You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.22 | মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান | জুন মাসের তৎপরতা - সংগ্রামের নোটবুক

জুন মাসের তৎপরতা

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর সীমান্ত অতিক্রম এবং সীমান্তে স্থাপিত রিলিফ ক্যাম্পগুলাের করুণ অবস্থার বিবরণ বৃটেনসহ আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকার শিরােনামে স্থান লাভ করে। এপ্রিল ও মে মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে এবং হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সমাবেশ শােভাযাত্রাসহ বিভিন্ন প্রচারের গুরুত্ব জুন মাসে বিশ্ব জনমতের কাছে অর্থবহ হয়ে ওঠে এবং সারা দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় মানুষ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে পুনরায় গুরুত্ব আরােপ করে। রিলিফ ক্যাম্পগুলােতে স্থানাভাব, খাদ্যের অভাব ও কলেরার প্রাদুর্ভাব বিশ্ব জনমতকে উদ্বিগ্ন করে তােলে।  ৪ জুন লন্ডনের রেডলায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে’ যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আমার (লেখক) সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ‘মুজিব নগর থেকে আগত রেহমান সােবহান, সদ্য বাংলাদেশ থেকে আগত জনমত পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনিস আহম্মদ, এ্যাকশন বাংলাদেশ এর নেতা পল কনেট এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে এ. টি. এম. ওয়ালী আশরাফ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। রেহমান সােবহান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অর্থনৈতিক যুক্তি প্রদান করে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। আনিস আহম্মদ ঢাকা থেকে প্রত্যাবর্তন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সভাকে অবহিত করেন। সভায় বক্তাগণ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিলাতের কর্মকাণ্ড আরাে জোরদার করার সংকল্প ব্যক্ত করে। বিচারপতি চৌধুরী বিলাতের আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য বিলাতে অধ্যয়নরত বাঙালী ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামনের কাতারে থেকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ৪ জুন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ ও বাংলাদেশকে সমর্থন দানের দাবিতে প্রবাসী বাঙালি মহিলা ও শিশুদের সমন্বয়ে লন্ডনে একটি মিছিলের আয়ােজন করে। মিসেস জেবুন্নেছা বখত ও আনােয়ারা জাহানের নেতৃত্বে সেন্ট জেমস পার্ক থেকে শুরু করে মিছিলটি ডাইনিং স্ট্রীটে এসে সমাপ্ত হয়। ৫ জুন শেফিল্ড শহরে শেফিল্ড এ্যাকশন।

কমিটির উদ্যোগে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। উক্ত জনসভায় বিচারপতি আবু সাঈদ প্রধান অতিথি এবং শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফ্র্যাংক গার্লিং, ষ্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান ও কবীর চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন। ৬ জুন লন্ডন এ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনে এক জনসভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতির উপর বক্তব্য রাখেন। সভাটি পূর্ব লন্ডনের গ্রান্ড প্যালেস হলে ‘লন্ডন এ্যাকশন কমিটি’ এর সভাপতি গউস খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তৈয়বুর রহমান ও জাকারিয়া খান চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত “বাংলাদেশ ফান্ড” এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়।  বৃটিশ পার্লামেন্টে পাকিস্তান পরিস্থিতি’ ও শরণার্থী সমস্যা পুনরায় আলােচনার জন্যে স্থান পায়। ৮ জুন লেবার পার্টির আন্তর্জাতিক কমিটি পাকিস্তানকে বৃটেনের সাহায্য হ্রাসের জন্যে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। লেবার পার্টির এমপি এবং প্রাক্তন বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট উক্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং লেবার পার্টির অন্য এমপি মিসেস বারবারা কেসল প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। উক্ত প্রস্তাবটি বৃটিশ বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী রিচার্ড উডের কাছে মিসেস জুডিথ হার্ট ও পিটার শাের আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করেন। একই দিনে বৃটিশ পার্লামেন্টে রক্ষণশীল দলীয় এমপি (সরকার দলীয়) বয়েড কার্পেন্টার যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীদের সীমান্ত অতিক্রম ও রিলিফ ক্যাম্পসমূহের অবস্থার উপরে একটি দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই পর্যায়ে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম পার্লামেন্টে পাকিস্তান পরিস্থিতির উপর একটি বিবৃতি প্রদান করন। তাঁর এবারের বিবৃতি এপ্রিলে প্রদত্ত বিবৃতি থেকে অনেক নরম সুরের এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি পার্লামেন্টকে অবহিত করেন যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বর্বরতার ভয়ে ভীত হয়েই লক্ষ-লক্ষ শরণার্থী তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে।

তিনি বিবৃতিতে বলেন যে, “They were afraid of intolerable suppressive action by the Pakistan Army, and only a political settlement would get them back to their homes.” (The Guardian, June 9, 1971) স্যার আলেক ডগলাস হিউম “পূর্ব পাকিস্তানে” ভবিষ্যতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, পাকিস্তানের উচিত জাতিসংঘের সহযােগিতা নিয়ে খাদ্য পরিস্থিতির ত্বরিত মােকাবিলা করা। উদ্বাস্তু সমস্যা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে বিষয়টি বৃটিশ পার্লামেন্টে পূর্ন আলােচনার জন্য গৃহীত হয়। প্রথম দিনের (৮ জুন, ১৯৭১) আলােচনায় বিরােধী দলীয় সংসদ নেতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মিঃ উইলসন শরণার্থী সমস্যাকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক আখ্যায়িত করে মন্তব্য করেন যে, “—the worst human tragedy the world has known since the war, apart from war self.” বিরােধী দলীয় এমপি এবং প্রাক্তন বৈদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট বলেন যে, বাঙালীদের বিষয়টি আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনার অবকাশ নেই। পার্লামেন্টের ভাষায় ‘পাকিস্তান পরিস্থিতি ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে পার্লামেন্টে দ্বিতীয় দিনে (৯ জন) আলােচনা অব্যাহত থাকে। ৯ জুনে স্যার আলেক ডগলাস হিউম ছাড়াও বক্তব্য রাখেন মিসেস জুডিথ হার্ট (লেবার পাটি), জর্জ থমসন (লেবার পার্টি), রিচার্ড উড (কন্সাৰ্বভেটিভ পার্টি) প্রমুখ বৃটিশ এমপিবৃন্দ। ৯ জুন পার্লামেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমতের সহানুভূতি বৃদ্ধির আভাস পরিলক্ষিত হয়। তিনি পার্লামেন্টে পরিষ্কার ভাষায় বলেন যে, “Peace will not return to East Pakistan unul civil governmnt has been restored…… Otherwise the danger of war could be very real and would convert what is already a tragedy into a catastrophe” (The Guardian, June 10. 1971). ১১ জুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার ভবিষ্যত সম্পর্কে লন্ডনের “উইক এন্ড টেলিভিশন” একটি আলােচনা অনুষ্ঠান প্রচার করে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে এবং পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থনের জন্য কনজারভেটিভ পার্টি” এর এম. পি. জন বিগস্ ডেভিসনকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। অনুষ্ঠানে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালাে যুক্তিপ্রদর্শন করে বাঙালীদের উপর পাকিস্তানের শােষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের কথা তুলে ধরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।

১২ ও ১৩ জুন লন্ডনে “ইন্টারন্যাশনাল। ইউনিয়ন অফ সােসালিষ্ট ইয়থস্” এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে লবিং করা এবং প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে লুঙ্কর রহমান সাহজাহান, আকতার ইমাম, শফিউদ্দিন আহম্মদ বুলবুল, এ. কে. নজরুল ইসলাম, এম, এইচ, প্রামানিক ও মজিবুল হক অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে একটি প্রস্তাব গৃহিত হয়। ১৩ জুন লন্ডনের ‘জনমত’ পত্রিকায় যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আহবায়ক (২) হিসাবে আমার একটি বিবৃতি গুরুত্ব সহকারে ছাপানাে হয়। বিবৃতিতে পাকিস্তানের রক্ত রঞ্জিত ও হত্যাকারী ভাবমূর্তিকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ক্রিকেট ডামের বৃটেন সফরের প্রতিবাদ করার জন্য ১৯ জুন শনিবার বেলা ১.০০ টায় হাইডপার্ক কাস কণীরে আহুত ছাত্র জনসভাকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য সকলের কাছে আহ্বান জানানো হয়। একই দিন (১৩ জুন) লন্ডনের ৩২নং ওন্ড কম্পটোন স্ট্রীটে “বাংলাদেশ ওয়ারক্রস সােসাইটি” এর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সােসাইটির সম্পাদক আবদুল্লা ফারুক । সভায় বক্তব্য রাখেন এরশাদ আলী, ডাঃ মােকলেসুর রহমান এবং ডাঃ সােবহান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ১৩ জুন লন্ডনের বহুল প্রচারিত টেলিভিশন ‘আই, টি, ভি’ সন্ধ্যায় ‘ম্যান ইন দি নিউজ’ নামক এক প্রােগ্রামে বিচারপতি চৌধুরীর এক সাক্ষাৎকার প্রচার করে। সাক্ষাৎকারে বিচারপতি চৌধুরী পাকিস্তান পূর্ববঙ্গে’ যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা গােপন করার অভিযােগ করে বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা। বড় বড় শহর ছাড়া বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই । বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানাের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যত দ্রুত স্বাধীন হবে তত শীঘ্র এই গণহত্যার অবসান হবে। ১২ জুন সেন্ট অবন্স শহরে এ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় বিচাপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন। সভায় শেখ আবদুল মান্নান ও আমি বিচারপতি চৌধুরীর সাথে উপস্থিত ছিলাম। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৩ জুন লীডস শহরে লীডস বাংলাদেশ এসােসিয়েশন এবং লীডস লিবারেশন ফ্রন্টের যৌথ উদ্যোগে আয়ােজিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন।

১৩ জুন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের দাবিতে লন্ডনে যুব সংঘের উদ্যোগে মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিলটি হাইডপার্ক থেকে শুরু করে পিকাডিলি, পার্ক লেইন, ডাইনিং স্ট্রীট প্রদক্ষিণ করে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে গিয়ে শেষ হয়। ১৪ জুন অপর একটি মিছিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে হােয়াইট হলে এসে সমাপ্ত হয়। পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের দাবিতে এবং সফররত পাকিস্তান ক্রিকেট খেলার প্রতিবাদে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯ জুন বিকেল ১টায় লন্ডনের হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক বিশাল সমাবেশের আয়ােজন করে। আমার সভাপতিত্ব সমাবেশে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও বৃটিশ এমপি পিটার শাের। এছাড়া বৃটিশ ‘ইয়ং লিবারেল পার্টির সভাপতি পিটার হেইন, ছাত্র-সংগ্রামের পক্ষ থেকে এ জেড মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও সুলতান শরিফ এবং বৃটেন সফররত বাংলাদেশের নির্বাচিত এম এন এ, আবুদল মান্নান। (শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক) ও শ্রমিক লীগ সভাপতি মােহাম্মদ শাহজাহান সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে বিভিন্ন বক্তাগণ বিশ্বের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী সকল সরকার ও জনগণের কাছে পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার আবেদন জানান। বক্তাগণ পাকিস্তানকে সাহায্য করাকে বাংলাদেশে গণহত্যাকে সরাসরি সাহায্য করার শামিল বলে অভিহিত করেন। সমাবেশ শেষে একটি বিরাট মিছিল স্পীকার্স কর্ণার থেকে অক্সফোর্ড স্ট্রীট, পাের্টম্যান স্ট্রীট ও গ্লোসটার প্লেস হয়ে লর্ডস ক্রিকেট মাঠের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সেন্ট জন উড রােডে সমাপ্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, লর্ডস ক্রিকেট মাঠে তখন সফরকারী পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।

২০ জুন ওয়েলসের প্রধান শহর কার্ডিফে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিচারপতি চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসাবে যােগদান করেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন শেখ আবদুল মান্নান। সভায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও বিশ্বব্যাপী প্রচার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এছাড়া তিনি পাকিস্তানের সাথে। বাংলাদেশের একটি আপােষরফা হচ্ছে বলে যে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানাে হচ্ছে তার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ঘােষণা করেন। ১৯৭১-৭২ আর্থিক বছরের জন্য পাকিস্তানকে নতুন সাহায্য বরাদ্দ করার প্রাথমিক বিবেচনার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের ‘পাকিস্তান সাহায্য কনসরসিয়াম’ (Aid to Pakistan Consortium)-এর সভা ২১ জুন প্যারিসে আহবান করা হয়। পশ্চিমের শিল্পোন্নত। দেশসমূহ ও প্রাচ্যের জাপানের সমন্বয়ে ১১ জাতির অর্থনৈতিক জোট পাকিস্তানকে আসন্ন জুলাই মাসের আনুষ্ঠানিক সভায় অর্থ বরাদ্দ করা হবে কিনা তার আলােচনার জন্য দাতা দেশগুলাের প্রতিনিধিরা প্যারিসে ২১ জুন সমবেত হন। বিলাতের প্রবাসী সংগ্রাম পরিষদসমূহ পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করার আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য উক্ত সভাস্থলে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্ণা (Lobbing) দেয়ার জন্য লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে বাঙালীদের একটি বড় গ্রুপ প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাকিস্তান সাহায্য কনসরসিয়াম এর সভাটি বাংলাদেশের। মুক্তি সংগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে বলে উক্ত কার্যক্রমকে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়। লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বাঙালী প্যারিস গমন করে। এবং ২১ জুন বিশ্ব ব্যাংকের অফিসের সামনে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারসহ অবস্থান ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। প্যারিসে তৎকালে বাঙালীদের উল্লেখযােগ্য তেমন কোন বসবাস না থাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে বাঙালীরা প্যারিস গমন করে। প্যারিসে বিশ্বব্যাংক অফিসের সামনে বিক্ষোভের সময়ে যে সকল প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করা হয় তার বক্তব্য ছিল “Foreign aid for Pakistan means genocide for Bangladesh”: “Economic aid to Pakistan is tantamount to Financing massere in Bangladesh” Not a penny, not a gun to Tikka, Bhutto, Yahaya Khan” ইত্যাদি। পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের দাবিতে এছাড়াও দাতা দেশগুলাের প্রতি ষ্টিয়ারিং কমিটির মেমােরেন্ডাম প্রদান ও কূটনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।

প্যারিসের কনসরসিয়াম সভায় বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার তৎকালীন পরিচালক পিটার কারগিলের রিপাের্ট বিবেচনা করা হয় এবং পাকিস্তানকে সাহায্য বরাদ্দের জন্য জুলাই মাসের আনুষ্ঠানিক সভা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বৃটেন ও আমেরিকাসহ ১১ জাতির প্রতিনিধিবৃন্দ পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নতুন কোন সাহায্য বরাদ্দ করা হবে না বলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কনসরটিয়াম সভায় পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি ও মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় এবং বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট নৈতিক বিজয় ঘােষণা করে। এর ফলে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করে এবং কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২১ জুন বাংলাদেশের অপর একটি কূটনৈতিক বিজয় অর্জিত হয় সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এবং বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম এর যুক্ত বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে। ২২ জুন লন্ডনের পত্র-পত্রিকায় উক্ত যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে বাংলাদেশ ইস্যুতে বৃটিশ সরকারের মনােভাবের পরিবর্তন করে পাকিস্তানে বিরােধ নিস্পত্তির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা ব্যক্ত করা হয়। বিবৃতিতে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া উদ্বাস্তুদের করুণ অবস্থা ও তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির বিষয় গুরুত্ব লাভ করে। প্রায় ৬ মিলিয়ন উদ্বাস্তুর দেশে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিবৃতিতে বলা হয় যে, “It was recognised that this would only be possible if they were assured of a secure future…. Sir Alec Douglas Home and Mr. Swaran Singh agreed that a political solution must be found which would be acceptable to the people of East Pakistan”. (The Guardian. June. 22, 1971)। উক্ত ইশতেহারের মর্মবাণীতে বাঙালীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি প্রকারান্তরে সমর্থন ঘােষিত হয় এবং বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধ আরাে জোরদার  বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গণহত্যার প্রতিবাদে ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ নামে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্যোগে ২৫ জুন লন্ডনের কনওয়ে হলে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। লন্ডনে বসবাসকারী কিছু উদ্যোগী বাঙালি আইনজীবী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কিছু কর্মীর সহযােগিতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ।

বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে উক্ত সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ এর জনসভায় সভানেত্রীত্ব করেন নেতা গিফোর্ড। উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন কুইনস কাউন্সিলর জন প্লাটুস-মিল, ভারতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার অশােক সেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, লর্ড গিফোর্ড (বার এট’ল) এবং ব্যারিষ্টার সাখাওয়াৎ হােসেন প্রমুখ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীবৃন্দ। সভায় তকমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা কনভেনশন আহ্বানের জন্য একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। কনভেনশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের বিচার অনুষ্ঠানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক “যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইবুনাল (War Crime Tribunal)” গঠনের জন্য জাতিসংঘের কাছে। অনুরােধ জানানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৬ জুন লন্ডনের বেইজওয়াটার এলাকার “বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি” এর উদ্যোগে স্থানীয় হলে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। জনাকীর্ণ এই জনসভায় বাঙালি ছাড়াও অনেক স্থানীয় ইরেজ উপস্থিত ছিলেন। মনজুর মাের্শেদ তালুকদারের সভাপতিত্বে এই। জনসভায় প্রধান অতিথি হিসাবে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসাবে শ্রমিকদলীয় এম, পি, পিটার শাের উপস্থিত ছিলেন। আরাে বক্তব্য রাখেন শেখ আবদুল মান্নান। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তব্যে দেশে ও বিলাত প্রবাসে বাঙালীদের মধ্যে গত তিন মাসে যে ঐক্য ও প্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত বলে আশা পােষণ করেন। পিটার শাের তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক বাঙালীর মতাে তার সর্বাত্মক সহযােগিতা ও সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে ঘােষণা করেন। ২৭শে জুন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ ও বাংলাদেশকে সমর্থনের দাবিতে বার্মিংহামের ডিগবেথ হলে বার্মিংহামের বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাড়াও এম. পি. ব্রুস ডগলাস ম্যান এবং স্থানীয় এম পি, জুলিয়াস সিলভারম্যান বক্তব্য রাখেন।

২৮ জুন লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে বৃটেনের বিভিন্ন অঞ্চলের সগ্রাম পরিষদ সমূহের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিলাতে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল তার ব্যাখ্যা প্রদান করে বিচারপতি আবু সাঈদ চোধুরী কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত সম্মেলনকে অবহিত করেন। ২৮ জুন রাতে ওয়েলসের কার্ডিফ সমুদ্র বন্দরে পাকিস্তান শিপিং করপােরেশনের জাহাজ থেকে ১৫ জন বাঙালি অফিসার ও কর্মচারী ইঞ্জিনিয়ার একেএম হুদার নেতৃত্বে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এক সাংবাদিক সম্মেলনে তারা বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং এমভি কর্ণফুলীসহ সকল জাহাজে বাঙালীদের প্রতি পাকিস্তানীদের নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরেন। তাদের পক্ষে নূরুল হুদা জানান যে, ২৫ মার্চের কালাে রাত্রিতে এমভি কর্ণফুলী চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান করছিল। তিনি ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এমভি সােয়াতে সংঘটিত হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিবরণ এবং চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ আমদানির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি জানান যে, এমভি সােয়াতের সকল বাঙালি অফিসার ও কর্মচারীদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। নূরুল হুদা বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন জানান। বৃটিশ সরকার পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী ১৫ জন অফিসার ও কর্মচারীদের যুদ্ধ বন্ধ হওয়া পর্যন্ত বৃটেনে অবস্থানের অনুমতি প্রদান করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন