বাংলার হরফ সমস্যা
সৈনিক
ঢাকা, শুক্রবার ২৭শে ফালগুন,
১৩৬৫ ইং ১১ মার্চ ১৯৪৯
‘পূর্ব পাকিস্তানের হরফ সমস্যা এবং সােজা বাংলা প্রবর্তন সম্বন্ধে তমদুন মজলিশের সাহিত্য শাখার উদ্যোগে গত ৪ মার্চ ফজলুল হক মিলনায়তনে এক আলােচনা সভা হয়। জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ জনাব আবদুর রহমান খান। সভাপতিত্ব করেন। সােজা বাংলা সম্বন্ধে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব এক সুচিন্তিত প্রবন্ধ পাঠ করেন। অতঃপর সৈনিক সম্পাদক শাহেদ আলী চাটগাঁও সরকারি কলেজের অধ্যাপক জনাব ফেরদৌস খানের লেখা একখানি ইংরেজি পুস্তিকায় সহজ বাংলা তর্জমা পাঠ করেন। সভা বাংলা ভাষার হরফ নির্ধারণের ভার বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞদের উপর ছাড়িয়া দিবার দাবি জানাইয়া ও শিক্ষাউপদেষ্টা কমিটির সুপারিশ বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।
বাংলা ভাষায় আরবি বর্ণমালা
বাংলা বর্ণমালা ও ভাষা সংস্কার সমস্যা আজ পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র যুব ও বুদ্ধিজীবী জনসাধারণেরই মনকে বিশেষ ভাবিয়ে তুলেছে। গত বৎসরে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন ও এমনি ভাবে সবার মনে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যে ৮ দফা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তার প্রধান দুটো শর্ত ছিল। (১৯৪৮) এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পরিষদের যে সরকারি বিষয়ের আলােচনার দিনে বাংলাকে বাংলা উর্দুর সমান মর্যাদা দিয়ে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করে একটা বিশেষ প্রস্তাব পাস করানাে হবে। ইংরেজির পরিবর্তে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে বলে ঘােষণা করে পরিষদে সরকারিভাবে একটা বিল আনা হবে। কর্তৃপক্ষ প্রথম শর্ত সম্পর্কে তাদের ওয়াদার খেলাপ করলেও দ্বিতীয় শর্ত সম্পর্কে একটা প্রস্তাব পূর্ব পাক পরিষদে উত্থাপন করেছিলেন এবং তা সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীতও হয়েছিল। আফসােসের বিষয় পরিষদের এ সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্য গত ১৩ মাসের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে কোনাে চেষ্টাই হয়নি। অন্তত চার ভাষা সংস্কার কমিটি গঠনের খবর সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছে এবং জনাব মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব প্রত্যেক বারই এই সংবাদ অস্বীকার করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রীর দুর্বলতা এবং শিক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারির কারসাজির ফলেই ভাষা সংস্কার কমিটি নিয়োেগ সম্পকীয় ফাইলটা গত বার মাস উধাও অবস্থায় থাকে এবং আজো নাকি সেটা পাওয়া যায়নি। বর্তমান বাজেট অধিবেশনের পূর্ব মুহূর্তে ভাষা সমস্যা বিশেষ করে বর্ণমালা সম্পর্কীয় আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠতে শুরু করলাে ঠিক সেই সময় আন্দোলনকে এড়িয়ে যাবার জন্যই একটি কমিটির নাম প্রচার করা হলাে। সত্যিকার ভাষাবিদদের বাদ দিয়ে যিনি বাংলা ভাষার জন্য জেহাদ করতে চেয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁকেই সভাপতি এবং জনৈক উর্দু ভক্তকে কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হইয়াছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে চক্ষু এবং ক্ষত চিকিৎসকও রয়েছেন, কমিটিতে দুজন ভাষাবিদকে লওয়া হয়েছে শুধু লােক দেখানাের জন্যই। শিক্ষা দপ্তরের উল্লিখিত সেক্রেটারি মাধ্যমিক শিক্ষায়তন সমূহের বাধ্যতামূলক উর্দু প্রবর্তনের ও উর্দুকে শিক্ষার বাহন করার জন্য আদাপানি খেয়ে লেগেছিল কিন্তু শিক্ষাবিদদের সরল মনােভাবের জন্যই তার অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাঁর এ উদ্দেশ্য সিদ্ধি মানসেই পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষাবাের্ডকে সরকারি খপ্পরে আনা হয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত গত বছরের প্রস্তাবটা উর্দু চাপানাের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল। আর একই পরিষদে একবারের গৃহীত প্রস্তাবকে বাতিল করতে পারে না। ভবিষ্যতের নবনির্বাচিত পরিষদও এ প্রস্তাবকে নাকচ করার সাহস করবে না। কাজেই উর্দুর জন্য কাজের দুয়ার যখন রুদ্ধ তখন আরবি বর্ণমালার সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে অগ্রসর হইয়া বাংলার মতাে একটি আঞ্চলিক প্রগতিশীল ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর এক প্রকার নির্বোধ আক্রমণ কেবলমাত্র আমাদের জাতীয় জীবনের বন্ধ্যাত্ব এবং পশ্চাদগতিই টানিয়া আনিবে না বরং ইহার অপমৃত্যু ডাকিয়া আনিবে। অতএব সংস্কার মােহ অর্থহীন স্বার্থশূন্য দৃষ্টিতে আমরা আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ এব জাগ্রত জনসাধারণকে বিষয়টি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ হইতে ধীর ও স্থির মস্তিষ্কে বিবেচনা করিয়া সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হবে এবং আজ জানাইতেছে নিঃসন্দেহে বাংলায় আরবি হরফ প্রণয়ন যে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অগ্রগতিকে চিরতরে রুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অগ্রগতিকে চিরতরে রুদ্ধ করিয়া দিবে তাহার স্বপক্ষে আমরা নিম্নলিখিত বৈজ্ঞানিক ও পক্ষপাতশূন্য যুক্তি উপস্থাপিত করিতেছি।
হরফ পরিবর্তন
পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষাগুলির জন্য আরবি হরফের যে সুপারিশ করিয়াছেন একমাত্র বাংলার উপরই তাহার আঘাত তীব্র এবং ব্যাপকভাবে পড়িবে। পাঞ্জাবি, সিন্ধি, ব্রাঞ্ছই, বেলুচি, পুশতু এবং বাংলা পাকিস্তানের এই প্রাদেশিক ভাষাগুলাের মধ্যে একমাত্র বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেই ভাব ঐশ্বর্য্যে প্রকাশভঙ্গীর উৎকর্ষে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলাের মধ্যে অন্যতম।
অন্যান্যগুলির সাহিত্য কোন চর্চা নেই। জিগির তুলে পশ্চাৎ দুয়ার দিয়ে উর্দু প্রবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে এবং পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব ও বাংলা ভাষাকে খতম করবার ষড়যন্ত্র চলছে। যখনই আলেম সমাজ আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছেন তখনই এঁরা নীরবতা অবলম্বন করেছেন। আরবিকে বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষা করার ব্যাপারেও এঁদের মুখে কথা নেই। যে জিনিসটা পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের মনে সবচেয়ে বেশি আলােড়ন সৃষ্টি করেছে সেটা হচ্ছে এই যে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত লােকের হার শতকরা ১২ থেকে ১৫ জন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৫ জনের কম, আরবী বর্ণমালার দোহাই দিয়ে শতকরা এই ১৫ জনকে শিক্ষিতকে কলমের এক খোচায় অশিক্ষিতে পরিণত করবার ষড়যন্ত্রে সাফল্য মণ্ডিত হবার চেষ্টা চলছে। এমনিভাবে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারও ইংরেজি প্রচলন করে ভারতের আরবি-পারশি শিক্ষিত মুসলমানকে কলমের এক খোচায় অশিক্ষিতে পরিণত করবার ষড়যন্ত্রে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। আরবি বর্ণমালা প্রচলিত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষিতের হার ঠিকই থাকবে পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিতের হার শতকরা ১৫ জন থেকে নেমে আসবে নগণ্য ভগ্নাংশে। শিক্ষক অভাবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান অবস্থাতেই অচল হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় সমস্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় অশিক্ষিত বলে পরিগণিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের গােটা শিক্ষা ব্যবস্থাই বানচাল হয়ে যাবে। কাজেই ‘তােগলকী প্লানের উদ্যোক্তাদের আমরা দ্বিধাহীন ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে আরবি বর্ণমালার ধুয়া তুলে গত বছরের ভাষা প্রস্তাবকে নাকচ করবার ষড়যন্ত্রকে আমরা কোনাে অবস্থাতেই সহ্য করে নেবাে না। শিক্ষা সম্বন্ধীয় আসল সমস্যাসমূহকে চাপা দিয়ে কতগুলাে বাজে প্রশ্নের অবতারণা করে এঁরা গণমতকে যেভাবে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছেন তাতে জাতি এদের কোনাে দিনই ক্ষমা করবেন না। পূর্ব পাকিস্তানের যুবক, ছাত্র জনসাধারণ এব্যাপারে জনমত গঠনের জন্য এগিয়ে আসবেন এবং এর প্রতিবাদ জানাবেন এ বিশ্বাস আমাদের আছে।
(নইমুদ্দীন আহমদ) ২৫শে চৈত্র শুক্রবার, ১৩৫৫
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম