ট ন্যাশনাল গার্ড বাহিনী গ্রিক সাইপ্রিয়টদের সহায়তায় উৎখাত করেছে প্রেসিডেন্ট ম্যাকারিয়াসকে। প্রেসিডেন্ট মেকারিয়াস দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। বিদেশে গিয়ে বললেন, সাইপ্রাসকে দ্বিখণ্ডিত করার চক্রান্ত চলছে। হলোও তাই। সাইপ্রাস কার দখলে যাবে এই নিয়ে ন্যাটোর এক সদস্য অপর এক সদস্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। সাইপ্রাস প্রশ্ন নিয়ে শুরু হলো আভ্যন্তরীন কোন্দল। তুরস্ক যে এভাবে আচমকা সাইপ্রাস আক্রমণ করবে তার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কল্পনাও করতে পারেনি। তুরস্কের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে হুমকি দেওয়া হল এই বলে যে, সংঘর্ষ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে কোন দেশকে সামরিক সাহায্য দেওয়া হবে না।
এদিকে জেনেভাতে একটা আলোচনা বৈঠকেরও আলোচনা করা হয়েছিল। তাও ভেস্তে গেল শেষমেষ। জেনেভা বৈঠক ভেঙে যাওয়ার পর পরেই গ্রীস সন্দেহ করল আমেরিকা তুরস্কের পক্ষ নিয়ে বলে। গ্রিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ জর্জ মারভস জেনেভা ত্যাগের প্রাক্কালে ঘোষণা করলেন ন্যাটো থেকে তার সামরিক বাহিনী তুলে নিয়েছে। তিনি বলেন, ন্যাটোর আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
গতকালই সংবাদ বেড়েছে যে, ভবিষ্যতে গ্রিসে আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে গ্ৰীস সরকার চিন্তাভাবনা করছেন। দেশে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মনোভাব মাথাচাড়া এবং জোট বহির্ভূত নীতি অনুসরণের ক্রমাগত দাবি সরকারকে এই পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সংবাদে আরো বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সাইপ্রাস সংকট প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অসন্তুষ্ট সাইপ্রাসের শহরতলীতে আমেরিকানদের একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা হেলেনিকোর মার্কিন বিমান ঘাঁটির কাছে আরও দুইটি আমেরিকান গাড়ির মারাত্মক ক্ষতি করে। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বন্দর ব্যবহারের সুযোগ সুবিধাসহ গ্রিসের উত্তরাঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকার পুনর্বিবেচনা করেছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, গ্ৰীস- মার্কের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় গ্রিসের মার্কিন ঘাঁটির রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। গ্রিসে আমেরিকান ঘাঁটি গুলো হচ্ছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় আমেরিকান পলিসির চাবিকাঠি।
ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি বড়ই নির্মম। কেউ বলতে পারে না কখন কি হবে। গ্রিসে সামরিক সরকার ছিল। প্রবল প্রতাপ নিয়ে গ্রিসকে শাসন ও করেছে সামরিক সরকার। সাইপ্রাস সংকট দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক সরকারকে বিদায় নিতে হলো। অবস্থাটা ক্রমশঃ ঘোরালো হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেখানে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী চক্র নিজেদের লীলাখেলা চালাবার জন্য যে গ্রীসকে একদিন গ্রাস করেছিল বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই গ্রীসই রাহুমুক্ত হতে চাইছে। আমরা জানি না আগামী দিনগুলোতে কি হবে সেখানে। তবে এটা অনায়াসে বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদী চক্রের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুলো। এ সাপ যে কোনো সময় ছোবল মারতে পারে। অন্ততঃ ইতিহাস তো তাই বলে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!