জুলাই মাসের তৎপরতা
পল কনেটের নেতৃত্বে “এ্যাকশন বাংলাদেশ” সরাসরি বাংলাদেশে সাহায্য প্রেরণ করার উদ্দেশ্যে ‘ওপারেশন ওমেগা-১’ এর পীস টীম’ সংগঠিত করে একটি ব্যতিক্রমধর্মী কার্যক্রম গ্রহণ করে। সাহায্য সামগ্রী সহ সাবেক বৃটিশ পুলিশ মার্ক ডুরানের নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট টীম ১ জুলাই লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের উদেশ্যে যাত্রা করে। এ সময় বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের কর্মী ও মহিলাসহ প্রায় ৩ শতাধিক বাঙালী পীস টীম’কে বিদায় সম্বর্ধনা দেয়। এ ধরনের দুঃসাহসিক ও প্রতীকি কর্মসূচী গ্রহণ করার জন্য’এ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর বৃটিশ কর্মীদের অভিনন্দন জানানাে হয় এবং তাদের সফলতা কামনা করা হয়। ইতােপূর্বে বৃটিশ পার্লামেন্টে পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক শেষে পরিস্থিতি সরজমিনে দেখার জন্য যে পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা হয়েছিল সেই সদস্যগণ ভারত ও পূর্ববঙ্গ সফর করে ফিরে এসে লন্ডনে ৪ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়ােজন করে। প্রতিনিধি দলের নেতা রেজ প্রেন্টিস বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে পারে। পাকিস্তান জোড় করে পূর্ববঙ্গ’কে তাদের সাথে রাখতে পারবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তাই ইয়াহিয়া খানের উচিৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সাথে আলােচনা করে সমস্যার সমাধান করা। তিনি এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিরও দাবি করেন। প্রতিনিধি দলের অপর এক কনজারভেটিভ পার্টির এম. পি. টোবি জ্যাসেল বলেন, “পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের বর্বোরােচিত আক্রমণে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তাদের আক্রমণ থেকে নারী ও শিশুরা পর্যন্ত রক্ষা পায় নি এবং হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। পার্লামেন্টারী দলের পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য লন্ডনের পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে বৃটিশ ওভারসীজ মন্ত্রী মিসেস জীল নাইট প্রতিনিধিদলের পর্যবেক্ষণ রিপাের্ট উল্লেখ করে ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক পত্রে তার উদ্বেগের কথা জানান। জুলাই মাসের ৫ তারিখে স্কটল্যান্ডের এবারডিন (Aberdeen) শহরে বৃটিশ খনি শ্রমিক ইউনিয়ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিক রাজনীতি তথা বৃটেনের রাজনৈতিক অঙ্গনে খান শ্রমিক ইউনিয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
তাই বিলাতে বাম সংগঠক কমিটিসমূহ ৫ জুলাইয়ের সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার কার্য। “মচালনা ও তাদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করে। এবারডিন ও তার আশে ২৪ ” পাশের শহরের বাঙালীরা সম্মেলন স্থলে অবস্থান গ্রহণ করে এবং লন্ডন থেকে প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশের শ্রমিকদের উপরে যে অকথ্য অত্যাচার ও হত্যায় চলছিল তার চিত্র সম্বলিত পােষ্টার ও ব্যানারসহ শত শত বাঙালি সম্মেলন স্থলে অবস্থান গ্রহণ করে। বাঙালি প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের সংঘটিত হত্যাযঞ্জের বিবরণ, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও বৃটিশ শ্রমিকদের সমর্থনের আবেদন সম্বলিত প্রচারপত্র খনি শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে। বিতরণ করেন। উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি গুরুত্বের সাথে আলােচিত হয় এবং নির্যাতিত জনগণের পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনে বৃটিশ খনি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লরেন্স ডেলী (Lawrence Daly) “পূর্ব পাকিস্তান” পরিস্থিতির উপর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে “পূর্ব পাকিস্তান” পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংকটের সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ফলপ্রসূ আলােচনার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। প্রস্তানে বলা হয় যে, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেছে এবং সেই মতামতকে উপেক্ষা করে নিরীহ বাঙালীদের উপর পাকিস্তানের পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন নিন্দনীয় অপরাধ।” প্রস্তাবে “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানসহ হাজার হাজার কারাবন্দীর মুক্তি এবং পাকিস্তানে বাঙালীদের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি বেসামরিক সরকার গঠনের দাবি উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবের অপর অংশে পাকিস্তান সংকটের গ্রহণযােগ্য সমাধান ও পাকিস্তান সরকারের পরিচালিত সামরিক অভিযান বন্ধ করার জন্য। বৃটিশ সরকারের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। বৃটেনসহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রচার ও তাদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে তৎকালীন এমএনএ শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান, শ্রমিক লীগের সভাপতি মােহাম্মদ শাহজাহান মধ্য জুন থেকেই লন্ডনে অবস্থান করছিলেন।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি এবং বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সাথে দেশ থেকে আগত শ্রমিক নেতৃবন্দের মত বিনিময়ের উদ্দেশ্যে লন্ডন ডব্লিউ সি-১ এর ২৫ নং রেডলায়ন কোয়ারে অবাঞ্ছত কনওয়ে হলে যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের উদে আমার সভাপতিত্বে ৩ জুলাই এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। সভায় সফররত নেতাদ্বয় ছাড়াও লন্ডনের বিভিন্ন সংগ্রাম কমিটি ও ষ্টিয়ারিং কমিটির নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন সভায় মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালােচনা করা হয় এবং দেশকে মুক্ত না যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার শপথ পুনর্ব্যক্ত করা হয়। জুলাই মাসে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যার আকার ধার বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমিটিসমূহ উদ্বাস্তুদের করুণ অবস্থা ও তালে মানবিক আবেদন জানিয়ে বিভিন্ন দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রচারপত্র বি করা হয়। সভায় সফররত শ্রমিক। দেশকে মুক্ত না করা পর্যন্ত যার আকার ধারণ করে। তাদের রক্ষা করার স্থায় প্রচারপত্র বিতরণ করে। ৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মুখপত্র “ফ্যাক্টসীট-১৪” এ উদ্বাস্তু সমস্যা পরিদর্শনের জন্য গ্রেরিত আমেরিকার প্রতিনিধিদলের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার প্রয়াস গ্রহণ করে। উদ্বাস্তু সমস্যা পরিদর্শনের জন্য প্রেরিত ৫ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য আমেরিকার ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক সহকারী সেক্রেটারী এ. বি. ডিউক সাংবাদিকদের বলেন যে, Refugee problem is the greatest crisis since World war-11 Their plight is tragic beyond description. মধ্য জুনে উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পর্কে জাতিসংঘের রিলিফ কমিশনার পাকিস্তানের নাগরিক প্রিন্স সদরুদ্দিন আগাখানের বিতর্কিত মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত অবস্থা তদন্তের জন্য আমেরিকার সরকার উল্লেখিত ৫-সদস্যের প্রতিনিধি দল ভারতের সীমান্তে অবস্থিত শিবিরগুলােতে প্রেরণ করে। বৃটিশ পার্লামেন্ট মাননীয় এম. পি আর্থার বটমলির নেতৃত্বে শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। পাশ্চাত্যের সকল পর্যবেক্ষকদের রিপাের্ট ও বক্তব্যে উদ্বাস্তু সমস্যা সংক্রান্ত প্রিন্স সদরুদ্দিনের জুন মাসের আশাবাদী “Optimisitic “মন্তব্য” did not see why the Refugees should not be able to return home in time” প্রকৃতপক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রমাণিত হয়। বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য পাকিস্তান সরকার “পূর্ব পাকিস্তানে” স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান এবং উদ্বাস্তুরা দেশে ফিরে যাচ্ছে বলে দাবি করে মিথ্যা প্রচার চালায়। পাকিস্তানের এই মিথ্যাচারের মুখােশ উন্মােচিত হয় ১৪ জুলাই তারিখে “দি টাইমস’-এ প্রকাশিত বিশ্ব। ব্যাংকের একটি রিপাের্টের মাধ্যমে। দি টাইমস পত্রিকা বিশ্বব্যাংকের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্য হেনড্রিক ভ্যানডার হেইজডােনে (Hendrick Van Dey Heijden) এর।
রিপাের্ট প্রকাশ করে। বিশ্ব ব্যাংকের এই মিশন ৩ থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের যশাের, কুষ্টিয়া, খুলনা, চালনা ও মংলা ইত্যাদি শহর সরেজমিনে তদন্ত করে। উক্ত রিপাের্ট প্রস্তুত করে। রিপাের্টটি “Bank report on Bengal destruction” শিরােনামে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের বিস্তারিত ‘হসাব প্রকাশ করে। রিপাের্ট উল্লেখিত শহরগুলাের ধ্বংসের বিবরণ প্রদান করতে গিয়ে। কুষ্টিয়া শহর সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় যে, …Ninety percent of the houses, shops, banks and other buildings were totally destroyed. The City looked like a second world war German town having undergone strategic bombing attacks (The Times. July 14, 1971)” তােপূবে বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রতিনিধি দলের নেতা আর্থার বটমলি (Arthur Ottomly) বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে দেশে ফিরে অনুরূপ রিপােট। শ করেন। পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের রিপাের্ট ও বটমলির বক্তব্যের টাইমস পত্রিকা “The terror that পাদকীয় প্রকাশ করে। এই সম্পাদকীয়তে পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ জুলাই লন্ডন থেকে প্রকাশিত দি টাইমস পত্রিকা “The perpetuates terror” শিরােনামে এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এই সম্প মন্তব্য করা হয় যে, “As the evidence accumulates from East Paki almost all hopes for plitical compromise seen to be vanishing The evidence also confirms how false is the picture of events offers by the Pakistan Government in Islamabad. এমনিভাবে পাকিস্তানের অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণিত করে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা আত্মপ্রকাশ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বজনমতের সমর্থন বৃদ্ধি লাভ করে। বিলাতে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সফরের প্রতিবাদে গৃহিত কর্মসূচীর অংশ হিসাবে ৮ এবং ১০ জুলাই লীড়সের হেডিংলী ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। সফরের এই পর্যায়ে ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। খেলার প্রথম দিন (৮ জুলাই) এবং শেষ দিন (১০ জুলাই) লীড় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং পাকিস্তানীদের বর্বরতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান ও ব্যানার হাতে ক্রিকেট টীমের সফরের প্রতিবাদ জানানাে হয়।
১০ জুলাই ব্রেডফোর্ড শহরে সংগ্রাম পরিষদ আয়ােজিত এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসাবে স্টিয়ারিং কমিটি শেখ আবদুল মান্নান ও কবীর চৌধুরী সভায় বক্তব্য রাখেন। ১৬ জুলাই কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনে বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিল করে লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসে এবং ১০ নং ডাইনিং স্ট্রীটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বাংলাদেশকে সমর্থন দানের আবেদন জানিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করা হয় । ১৮ জুলাই, রবিবার ষ্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনের হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে পাকিস্তানকে আমেরিকা ও চীনের সাহায্য প্রদানের প্রতিবাদে এক সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। কভেন্ট্রি সম্মেলনে গৃহিত সিদ্ধান্ত মােতাবেক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন না করায় এই কর্মসূচী গ্রহণে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলেও সমাবেশ সফল ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। | বৃটেনের বিভিন্ন শহর থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি সমাবেশে যােগ দেয়। প্রায় ১০ হাজা | বাঙালি বিক্ষোভ মিছিল প্রথমে চীনা দূতাবাসে এবং পরে আমেরিকান দূতাবাসে গমন ” স্মারকলিপি পেশ করে। উভয় স্মারকলিপিতে গণহত্যাকারী পাকিস্তানকে সাহায্য বণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানানাে হয়। বিক্ষোভ মিছিলটি ১০নং ডাইনিং এ গিয়ে সমাপ্ত হয় এবং সেখানে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে অপর একটি স্মারকলিপি ”জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকার আইনজীবীদের বাৎসরিক সম্মেল অনুষ্ঠিত হয়। দেড় হাজারের মতাে আমেরিকার আইনজীবী তখন লন্ডনে অবস্থা সুযোগে তাদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্য পরিচালনার জ কমিটি, ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ও লন্ডনস্থ অন্যান্য সংগ্রাম কমিটি কার্যক্রম অবাৎসরিক সম্মেলন লন্ডনে ” লন্ডনে অবস্থান করার পরিচালনার জন্য ষ্টিয়ারিং কার্যক্রম গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বৃহৎ শক্তিগুলাের মধ্যে আমেরিকার সরকার পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন অব্যাহত রেখেছিল। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ইয়াহিয়া খানের বাঙালী নিধন কার্যক্রমকে আমেরিকার সমর্থন প্রদানের ফলে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা খুবই কষ্টকর ছিল। তাই বার বার বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন, মেমােরেন্ডাম প্রদান, অনশন ধর্মঘট ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে আমেরিকার সরকারের মনােবৃত্তি পরিবর্তনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। আমেরিকার আইনজীবীদের সম্মেলন লন্ডনে অনুষ্ঠান একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। এই ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানের সুযােগ নিয়ে আমেরিকার বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা ও পরিস্থিতি ব্যাখ্যা এবং প্রচারের ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। আমেরিকার জনগণের মতামতের উপর নির্ভর করে আমেরিকার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয় এই বিবেচনায় আমেরিকা থেকে আগত আইনজীবীদের কাছে মেমােরেন্ডাম, চিঠি ও পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থনের জন্য আবেদন জানানাে হয়। ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং এ্যাকশন বাংলাদেশ যৌথভাবে আমেরিকান বার এসােসিয়েশনের সকল সদস্যের কাছে একটি পত্র প্রেরণ করে। পত্রে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ কি নির্মমভাবে জাতিসংঘের “Genocide Convention” এর নীতিকে লংঘন করে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালাচ্ছে তার বিবরণ দেয়া হয়। পত্রে ১৩ ও ২০ জুন এবং ১১ জুলাই তারিখে ‘সানডে টাইমসে প্রকাশিত রিপাের্টের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলা হয় যে, ঐ সকল রিপাের্টে বর্ণিত ঘটনার মাধ্যমে উক্ত কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট ধারা (Ila. IIb. Ile) সমূহ পরিষ্কারভাবে লংঘন হয়েছে। তাই গণতান্ত্রিক একটি দেশের মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন আইনজীবীদের কাছে আইন ও মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে সােচ্চার হওয়ার। অনুরােধ জানানাে হয়। সর্বশেষ আবেদন জানানাে হয় যে… “We urge you, therefore, individually and collectively to approach your Government to bring this matter before the U. N. without further delay.”
উল্লেখ্য যে, এই পত্রে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ জাতিসংঘের মানবাধিকার আইন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ লংঘিত হওয়ায় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ। চৌধুরী আমেরিকার বার এসােসিয়েশনের সকল সদস্যকে অপর একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আমেরিকার আইনজীবীদেরকে “আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ আখ্যায়িত করে পত্রে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে স্বের প্রকৃত সকল আইনকে লংঘন করেছে এবং শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের জনগণের উপর রেখেছে। পত্রে আরাে বলা হয় যে, দশের স্বাধীনতার ঘােষণা করেছে। তাই নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। পত্রে আরাে বলা জনগণের ভােটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের পাশে দাড়ানাের জন্য আমিেরকার আইনজীবাদের আহ্বান জানানাে হয়। আবেদনের a… বলা হয় যে, “The Government of Bangladesh fervently hopes that you will urge upon the government of the world including your own government to recognise the independent Government of Bangladesh and stop all supply of arms and economic aid to the Government of West Pakistan and demand release of Shaikh Majibur Rahman and all other political prisoners and thus pave the way for establishment of the Rule of law in East Bengal, now Bangladesh. উপরােক্ত পত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে 2017-18 “Conflict in East Pakistan-background and prospect.” “The murder of people and” “Why Bangladesh.” ইত্যাদি পুস্তিকাসমূহ। প্রত্যেক আইনজীবীকে হােটেলের কক্ষে পৌছে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে। সহযােগিতা করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ। সম্মেলন স্থল থেকে প্রত্যেক প্রতিনিধির হােটেল কক্ষ ও নাম সংগ্রাহ করে প্রত্যেককে উপরােক্ত কাগজপত্র পৌছে দেয়া। হয়।
এখানে উল্লেখযােগ্য যে, আমেরিকান বার এসােসিয়েশনের এই ব্যতিক্রমধর্মী সম্মেলনে রিপাবলিকান ও ডেমােক্রেটিক পার্টির নেতৃবৃন্দ সিনেটে ও প্রতিনিধি পরিষদের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী অংশগ্রহণ করেছিলেন। লন্ডনে বসে আমেরিকার প্রায় দেড় হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে যােগাযােগ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লবিং করা বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে খুবই কার্যকরী পদক্ষেপ ও ফলপ্রসূ অবদান রেখেছিল। এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আমেরিকার আইনজীবীদের বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ২০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপ একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে “An open letter to the Delegates of a American Bar Association from the people of Bangladesh একটি খােলা চিঠি প্রকাশ করে। উক্ত খােলা চিঠির উপরিভাগে বাংলাদেশ সরকামে* প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমানের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি শােভা পায়। খােলা শুরুতেই এই চিঠির উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, “We W” you because you are lawyers and laws are being broken, you are Americans and America can do a great deal to the suffering and because you are a body powerful enough শাভা পায়। খােলা চিঠির being broken; because reat deal to end our erful enough to get his message through to President Nixon.”উক্ত খােলা চিঠিতে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের বিবরণ প্রদান করা হয় এবং এতদসংক্রান্ত পাশ্চাত্যের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপাের্টের উল্লেখ করা হয় । খােলা চিঠিতে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার ও জেনােসাইড কনভেনশনে গৃহীত নীতিমালার ন্যাক্কারজনক লংঘন বলে অভিহিত করে তার প্রতিকারের জন্য মুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন আমেরিকার আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। উক্ত খােলা চিঠিতে আমেরিকান বার এসােসিয়েশনের সম্মানিত সদস্যদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে নিম্নলিখিত বিষয়ে আবেদন জানানাে হয় ?
(ক) আমেরিকা কর্তৃক পাকিস্তানকে প্রদত্ত সকল সামরিক সহযােগিতা বন্ধ করা। | (খ) বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পূর্বে পাকিস্তানকে নতুন কোন আর্থিক সাহায্য মঞ্জুর না করা।
(গ) বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি।
(ঘ) স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান।
(ঙ) বাংলাদেশে সংঘটিত সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ড আন্তর্জাতিক শান্তির প্রতি হুমকি ও জেনােসাইড কনভেশনের লংঘন হওয়ায় উক্ত বিষয় জাতিসংঘের স্বস্তি পরিষদে উত্থাপন।
উক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রকাশিত খােলা চিঠিতে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সকল জনগণকেও আহ্বান জানানাে হয়। | ২৬ জুলাই বৃটিশ পার্লমেন্টের হারকোর্ট রুমে এক অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়। বৃটিশ এম, পি, এবং সাবেক পােষ্ট মাষ্টার জেনারেল জন স্টোন হাউজ ডাকটিকেট মুদ্রণ, প্রকাশ ও প্রচারের সকল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বৃটিশ পার্লামেন্টের উভয় দিকের প্রভাবশালী এম. পি বৃন্দ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডাকটিকিটগুলাে সকলকে দেখান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গণপরিষদ সদস্য ও শ্রমিক নেতা আঃ মান্নান (মরহুম) উপস্থিত ছিলেন। ডাক টিকেট গুলাের ডিজাইন তৈরি করেন বাঙালি গ্রাফিক শিল্পী বিমান মল্লিক।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার শুরু হবে মর্মে বিলাতের পত্র পত্রিকার খবর প্রকাশিত হয়। বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা এই খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে বিলাত থেকে আইনজীবী প্রেরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিচারপতি সাধুরা নােবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত এবং আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক যাতি সম্পন্ন আইনজীবী শশার ম্যাকব্রাইডকে ইসলামাবাদে গিয়ে শেখ মুজিবের পক্ষ পমথনের অনুরােধ জানান। শাের ম্যাকব্রাইড বিচারপতি চৌধুরীর প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন এবং বার্নার্ড শেরিডেন সলিসিটার ফার্মের একজন সলিসিটার সহ জুলাই মাসের শেষ দিকে সলামাবাদে গমন করেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী হওয়ার কারণে তার পাকিস্তান গমনের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । মি, ম্যাকব্রাইড ইসলামাবাদে সরকারী উধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও ইয়াহিয়া খানের আইন উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাকে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি এবং ইয়াহিয়া খানও তাঁকে সাক্ষাদানের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায়। তাকে আরাে জানানাে হয় যে, কোন বিদেশী আইনজীবীকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থন করার সুযােগ দেয়া হবে না। বিফল মনােরথে লন্ডন প্রত্যাবর্তন করে মি. ম্যাকব্রাইড এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রহসনের বিচারের পাকিস্তানী দুরভিসন্ধির বিষয়ে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। | ৩১ জুলাই পাের্টসমাউথে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদ এবং পাের্টমাইথে ইংরেজ সমর্থকদের যৌথ উদ্যোগে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ক্ৰমলী এবং প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন পাের্টসমাউথ থেকে নির্বাচিত এম, পি, ফ্রাংক জ্যাড, স্থানীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী এবং লন্ডনে থেকে বিচারপতি চৌধুরীর সফর সঙ্গী সুলতান মাহমুদ শরিফ, জাকারিয়া খান চৌধুরী ও সামসুল আলম চৌধুরী। প্রধান অতিথির ভাষণে বিচারপতি চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমানকে গােপনে প্রহসনমূলক বিচারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং তার মুক্তি দাবি করেন। ফ্রাংক জ্যাড তার বক্তব্যে শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচারের জন্য নিন্দা প্রকাশ করেন এবং তার মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির উপর গুরুত্ব প্রদান করেন।
আগস্ট মাসের প্রথম দিনে লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ারে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে এক ব্যতিক্রমধর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতদিন যত সভা-সমাবেশ হয়েছে তা বাঙালীদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ১ আগস্টের সমাবেশ আয়ােজন করে লন্ডন এন ডব্লিউ-১ এর ৩৪ নং ষ্টাটফোর্ড ভিলাস্থ এ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি স্থানীয় সংগঠন। বৃটিশ যুব নেতা পল কনেটের নেতৃত্বে। এবং বৃটিশ এমপি, সমাজকর্মী ও আইনজীবী সমন্বয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে উক্ত সংগঠনটি লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করা হয় । ট্রাফালগার স্কোয়ারের এই সমাবেশ আয়ােজনে কেন্দ্রীয়। স্টিয়ারিং কমিটি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সমিতি এ্যাকশন বাংলাদেশকে সহযােগিতা করে। সমাবেশ উপলক্ষে একটি পােস্টার ছাপানাে হয় এবং তা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগানাে হয়। পােস্টারে STOP GENOCIDE’ এবং ‘RECOGNISE BANGLADESH RALLY’ শিরােনামে ১ আগস্ট বিকাল ২ টায় ট্রাফেলগার স্কোয়ারের র্যালীতে যােগদানের আহ্বান জানানাে হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে একটি বৃটিশ সংগঠনের সমাবেশ আয়ােজন এবং মিছিল সহকারে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে। স্মারকলিপি পেশ বিদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে এক উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছে। ১ আগস্টের এই সমাবেশে বিভিন্ন স্তরের বৃটিশ খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের বাংলাদেশের সমর্থন জ্ঞাপন ছাড়াও পাকিস্তান দূতাবাসের একজন দ্বিতীয় সচিব পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঘােষণা প্রদান সমাবেশটিকে আরাে গুরুত্বপূর্ণ করে তােলে। _ ট্রাফেলগার স্কোয়ারের র্যালীতে বৃটিশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ইতােমধ্যে বাংলাদেশ ও তার সীমান্ত পরিদর্শনকারী রেজ প্রেনটিস (এমপি), জন ষ্টোনহাউজ (এমপি) এবং রেভারেন্ড কেনিয়ন রাইট (কভেন্ট্রি ক্যাথড্রেলের আরাবান ষ্ট্যাডিজের পরিচালক) তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বক্তব্য রাখেন। তাঁরা বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও রিলিফ ক্যাম্পগুলাের রুণ অবস্থার কথা সমাবেশে ব্যক্ত করেন। বৃটিশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে আরাে বক্তব্য রাখেন লডকওয়ে, কুইনস কাউন্সিলর ও প্রখ্যাত আইনজীবী টম উইলিয়াম (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আইনজীবী) মঞ্চ ও চিত্রনাট্য শিল্পী ডেভিড কসপ, চার্চ মিশনারী সােসাইটির যুব পরিচালক রেভারেন্ড রজার ক্রসথওয়েইট, বিশিষ্ট সমাজকর্মী লেডী গিফোর্ড, কেমিক্যাল মস ইউনিয়নের মহাসচিব বব এডওয়ার্ড (এম পি), ইয়ং লিবারেল পার্টির রাজনৈতিক ” চেয়ারম্যান সায়মন হেড্রিচ এবং এ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর পক্ষে পল কনেট। “”শের উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য।
রাখেন বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং মহিলানেত্রী মিসেস লুলু বিলকিস বানু। সমাবেশে সকল বক্তা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ নয়. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবি উত্থাপন করেন। | উক্ত সভায় লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব বাঙালি কূটনীতিবিদ মহিউটি আহমেদ হত্যাকারী পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন। এভাবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হওয়ায় বৃটেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন আরাে জোরদার হয়। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, মহিউদ্দিন আহমদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বিভিন্ন দূতাবাস থেকে বাঙালি কূটনীতিবিদরা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সমর্থন করেন। সমাবেশ শেষে এক বিরাট মিছিল ১০নং ডাইনিং স্ট্রীটে গমন করে এবং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে একটি স্মারকলিপি প্রদান করে। স্মারকলিপিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবগুলাে ছিল নিম্নরূপঃ (ক) বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ জাতিসংঘের জেনােসাইড কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট ধারা লংঘন বিধায় বিষয়টি জাতিসংঘের স্বস্তি পরিষদে উত্থাপনের জন্য বৃটিশ সরকারকে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরােধ; (খ) পাকিস্তানে সামরিক অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য আমেরিকার সরকারের প্রতি চাপ প্রয়ােগ করা; (গ) বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করা এবং (ঘ) বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য পাকিস্তানের উপর বৃটিশ সরকারের কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি। স্মারকলিপির সাথে ১১ জন প্রিভি কাউন্সিলর ও ৩০ জন প্রাক্তনমন্ত্রীসহ ২০০ জন এম পি স্বাক্ষরিত বৃটিশ পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। তার একটি কপি সংযযাজন করা হয়। ৫ আগস্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান ও রেডক্রস সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশন’-এর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড্রেপারকে সঙ্গে নিয়ে জেনেভা গমন করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য জেনেভায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক রেডক্রসের হেডকোয়ার্টারে আনুষ্ঠানিক ভাবে আবেদন সে। করার জন্য অধ্যাপক ড্রেপারকে ব্যারিষ্টার নিয়ােগ করা হয়। বিচারপতি চৌধুরী ও অধ্যা ড্রেপার আন্তর্জাতিক রেডক্রসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে আনুষ্ঠানিক দর। পেশ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা ও মুক্তির জন্য রেডক্রসকে যথাযথ ?” পালনের অনুরােধ করেন। জেনেভায় অবস্থানকালে বিচারপতি চৌধুরী ইন্টারন্য কমিশন অফ জুরিষ্টস’ এর সেক্রেটারী জেনারেল নীল ম্যাকডারমেটের সাথেও সাক্ষাৎ করেন।
ইতােমধ্যে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের হিসাব পরিচালক লুৎফুল মতিন। লাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্মসচিব), শিক্ষা অফিসার হাবিবুর রহমান এবং বার্মিংহামস্থ পাকিস্তানের লেবার অফিসের কর্মকর্তা ফজলুল হক পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সংগ্রামে অংশগ্রহণের কথা ঘােষণা করেন। বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১ আগস্টের সমাবেশে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহম্মদসহ উপরােক্ত কর্মকর্তাদের সংবর্ধনা প্রদানের জন্য লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারস্থ কনওয়ে হলে ৮ আগস্ট এক জনসভার আয়ােজন করে। উক্ত গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অপর আহ্বায়ক এ জেড এম মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী কর্মকর্তাদের ছাড়াও উক্ত গণসংবর্ধনায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এই সমাবেশে পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তৎকালীন ডেপুটি ডাইরেক্টর লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার জন্য অবস্থানরত আবদুর রউফ পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা ঘােষণা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে আবদুর রউফ বৃটেনে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি বিভিন্ন সংগ্রাম কমিটি পােষ্টার ও প্রচারপত্র লেখায় সহযােগিতা ছাড়াও প্রথমে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এবং পরে কেন্দ্রীয় ষ্টিয়ারিং কমিটি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’ নামক সংবাদ বুলেটিন সম্পাদনা করতেন। উক্ত গণসংবর্ধনায় বিভিন্ন বক্তা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী অফিসারদের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার প্রশংসা করেন। এবং তাদের অংশগ্রহণে দেশে মুক্তিযুদ্ধ আরাে শক্তি সঞ্চয় করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কনওয়ে হলে একই দিনে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির উদ্যোগে একটি মিনাবাজারের আয়ােজন করা হয়। মিনাবাজার উদ্বোধন করেন বিচারপতি চৌধুরী ও মিসেস চৌধুরী। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ এক মনােজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দেন।
আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বৃটিশ পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও গ্রেফতারকৃত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের গােপন বিচার শুরু হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এ খবর প্রকাশের সাথে সাথে বৃটেনের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদ সমূহ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত নেতার বিরুদ্ধে গােপন বিচারের প্রতিবাদে সভা, শােভাযাত্রা ও প্রচারপত্র প্রকাশ। করে। সামরিক আদলতে গােপনে শেখ মুজিবর রহমানের বিচারের ষড়যন্ত্র-এর বিরুদ্ধে বিশ্ব-জনমত সৃষ্টি ও তার প্রতিবাদ করার জন্য ১১নং গােরিং স্ট্রীটে অবস্থিত কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে ১১ আগস্ট বেলা ২টার হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়। সভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর মানের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য গণতান্ত্রিক সকল দেশের সরকার ও জনগণের এই আহ্বান জানানাে হয়। সভায় বৃটিশ সরকারকে এ ব্যাপারে কূটনৈতিক পদক্ষেপ। শহণের অনুরােধ জানানাে হয়। হাইড-পার্কের এই গণসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ষ্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূইয়া এবং প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বৃটিশ এম, পি, পিটার মশা মাইকেল বার্নস, ব্রুস ডগলাস-ম্যান, জন স্টোন হাউজ, রেজ প্রেন্টিস ও লর্গ গিফোর্ড প্রম বাংলাদেশের সমর্থক বৃটিশ নাগরিকবৃন্দ। এছাড়াও বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে বক্তত রাখেন গউস খান, শেখ আবদুল মান্নান, ব্যারিষ্টার সাখাওয়াত হােসেন এবং লুলু বিলকিস বান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সমাবেশ শেষে বিচারপতি চৌধুরী ও বৃটিশ এম, পিদের নেতৃত্বে একটি মিছিল ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে গমন করে এবং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে শেখ মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গােপন বিচার বন্ধ ও তার মুক্তির দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ১৫ আগস্ট লন্ডনের আমেরিকান দূতাবাসের সামনে ‘এ্যাকশন বাংলাদেশ’ এর কর্মীরা। এক ব্যক্তিক্রম ধর্মী কার্যক্রম গ্রহণ করে। সেদিন ট্রাফেলগার স্কোয়ারে ইয়াহিয়া খানের সমর্থনে “পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট” এর উদ্যোগে বাংলাদেশ বিরােধী এক জনসমাবেশের আয়ােজন করা হয়েছিল। এই জনসভার প্রতিবাদে আমেরিকান দূতাবাসের সামনের রাস্তায় “এ্যাকশন বাংলাদেশ” এর কর্মীরা হত্যা অভিনয় প্রদর্শন করে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হত্যাকান্ডের একটি প্রতিকি চিত্র আমেরিকান দূতাবাস ও পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কয়েকজন শাড়ী পরিহিতা নারী রাস্তার ফুটপাথে শুয়ে পরে এবং তাদের উপর তিন গাড়ী বােঝাই পাকিস্তানী সামরিক পােষাক পরিহিত সৈন্য নির্বিচারে গুলি করার অভিনয় করে একটি নাটকীয় দৃশ্যের উপস্থাপনা করে। ১৬ আগস্ট মর্ণিং ষ্টার পত্রিকায় এই হত্যা অভিনয়ের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৭ আগস্ট “ওপারেশন ওমেগা” এর পীস টীমের ৮ জন বৃটিশ ও ৩ জন আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেনাপােল চেকপােষ্ট। অতিক্রম করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করে। ১ আগস্ট ট্রাফেলগার। স্কোয়ার থেকে ওপারেশন ওমেগা’ এর এই পীস টীম বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা। হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ওপারেশন ওমেগা’ এর প্রতিষ্ঠাতা পল কনেটের স্ত্রী আইলীন কনেট ছিলেন। গ্রেফতারকৃত স্বেচ্ছাসেবকদেরকে ২৬ ঘণ্টা আটক রেখে পাকিস্তান। সেনাবাহিনী তাদেরকে পশ্চিমবঙ্গে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তান সরকারের সাথে কিছুসংখ্যক কূটনৈতিক ও কর্মকর্তা সম্পর্ক ছিন্ন করায় বিলাতের বাঙালীদের মধ্যে বিপুল সাড়া লক্ষ্য করা যায়। বিলাতের বিভিন্ন শহরের আঞ্চলিক কমিটিসমূহ সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তিদের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার জন্য সংবর্ধনা আয়ােজন করে। এমনি একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয় ১৫ আ ব্রাডফোর্ড শহরের তকদীর রেষ্টুরেন্টে। বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি, ইয়র্কশায়ার শাখা। সংবর্ধনা সভার আয়ােজন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে সম্পর্কছিন্নকারীদের পক্ষ থেকে মাই আহমেদ (২য় সচিব), লুৎফুল মতিন (হিসাব পরিচালক), ফজলুল হক চৌধুরা (অফিসার), মহিউদ্দিন চৌধুরী (পি এই এর কর্মকর্তা) এবং নূরুল হুদা (কণফুণ জর ক্যাপ্টেন) উপস্থিত ছিলেন। উপরােক্ত ব্যক্তিদের সংবর্ধনা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নান এবং ইয়ার্কশায়ার কমিটির কর্মকর্তাবৃন্দ ।
গ্রেফতারকৃত বাংলাদেশের নেতা ও বাংলাদেশের সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর তমানের পাকিস্তানে গােপন বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় একটি বড় ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদানের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিজ্ঞাপন প্রদানের উদ্দেশ্যে আর্থিক সহযােগিতা দানের জন্য বিলাতের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদসমূহের কাছে আহ্বান জানিয়ে পত্র দেন। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৬৩টি কমিটি সহযােগিতা করতে সম্মতি জানায়। ৬৩টি কমিটির নামসহ ১৬ আগস্টের দি টাইমস পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে যে শিরােনাম শােভা পায় তা হলাে ঃ “Wake up world-please act immediately to stop camera trialSecure release of the President of the Peoples Republic of | Bangladesh. বিজ্ঞাপনে সংক্ষেপে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এবং ২৫ মার্চ থেকে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের একটি বিবরণ প্রদান করা হয়। বিজ্ঞাপনে শেখ মুজিবর রহমানের গােপন বিচারের প্রচেষ্টাকে ন্যাক্কারজনক দুরভিসন্ধি আখ্যায়িত করে এই বিচার বাংলাদেশের সকল জনগণের বিরুদ্ধে বিচার অনুষ্ঠানের শামিল বলে উল্লেখ করা হয়। এতে | বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় যে, “Can the world really afford to watch | such an outrageous act of vengeance?” পরিশেষে বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের | নির্যাতিত স্বাধীনতাকামী জনগণের পক্ষে দাবি জানানাে হয় যে “We demand that the British Government, the Uniled Nations and the people of the World put a stop to this trial of Shaikh Mujibur Rahman and secure his release.” | বৃটিশ সংবাদপত্রের একাংশ প্রকাশিত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে শান্তি আলােচনার | খবরের তীব্র প্রতিবাদ করে ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী একটি বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি নিম্নে প্রদত্ত দাবিগুলাে মেনে ” নেয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কোন প্রকার শান্তি আলােচনা বা সমঝােতার কান প্রশ্নই ওঠেনা বলে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। দাবিগুলাে ছিল ঃ (১) পাকিস্তান সরকার তৃক বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা, (২) বেআইনীভাবে পাকিস্তানে আটক
প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিদান, (৩) “দেশের পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানের প্রতিটি হানাদার সৈন্য প্রত্যাহার । তিনি স্ততে আরাে বলেন যে, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপােষ বাঙালি মেনে নিবেন না। বিলাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের যাবতীয় খরচ প্রবাসী বাঙালীদের ও সাহায্য থেকে বহন করা হতাে। মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতার জন্য প্রবাসী বাঙালীরা উৎসাহ প্রকাশ করে যে, ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে হামজ ব্যাংকে ইতিপূর্বে যে এত খােলা হয়েছিল তা প্রবাসীদের চাহিদা মেটাতে অসমর্থ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়, স্টিয়ারি কমিটি ও বাংলাদেশ ফান্ড’ এর ট্রাষ্টি বাের্ডের সিদ্ধান্তক্রমে ন্যাশনাল ওয়েষ্টমিনিষ্টার বাংলায় অপর একটি একউন্ট খােলা হয় এবং তা ষ্টিয়ারিং কমিটির বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৯ আগস্ট প্রচার করা হয়। লন্ডন এস ডব্লিউ-১ এর ৬নং টথিল স্ট্রীটস্থ ন্যাশনাল ওয়েস্টমিনিষ্টার ব্যাংকের ব্রাঞ্চে (ব্যাংক কোর্ড ৬০-৪০-০৩) একাউন্ট নম্বর ০০৭৭২২ এর মাধ্যমে এই নতুন একাউন্ট পরিচালনা করা হয়। ২৭ আগস্ট বিলাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের এক স্মরণীয় দিন। এই দিনে ভারতের বাইরে বাংলাদেশের একমাত্র মিশন স্থাপন করা হয়। লন্ডনের নটিংহিল গেইটে অবস্থিত ২৪নং প্রেমব্রিজ গার্ডেনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের দূতাবাসের উদ্বোধন করেন। মুজিবনগর সরকার বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা ও সমন্বয় সাধন করার উদ্দেশ্যে লন্ডনে এই মিশন স্থাপনের অনুমােদন দান করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে লন্ডনের মিশনের প্রধান নিয়ােগ করা হয়। ২৭ আগস্ট মিশন উদ্বোধনের দিনে বিচারপতি চৌধুরীর সাথে পাকিস্তান সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী কূটনৈতিক ও কর্মচারীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইরাক থেকে আগত রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ, মহিউদ্দিন আহমেদ (দ্বিতীয় সচিব, লন্ডন দূতাবাস), লুৎফুল মতিন (হিসাব পরিচালক, লন্ডন দূতাবাস), ফজলুল হক চৌধুরী (লেবার এটাচি), আবদুর রউফ (চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর), মহিউদ্দিন চৌধুরী (পি আই এ কর্মকর্তা), নূরুল হুদা ও আবদুল সালাম। উপরােক্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে লন্ডনে মিশনের কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিলাতের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বিপারপতি চৌধুরী এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন। লন্ডনই বাংলাদেশ মিশন উদ্বোধনের খবর ছবিসহ বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় ২৮ আগস্ট ছাপানাে হয়। এই মিশন পরিচালনায় বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বাধা বা বিপত্তি সৃষ্টি হয়নি।
লন্ডন মিশনটি যে ভবনে স্থাপিত হয় তা মূলত ওয়ার আন ওয়ান্টের ডনান্ড চেসও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। উক্ত ভবনের বিদ্যুৎ ও পানি বিল পরিশােধ’ ছাড়া অন্য কোন ভাড়া বা রেন্ট দিতে হতাে না। ২৪ নং প্রেমব্রিজ গার্ডেন্সের বিল্ডিংটি আ উপযােগী করার মেরামত ও আসবাবপত্র ক্রয় বিলাতে বসবাসকারী বাঙালীদের আ৷” সাহায্যে সম্ভব হয়। মিশনের দৈনন্দিন কাজের সুবিধার্থে কয়েকজন প্রবাসী বাঙালী আসবাবপত্র দান টকিতে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি ৬০০ পাউন্ড খরচ করে এক আসবাবপত্র দান করেন। খরচ করে একটি ফটো মন মেশিন ও একটি ডুপ্লিকেটিং মেশিন মিশনকে দান করেন। এমনিভাবে মাসুদ মিয়া, হর মিয়া, আবুদল মতিন, আবদুল মালেক, আটক মিয়া ও আবদুল বাসিত মিলিতভাবে কটি ফাইল কেবিনেট দান করেন। ডনাল্ড চেসওয়ার্থের ব্যবস্থাপনায় এবং প্রবাসীদের ও সহযােগিতায় লন্ডন মিশন এ পর্যায়ে কাজ শুরু করে। বিচারপতি আবু সাঈদ ধরী থেকে জানা যায় যে, পরবর্তিকালে মিশন পরিচালনার জন্য পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা জনৈক বাঙালি ধনাঢ্য ব্যক্তি সুবেদ আলী ছদ্মনামে যথেষ্ট সাহায্য প্রদান করেছেন। লন্ডন মিশনকে বৃটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেননি। কিন্তু বাঙালীদের কাছে এই মিশনটি দূতাবাসের মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রসংগত উল্লেখযােগ্য যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহুদিন পর্যন্ত ২৪ নং প্রেমব্রিজ গার্ডেন্স মিশনটি বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক দূতাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে উক্ত ভবনটিকে বাংলাদেশ সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২১ আগস্ট ইরাকে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ইরাক থেকে আবুল ফতেহ গােপনে লন্ডনে চলে আসেন এবং ১১ নং গােরিং স্ট্রীটে আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী আবুল ফতেহকে সাংবাদিকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। ঐ সময় পর্যন্ত যে সকল বাঙালি কূটনৈতিকবৃন্দ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন তাদের মধ্যে আবুল ফতেহ রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের প্রথম কর্মকর্তা। ২৯ আগস্ট লন্ডনের অদুরে লুটন শহরে এক জনসভা স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বিচারপতি চৌধুরী এবং অন্যদের মধ্যে শেখ আবদুল মান্নান ও জাকারিয়া খান চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তানী নাগরিকরা এই সভা ভণ্ডুলের চেষ্টা করে কিন্তু বৃটিশ পুলিশের হস্তক্ষেপে সভাটি শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাপ্ত হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন