মে মাসে প্রবাসীদের তৎপরতা
শ্রমিক আন্দোলনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিন ১ মে তারিখে আমেরিকার শিকাগাে শহরের শ্রমিকদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করার জন্যে লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ারে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট শ্রমিক-জন সমাবেশ। এর আয়ােজনে থাকেন বৃটেনের সকল শ্রমিক সংগঠন ও লেবার দলীয় নেতৃবৃন্দ। এ বিশাল সমাবেশে বাংলাদেশের ইস্যুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সমিতি উক্ত সমাবেশে দলগতভাবে বাংলাদেশের ব্যানার ও বাংলাদেশের দাবিতে ফেটুন সহ অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লন্ডন সংগ্রাম পরিষদ, কাউন্সিল ফর লিবারেশন অব বাংলাদেশ ও ষ্টিয়ারিং কমিটি এই কার্যক্রমে ঐকমত্য পােষণ করেন। লন্ডনে প্রকাশিত জনমত পত্রিকা ও লিফলেটের মাধ্যমে লন্ডন ও আশপাশের শহরের সকল বাঙালীকে হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে সমবেত হয়ে মে দিবস প্যারেডে অংশগ্রহণ এবং স্ট্রাফেলগার স্কোয়ারের সমাবেশে যােগদানের আহ্বান জানানাে হয় । ঘােষিত কাৰ্যসূচী মােতাবেক শত শত বাঙালী হাইড পার্কে সমবেত হয়ে বাংলাদেশের পতাকা, ব্যানার ও ফেটুন বহন করে অক্সফোর্ড স্ট্রীট দিয়ে শােভাযাত্রা করে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে গমন করে। বাংলাদেশের সংগ্রামী ও নির্যাতিত জনগণের পক্ষে বিরাট শােভাযাত্রা দেখে মে দিবসের উদ্যোক্তরা আনন্দিত হন এবং উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে মাইকে ঘােষণার মাধ্যমে একাত্মতা ঘােষণা করা হয়। সমাবেশটিতে বিলাতের প্রগতিশীল শ্রমিক শ্রেণীর সকল নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ইতােপূর্বে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের অনেকেই ব্যক্তিতভাবে পার্লামেন্টে বা তাদের দলীয় সভায় বাংলাদেশের প্রতি তাদের সহানুভূতি ব্যক্ত করেছেন। উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে উপস্থিত বাংলাদেশের আন্দোলনের পক্ষ থেকে সমাবেশে বক্তব্য রাখার আহ্বান জানানাে হয়। এ ধরনের ঘােষণা আমাদের কাছে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাস্য ছিল। নির্ধারিত বক্তার অতিরিক্ত একটি বিদেশী মুক্তিকামী জাতির পক্ষে বক্তব্য রাখার সুযোেগ প্রদান একটি ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ ছিল।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিকামী নিরস্ত্র জনগণের প্রতি সমাবেশের একনিষ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল। বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সমিতির উপস্থিত নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের কর্মী সুরাইয়া খানমকে বক্তব্য রাখার জন্য মনােনীত করেন। সুরাইয়া খানম ইংরেজি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য বিলাতে অধ্যায়নরতা ছিলেন। তিনি পরবর্তীকালে কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও মহিলাদের উপর জঘন্য নির্যাতনের কথা উপস্থিত সমাবেশে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। সমাবেশের পক্ষ থেকে হাজারাে জনতা সেদিন ইংরেজি ভি” চিহ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশের বিজয় কামনা করেছিলেন। স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্ত মােতাবেক পূর্ব লন্ডনের ১১নং গােরিং স্ট্রীটে ষ্টিয়ারিং কমিটির অফিস ভাড়া করা হয়। উক্ত অফিসটি বাঙালী পাট ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ সাহেবের অফিস ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাট ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হারুন অর রশিদের পাঁচ কক্ষ বিশিষ্ট অফিস প্রয়ােজন ছিল না। অফিসের টেলিফোন ও আসবাবপত্র সহ অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় অফিসটি পেয়ে যাওয়ায় স্টিয়ারিং কমিটির একটি ঠিকানা অতি সহজেই মিলে যায়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ৩ মে ১১নং গােরিং স্ট্রীটে ষ্টিয়ারিং কমিটির কার্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর পর থেকে ডিসেম্বরে বিজয় অর্জন পর্যন্ত স্টিয়ারিং কমিটির উক্ত অফিস প্রবাসী বাঙালীদের যুদ্ধকালীন আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়। ৭ মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপপ্রচারের প্রতিবাদে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। ৮ মে ষ্টিয়ারিং কমিটির ১১ নং গােরিং স্ট্রীটের কার্যালয়ে ষ্টিয়ারিং কমিটির এক সভা বিচারপতি চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের জন্য ফাণ্ডের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা ও আলােচনা করা হয়। ফান্ড সংগ্রহ ও পরিচালনার ব্যাপারে স্বচ্ছতার গুরুত্ব সম্পর্কে সকলেই আলােকপাত করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ ফান্ড” নামে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ফাণ্ড, সম্পর্কে ছাব্বিশ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে।
বৃটেনে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য পূর্বঘােষিত কর্মসূচী মােতাবেক ৮ মে লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত নর্থ হাম্পটন শহরের ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পাকিস্তান ও বৃটেনের খেলার দিনে মাঠের বাইরে প্রায় দুই হাজার বাঙালী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীদের হাতে ‘পাকিস্তান নিপাত যাক’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’; মুক্তিযযাদ্ধারা এগিয়ে চল’ সহ বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড শােভা পায়। | ৯ মে সকাল ১০.০০ টায় ব্রাডফোর্ড সগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে একজনসভা আয়ােজন করা হয়। বৃটেনে বাঙালীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শাণিত করা এবং প্রচারের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যে জনসংযােগের অংশ হিসাবে ব্রাডফোর্ডে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত। সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। লন্ডন থেকে তার সাথে সফরসঙ্গি ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটির শেখ আবদুল মান্নান, লন্ডন সংগ্রাম কমিটির জাকারিয়া খান চৌধুরী এবং মেডিকেল এ্যাসােসিয়েশনের ডাঃ মােশাররফ হােসেন জোয়ার্দার। সভা আয়ােজনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে মুসাব্বির তরফদার, এ. কে. এম. এনায়েতউল্লা, আবদুস সােবাহান মাষ্টার, আবদুল কাদের, মাহমুদুল হক ও মীর্জী লুৎফর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখযােগ্য। বিচারপতি চৌধুরী সভায় বাংলাদেশের জনা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের স্বপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে। ব্রাডফার্ডের বাঙালীদের উৎসাহ দান ও সংগ্রামের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। ৯ মে বিকাল ৪ টায় বার্মিংহামে একটি স্থানীয় হলে বার্মিংহাম সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এক বিশাল জনসভার আয়ােজন করা হয়। বিচারপতি চৌধুরী ব্রাডফোর্ড থেকে সরাসরি ডাঃ মােশাররফ হােসেন জোয়ার্দারের গাড়ীতে শেখ আবদুল মান্নান ও জাকারিয়া খান চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে বার্মিংহাম সভা স্থলে পৌছেন। লন্ডনের পর অধিক বাঙালীদের বসবাস বার্মিংহামে। তাই বামিংহামের জনসভাটি ছিল জনাকীর্ণ । সভায় সভাপতিত্ব করেন বার্মিংহাম সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক জগলুল পাশা। সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাড়াও বক্তব্য রাখেন শেখ আবদুল মান্নান ও বার্মিংহামের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। বিচারপতি চৌধুরী বার্মিংহামের বাঙালীদের মনােবল দৃঢ় করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেউ রুখতে পারবে না।
মে মাসের কর্মতৎপরতার মধ্যে আরেকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা বৃটিশ পার্লামেন্ট ভবনের সামনে এবং চর্তুপাশে অবস্থান ধর্মঘট। বৃটিশ পার্লামেন্টে ৪ এপ্রিল নর্থ কেনসিংগটন থেকে নির্বাচিত শ্রমিক দলীয়-এম পি ব্রুস ডগলাস ম্যানের উপস্থাপিত প্রস্তাবের পূর্ণ আলােচনার জন্য ১৩ এবং ১৪ মে নির্ধারণ করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ সমূহ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের বৈদেশিক মুখপাত্র বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে পরামর্শক্রমে ১৩ এবং ১৪ মে বৃটিশ এম পিদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং বাংলাদেশকে সমর্থন দানের আবেদন জানানাের কর্মসূচী গ্রহণ করে। ১৩ মে সন্ধ্যার অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন হওয়ার সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে পার্লামেন্ট ভবনের চর্তুপার্শ্বে মােমবাতি (Candle Light) জ্বালিয়ে বেষ্টনী স্থাপন করে অবস্থান গ্রহণের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। ব্যতিক্রমধর্মী এই কর্মসূচীতে লণ্ডন ও আশেপাশের শহর থেকে বাঙালী ছাত্র, শ্রমিক, মহিলা ও চাকুরিজীবী সহ সকল স্তরের মানুষের সমাবেশ ঘটে। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই বড় আকারের মােমবাতি সঙ্গে নিয়ে আসেন। সংগ্রাম পরিষদ থেকেও মােমবাতি সরবরাহ করা হয়। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পার্লামেন্টের চর্তুপার্শ্বে টেমস নদীর পাড় ঘেষে প্রজ্বলিত মােমবাতির বেষ্টনী এক নয়নমধুর দৃশ্যের অবতারণা করে। পার্লামেন্টের মাননীয় এম পি, সাংবাদিক ও উৎসাহী দর্শক এই নতুন ধরনের শান্তিপূর্ণ দৃষ্টি আকর্ষণকারী কর্মসূচীকে প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং প্রস্তাবে সমর্থনকারী ১৬০ জন মাননীয় এম পি এর মধ্যে অনেকেই অবস্থানকারীদেরকে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের আশ্বাস প্রদান করেন। মােমবাতি বেষ্টনী। সৃষ্টি করে বৃটিশ এমপিদের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনের প্রােগ্রামে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও মহিলা সমিতির সদস্য ও সদস্যারা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৩ মে দুপুর থেকে ১৪ মে বিকেল পর্যন্ত ২৬ ঘণ্টা ‘হাউস অফ কমন্স’ এর সামনে দক্ষিণ ওয়েলস বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বৃটিশ এম, পি, দের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অনশন ধর্মঘট পালন করে। অনশনে অংশ গ্রহণ করেন আবদুল হানান, এম. জেড. মিয়া, মােহাম্মদ ফিরােজ, আবদুল হালিম ও আবদুস শহীদ প্রমুখ। কর্মীবৃন্দ। ১৬ মে কভেন্ট্রিতে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক সভার আয়ােজন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সামসুল হুদা চৌধুরী এবং বিগত কয়েকমাসের কাজের বিবরণী পাঠ করেন মতছিম আলী। কভেন্ট্রির বাঙালীদের যার যার অবস্থান থেকে। ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার কার্য পরিচালনার জন্য সভায় বক্তাগণ মতামত ব্যক্ত করেন।
১৪ মে বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলােচনা অব্যাহত থাকে। পূর্ব ঘােষিত প্রােগ্রাম মােতাবেক ১৪ মে পালামেন্টের সামনে সকাল ১১টা থেকে পুনরায় অবস্থান ধর্মঘট শুরু হয়। বিভিন্ন ব্যানার ও প্লেকার্ড নিয়ে শত শত বাঙালী কর্মী পার্লামেন্টের সামনে অবস্থান। গ্রহণ করে। ঐদিন বেলা ১টায় পার্লামেন্টে মধ্যাহ্ন ভােজের বিরতির পূর্বে ব্রুস ডগলাস ম্যানের উত্থাপিত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যে, এই হাউজ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ভবিষ্যতে খাদ্যের মারাত্মক ঘাটতির আশংকা করছে। এই হাউজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এই দুর্দশা লাঘব, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের জন্য বৃটিশ সরকারের প্রভাব ব্যবহারের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। প্রস্তাবের এক অংশে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে উল্লেখ করে বলা হয় যে, এ পর্যন্ত কোন কোন হিবে দশ লাখ (এক মিলিয়ন) এর মত বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড এবং তার ফলে যে ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে তাতে এক ও অভিন্ন দেশ হিসেবে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছে। প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর পার্লামেন্ট ভবন থেকে জন ষ্টোন হাউজ ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সমাবেশ স্থলে উপস্থিত হন এবং সমবেত জনগণ পার্লামেন্ট ফটকে এক স্বতঃস্ফূর্ত সভা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে সমবেত জনতা মিছিল করে সেখান থেকে হাউড পার্কে গমন করে। হাইড পার্কে আমার (লেখক) সভাপতিত্বে এক স্বতঃস্ফূর্ত সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং বৃটিশ এম পি জন ষ্টোনহাউজ বৃটিশ পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহিত হওয়াকে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিজয় বলে অভিহিত করেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে যােগ দেয়ার পর হাইডপার্কের এই স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় প্রথমবারের মতাে জনসম্মুখে বক্তব্য রাখেন। কূটনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও আইনজীবী মহলে বিচারপতি চৌধুরী বহু তৎপরতা চালিয়ে গেলেও কোন জনসভায় ইতােপূর্বে কোন বক্তব্য রাখেননি। ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ বিলাত প্রবাসীদের তৎপরতার কেন্দ্র বিন্দু ছিল বৃটিশ পার্লামেন্ট।
হাউজ অব কমন্স [House of Commons) বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিমূলক প্রস্তাব গ্রহণ করলে এবং পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত সাহায্য হ্রাস করলে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টি দেবে এই প্রত্যাশায় বিলাতের প্রবাসীরা ক্রস ডগলাসম্যানের উত্থাপিত প্রস্তাবের ইস্যুটিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে। পার্লামেন্ট ভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটসহ বিভিন্ন প্রােগ্রাম ছাড়াও বৃটিশ এম, পিদেরকে এলাকা ভিত্তিক যােগাযােগ স্থাপন ও ধর্না (Lobbing) দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা অবহিত করার উদ্দেশ্যে দুটি আবেদনপত্র বৃটিশ এম, পিদের কাছে বিতরণ করা হয়। প্রথম প্রচারপত্রটি “An appeal to the Members of the British House of Commons” শিরােনামে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রকাশ করে। উক্ত প্রচারপত্রে বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের সমর্থন ইতােমধ্যে যে সকল সম্মানিত বৃটিশ এম পি এগিয়ে এসেছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ‘গণতন্ত্রের মা’ নামে পরিচিত বৃটিশ পার্লামেন্টের সকল সম্মানিত সদস্যকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন দানের জন্য আবেদন জানানাে হয়। ৫ এপ্রিল পার্লামেন্টে প্রদত্ত বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের বক্তব্যকে খণ্ডন করে আবেদনপত্রে বলা হয় যে, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা এবং এতদসংক্রান্ত বৃটিশ জনগণের মনােভাব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। প্রচারপত্রে ৬ এপ্রিলে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত বৃটিশ জনগণের মনােভাবের কথা উল্লেখ করা হয়। দি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বৃটিশ জনগণের মনােভাবের পরিচয় হিসেবে প্রতিবেদনের অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলাে “The Foreign and Commonwealth office still seems to believe the fact that a foreign Government is diplomatically recognised is more important than blood on its hands. Sir Alec Douglas Home had the opportunity yesterday to declare Britain’s support for democracy in East Pakistan. He wasted it.” (The Guardian. 6th April, 1971) আবেদনপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষাপট ও যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে গণতন্ত্রের ধারক মাননীয় বৃটিশ এমপিদেরকে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষ সমর্থন করার আকুল আহ্বান জানানাে হয়। | এই উদ্দেশ্যে বৃটেনের বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদসমূহের পক্ষ থেকে “One more appeal to the conscience of the mother of Parliaments” নামে অপর একটি আবেদনপত্র প্রত্যেক মাননীয় বৃটিশ এম পিদের কাছে পৌছে দেয়া হয়। চার পৃষ্ঠাব্যাপী এই আবেদনপত্রটি একটি দলিল হিসেবে বিলি করা হয়।
এই আবেদনপত্রে। বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি, ২৫ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, রিলিফ ক্যাম্পগুলাের করুণ অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যয়ের কথা তুলে ধরা হয়। এই প্রচারপত্রে পাকিস্তানের হত্যাকারী সরকারকে বৃটেন কর্তৃক প্রদত্ত সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য বৃটিশ সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টির জন্য বৃটিশ এমপিদের কাছে বিশেষভাবে আবেদন জানানাে হয়। যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তান বৈদেশিক সাহায্য না পেলে বাংলাদেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করার জন্য পরিচালিত যুদ্ধের বাজেট হ্রাস পাবে এবং তার ফলে বাংলাদেশের মুক্তি ত্বরান্বিত হবে। বৃটেন ‘পাকিস্তান সাহায্য কনসরসিয়ামের’ শক্তিশালী সদস্য হিসেবে সাহায্য বন্ধের মাধ্যমে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের অবসান হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। উপরােক্ত কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকরী হওয়ার ফলে বৃটিশ হাউস অব কমনসে উত্থাপিত ক্রস ডগলাস ম্যানের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর তৃতীয় মাসে বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ প্রবাসীদের তৎপরতার ফলে সম্ভব হয়েছিল এবং তার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। | মে মাসের ১৩ থেকে ১৬ তারিখে পূর্ব ইউরােপের হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদ্যাপেষ্ট শহরে। চতুর্থ বিশ্ব শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মুজিবনগর অস্থায়ী সরকার উক্ত সম্মেলনে প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সম্মেলনে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিনিধি গ্রহণ ও প্রতিনিধি দলের যাবতীয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব লন্ডন আন্দোলনের ষ্টিয়ারিং কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে উক্ত সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব প্রদানের জন্যে সিলেট থেকে নির্বাচিত তৎকালীন এমএনএ ও বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি আবদুস সামাদকে মনােনীত করা হয় । প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্য ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির যুগ্ম সচিব দেওয়ান মাহবুব আলী এবং বিলাতের আন্দোলনের পক্ষে এটিএম ওয়ালী আশরাফ। চতুর্থ বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে ১২৪টি দেশের আট শতাধিক সদস্য যােগদান করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের সগ্রামরত জনগণের পক্ষে প্রতিনিধি দলের নেতা আবদুস সামাদ বক্তব্য রাখেন। উক্ত সম্মেলনে এক প্রস্তাবে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় এবং স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘােষণা করা হয়।
উল্লেখ্য যে, হাঙ্গেরীতে অনুষ্ঠিত এই শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মানজনক ‘ল্যাম্ৰাকিস’ (LAMBRAKIS) পদকে ভূমিত করা হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সরকার বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় বানােয়াট খবরা-খবর প্রচারের ব্যবস্থা করে। এই অপপ্রচারকে প্রতিহত করার জন্য এ মাসে বিলাতের বিভিন্ন সগ্রাম কমিটি প্রচারপত্র প্রকাশ। করে সঠিক পরিস্থিতি উপস্থাপনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এ মাসে তাদের নিয়মিত ফ্যাক্টশীটের ৯ নং সংস্করণ প্রকাশ করে। নর্থ ও নর্থ ওয়েষ্ট লন্ডন সংগ্রাম কমিটি ৩৩ নং ডাগমুর রােড, লন্ডন-নর্থ ২২ ঠিকানা থেকে বাংলাদেশ টু-ডে’ শিরােনামে ৫ মে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে এবং প্রভাবশালী মহলে বিতরণ করে। উক্ত প্রচারপত্রে ইয়াহিয়া খানের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের সমর্থনে সােচ্চার হওয়ার অন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানানাে হয় । ৬মে ১৫নং এলডন স্ট্রীটে, গ্লাসগো-সিত ঠিকানা থেকে স্কটল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ এসােসিয়েশন অপর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। এই বইপত্রে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বৃটিশ সাংবাদিকদের প্রতি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের আবেদন জানানাে হয়। ৮ মে ৬৮/এ, ষ্টোের হাই রােড, লন্ডন-এন ডব্লিউ ঠিকানা থেকে গ্রেট বৃটেনস্থ সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বটি সাংবাদিকদের প্রতি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের আবেদন জানানাে হয়। ৮ মে ৬৮ ষ্টেথাম হাই রােড, লন্ডন-এর ডব্লিউ ১৬ ঠিকানা থেকে গ্রেট বৃটেনস্থ বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ অপর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। উক্ত প্রচারপত্রটি একটি ছােট পুস্তিকাকারে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি মুখবন্ধসহ প্রকাশ করা হয়। এমনিভাবে এ মাসে বিলাতের বিভিন্ন সগ্রাম কমিটি বহু প্রচারপত্র প্রকাশ করে পাকিস্তানের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির কাজে তৎপরতা অব্যাহত রাখে।
বৃটেনের ২০৬ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, পার্লামেন্ট সদস্য ও প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের দস্তখত সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপন ১৩ মে ‘মি টাইম্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনে ‘পূর্ব বাংলায় সংঘটিত হতাযজ্ঞ ও ধ্বংসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য বৃটিশ সরকারকে আহ্বান জানানাে হয়। ১২ মে ল্যাংকাশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য একখানি আবেদনপত্র বিলি করেন। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লন্ডনের কনওয়ে হলে লিংক ফোরামের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় ভারতের প্রখ্যাতনেত্রী। মিসেস অরুণা আসফ আলী, বৃটিশ এম, পি, জন ষ্টোন হাউজ, ব্রুস ডগলাসম্যান, এ্যাকশন বাংলাদেশ এর পল কনেষ্ট, পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাংবাদিক ফরিদ জাফরী এবং বাংলাদেশের পক্ষে বি এইচ, তালুকদার ও সাখাওয়াত হােসেন (ব্যারিষ্টার) বক্তৃতা করেন। সভায়। সভাপতিত্ব করেন লর্ড ব্রকওয়ে। ২২ মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ব্লেচলি ও অক্সফোর্ড শহরে এবং ২৩ মে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগাে শহরে জনসভায় বক্তব্য রাখেন। উপরােক্ত সভায় বিচারপতি চৌধুরীর সফর সঙ্গী হিসাবে ষ্টিয়ারীং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নানও বক্তব্য রাখেন। আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে যে সকল সংগ্রাম পরিষদ কাজ করছিলেন তাদের সাথে সংযােগ এবং আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যােগাযােগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে বিচারপিত আবু সাঈদ চৌধুরী ২৪ মে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন। তিনি ২৯ মে লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন। ৩০ মে মানচেষ্টারে আবদুল মতিনের সভাপতিত্বে এক জনসভা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন। সভায় অন্যন্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আবদুল মান্নান ও কবীর চৌধুরী এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। ৩০ মে বৃটেনের বাঙালীদের মুখপত্র ‘জনমত’ পত্রিকায় যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আমার একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে যুক্তরালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত সকল বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলাদেশ সমিতি” গঠনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান হয়। মুক্তিযুদ্ধের “” প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালানাের মাধ্যমে আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং লন্ডনে স্থাপিত ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। গ্রহণ এবং লন্ডনে স্থাপিত যুক্তরাজ্যস্থ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন