You dont have javascript enabled! Please enable it!

এপ্রিল মাসের তৎপরতা

১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত লন্ডনে প্রতিবাদ প্রতিরােধের সকল কর্মতৎপরতার কেন্দ্র ছিল ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে অনুষ্ঠিত অনশন ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রচারণার জন্য তখনও তেমন কোন সংগঠন গড়ে ওঠেনি। ইতােপূর্বে যে তিনটি পেশাভিত্তিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল সেগুলাে হচ্ছে বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি, বেঙ্গল উইমেন্স এসােসিয়েশন ইন গ্রেট বৃটেন এবং ডক্টরস এসােসিয়েশন ইন ইউ. কে। ডক্টরস সমিতির কতিপয় নেতা খুবই সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও সংখ্যায় কম থাকায় তাদের পক্ষে স্বতন্ত্র কোন প্রােগ্রাম ঘােষণা সম্ভব না হলেও প্রতিটি প্রােগ্রামে তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যে দু’টি উল্লেখযােগ্য প্রােগ্রাম ঘােষণা করা হয় তার একটি বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি ও অপরটি বেঙ্গল উইমেনস এসােসিয়েশন ঘােষণা করে। ৩ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখ শনিবার বেঙ্গল মহিলা সমিতির আহ্বানে লন্ডনের ঐতিহাসিক ট্রাফেলগার স্কোয়ারে প্রবাসী বাঙালি মহিলাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন প্লেকার্ড, পােষ্টার ও ব্যানার সহকারে শত শত বাঙালি মহিলা ও শিশু ট্রাফেলগার স্কোয়ারের সমাবেশে যােগদান করে। এই সমাবেশকে সফল করার জন্য বেঙ্গল স্টুডেন্টস এ্যাকশনের সদস্যরা সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা করে। মহিলাদের এই সংগঠনটি লন্ডনে বসবাসকারী কয়েকজন উদ্যোগী ও দেশপ্রেমিক বাঙালি মহিলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। বাঙালি মহিলাদের মধ্যে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে জেবুন্নেছা বখত (সভানেত্রী), আনােয়ারা জাহান (সাধারণ সম্পাদিকা), জেবুন্নেছা খায়ের, মুন্নী। শাহজাহান, ফেরদৌস রহমান, নােরা শরীফ, সুরাইয়া ইসলাম, সেলিনা মােল্লা, রাজিয়া চৌধুরী, সুরাইয়া বেগম, লুলু বিলকিস বানু, রেবেকা আশরাফ, সাহেদা খাতুন, বিলকিস আক্তার হােসেন (লেখকের স্ত্রী) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। উল্লেখিত মহিলারা ইতােপূর্বে বাঙালী প্রবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কর্মতৎপরতা পরিচালনা করে সকলের কাছে পরিচিত ছিল।

এদের মধ্যে জেনুন্নেছা বখত সকলের শ্রদ্ধেয়া এবং বয়সের কারণে মাতৃতুল্যা ছিলেন। তিনি বিলাত গমনের পূর্বে ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষয়িত্রী থাকায় লন্ডন প্রবাসী অনেক মহিলা তার ছাত্রী ছিলেন। জেবুন্নেছা বখতের ব্যক্তিত্ব এবং আনােয়ারা জাহানের পরিশ্রম ও কর্মচাঞ্চল্যের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ৩ এপ্রিলের মহিলা সমাবেশ অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। মহিলাদের প্লেকার্ডে ও পােষ্টারে ইয়াহিয়া খানের, পতন হউক, পাকিস্তানের ধ্বংস হউক” শ্লোগান লেখা ছিল। বিভিন শ্লোগানে মুখর একটি শােভাযাত্রা সমাবেশ শেষে ট্রাফেলগার স্কোয়ার থেকে বের করা হয় । মিছিলটি প্রথমে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে একটি মেমােরেন্ডাম এবং পরে আমেরিকান দূতাবাসে একটি মেমােরেন্ডাম প্রদান করে হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্ণারে শেষ হয়। মিছিল সমাপ্তিতে মহিলা সমিতির নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্মক সহযােগিতা ও সাহায্য করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করে। জেবুন্নেছা বখত ও আনােয়ারা জাহানের নেতৃত্বে মহিলা সমিতি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি কর্মসূচীতে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রেখেছিল।  ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল, রােববারে বেঙ্গল স্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটি হাইড-পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে এক বিরাট সমাবেশের আয়ােজন করে। লন্ডনে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমত এবং লিফলেটের মাধ্যমে সমাবেশের কথা বাঙালিদের মধ্যে প্রচার করা হয়। তখন লন্ডনে। লিফলেট ছাপানাে খুব কষ্টকর ছিল। লন্ডনে তখন কোন বাংলা প্রেস না থাকায় হাতে লিখে তা ছাপানাে হতাে অথবা ফটোকপি করে বিলি করা হতাে। দেশে স্বাধীনতা ঘােষণার পর নির্ধারিত এই সমাবেশে লন্ডন ও তার পার্শ্ববতী শহরের বসবাসকারী সর্বস্তরের বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যােগদান করে। এই সমাবেশের আকার ও চরিত্র দেখে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বিপুল প্রেরণা ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞের খবর বিলাতের পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন প্রকাশ হওয়ায় প্রবাসী বাঙালিরা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ ছিল। তাই ৪ এপ্রিলের হাইডপার্কের সমাবেশ অত্যন্ত জংগী রূপ ধারণ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানের পতন’ “ইয়াহিয়া খানের ধ্বংস” “বাংলাদেশকে সমর্থন দাও” “মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে যাও” ইত্যাদি শ্লোগানে হাইডপার্ক মুখরিত করে তােলে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনের হাইডপার্কে স্থানীয় জনগণের বেশ ভিড় ছিল।

বাংলাদেশের সম্পর্কে জানার জন্য তাদের ভিড়ও  বৃদ্ধি পায় । হাইডপার্ক স্পীকার্স কর্ণারে মুক্ত বক্তব্য প্রদানের এক ঐতিহ্য রয়েছে। যে কোন মত ও বিশ্বাসের ব্যক্তি এবং সংস্থা এখানে নির্ভয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। আমাদের দেশের মতাে কোন বক্তৃতা মঞ্চ তৈরী করা হয় না। সিড়ি সম্বলিত উঁচু প্লাটফরম ভাড়া পাওয়া যায় যেখানে দাড়িয়ে বক্তা তার বক্তৃতা প্রদান করেন। এই ধরনের বক্তৃতা ষ্ট্যান্ড স্থাপন করে ছাত্র সংগ্রামের মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুর সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ছাত্র সংগ্রামের পক্ষ থেকে আমি ও ওয়ালী আশরাফ, মহিলা সমিতির পক্ষে জেবুন্নেছা বখত, ডাক্তার সমিতির পক্ষে ডাঃ তালুকদার ও লন্ডন আওয়ামী লীগের পক্ষে সুলতান মাহমুদ শরীফসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সভা শেষে এক বিরাট শশাভাযাত্রা হাইডপাক থেকে রওনা হয়ে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে গিয়ে শেষ হয়। ৪ এপ্রিলের এই সমাবেশ ও শশাভাযাত্রা থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগান আত্মপ্রকাশ করে তা RCT: “Not a penny not a gun to Tikka-Bhutto-Yahya Khan. পরবর্তীকালে এই শ্লোগান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিলাতের বাঙালীদের মধ্যে বেশ প্রচলিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল। ট্রাফেলগার স্কোয়ারে শােভাযাত্রা সমাপ্ত করে বাংলাদেশের আন্দোলনের পক্ষ থেকে ভারতীয় দূতাবাস ও সােভিয়েট দূতাবাসে প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয়। প্রতিনিধিরা ভারতীয় পার্লামেন্টে ৩১ মার্চে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করে প্রস্তাব গ্রহণ এবং বাংলাদেশকে সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পােদগর্নির সমর্থন দানের জন্য তাদের স্ব-স্ব রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে ভারত ও রাশিয়াকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। একই দিনে অর্থাৎ ৪ এপ্রিল রােববার সন্ধ্যা ৭ টায় হ্যামষ্টিড হলে স্থানীয় সাংবাদিকদের উদ্যোগে একটি “ব্রিফিং সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভাটি বিলাতে সাংবাদিকদের বাংলাদেশের প্রতি সংবেদনশীল করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উক্ত সভায় বৃটিশ সাংবাদিকবৃন্দ ছাড়াও শ্রমিকদলীয় বৃটিশ এম পি ও প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শাের এবং লর্ড ব্রুকওয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল লণ্ডনের প্রবাসী বাঙালি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বাঙালি নিধন অভিযানের প্রতিবাদে এবং স্বাধীনতার দাবিতে এক নজীরবিহীন কর্মসূচী পালন করে। লন্ডনের বাঙালি রেষ্টুরেন্ট মালিক সমিতির সিদ্ধান্তক্রমে বাঙালি মালিকনাধীন লন্ডনের সকল রেষ্টুরেন্ট ৪ এপ্রিল সারা দিন (সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত) বন্ধ রাখেন। রেষ্টুরেন্টগুলাে বন্ধ রাখার কারণসমূহ পােষ্টার আকারে বন্ধ রেষ্টুরেন্টের দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা এ্যাকশন কর্মসূচীর সাথে সাথে বিভিন্ন দূতাবাস, বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য এবং রাজনৈতিক দলের কাছে প্রতিনিধি প্রেরণ। করে বাংলাদেশকে সমর্থন করার আবেদন জানান।

এই সকল প্রতিনিধি দলে স্টুডেন্টস। এ্যাকশন কমিটি, মহিলা সমিতি, ডাক্তার সমিতির সদস্যসহ বাঙালি রাজনৈতিক দলের। নেতৃবৃন্দ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। প্রতিদিন কোন না কোনাে দেশের দূতাবাস অথবা বৃটিশ এমপি বা ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা চালান হয়। | ইতােপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সকল যােগাযােগ ও লবিং এর ফলে শ্রমিক। দলীয় বৃটিশ এমপি ও প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শাের শ্রমিক দলীয় এমপি ডগলাসম্যান এবং লর্ড ব্রকওয়ে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করে আন্দোলনকে সহযােগিতা শুরু করেছেন। উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে বৃটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কিত সর্বশেষ অবস্থার উপর। বক্তব্য রাখার জন্য বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের উপর চাপ সৃষ্টির সকল। প্রকার কূটনৈতিক পন্থা গ্রহণ করা হয়। শ্রমিক দলীয় এমপিদের সাথে লিবারেল-পার্টি এমপিরাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি চাপ সৃষ্টি করেন। গত সপ্তাহে “পাকিস্তানে’ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ। করার ব্যাপারে বৃটিশ পার্লামেন্টে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এই মর্মে লন্ডন থেকে । প্রকাশিত গার্ডিয়ান পত্রিকায় কিটলী এক কলামে বৃটিশ সরকারকে গড়িমসি করার অভিযােগ করেন (গার্ডিয়ান, ৩/৪/৭১)। তার ভাষায় চার মাস পূর্বে “পূর্ব পাকিস্তানে” ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের অব্যবহিত পরে সর্বপ্রথমে যেখানে বৃটিশ সাহায্য পৌছেছিল সেখানে বৃটিশ সরকার পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞের সময়ে নিশ্ৰুপ থাকা প্রশ্নাতীত নয় (গার্ডিয়ান, এপ্রিল, ১৯৭১)। চাপের মুখে স্যার আলেক ডগলাস হিউম “পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অবস্থা সংকটজনক” আখ্যায়িত করে বৃটিশ সরকারের উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে ৫ এপ্রিল, সােমবার পার্লামেন্টে একটি বক্তব্য পেশ করেন।  ইতােমধ্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি, বিরােধী লেবার পার্টি ও লিবারেল পার্টি মােট ১৬০ জন এমপি এর দস্তখতে বৃটিশ পার্লামেন্টে “পূর্ব পাকিস্তানে” রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি নােটিশ প্রদান করা হয়। এমতাবস্থায়, বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি নাটকীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

খুবই অল্প সময়ের নােটিশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে পার্লামেন্টে স্যার। আলেক ডগলাস হিউমের অফিসে ডেকে পাঠান। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সালমান আলী ৬ এপ্রিল বিকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন (গার্ডিয়ান, ৭ এপ্রিল ‘৭১)। এ অল্প সময়ের নােটিশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানাের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের জন্য বৃটিশ সরকারের উৎকণ্ঠার মনােভাব প্রকাশিত হয়। জানা যায়, বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারকে “পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান পরিহার করে রাজনৈতিক সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থায় বৃটিশ সরকার ও জনগণের মনােভাবের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৬০ জন এমপি এর উথাপিত প্রস্তাবে বাংলাদেশে রক্তপাত ছাড়াও ভবিষ্যতে খাদ্যাভাবকে প্রাধান্য দেয়া। হয়েছিল। সামরিক অভিযানের কারণে চাষাবাদের ক্ষয়ক্ষতি ও খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায়। বৃটিশ এমপিরা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশংকা করে বিশ্ববাসীর এ ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদক্ষেপ এবং ১৬০ জন সর্বদলীয় বৃটিশ এমপি এর পার্লামেন্টে প্রস্তাব উত্থাপন বিলাতে প্রবাসী বাঙালীদের কর্মতৎপরতা বিরাট উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। এপ্রিল-এর প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর একটি উল্লেখযােগ্য। কূটনৈতিক সাফল্য লাভ হয় ৪ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পােদগর্নির আহ্বান জানানাের মাধ্যমে। সােভিয়েট সংবাদ সংস্থা তাস পরিবেশিত খবরে প্রকাশ হয় যে, প্রেসিডেন্ট পােদগনি পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ এবং বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পােদগর্নির আহ্বানে আরাে বলা হয় যে, একটি রাজনৈতিক সমাধানে জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ব্যবহার করা নিন্দনীয় এবং এই জন্য সােভিয়েট জনগণ উদ্বিগ্ন। প্রেসিডেন্ট পােদগর্নির এই আহ্বানকে কূটনৈতিকভাবে একটি ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ হিসেবে বৃটিশ পত্র পত্রিকা মন্তব্য করে। ‘বায়াফ্রা’ সমস্যাকে রাশিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চিহ্নিত করে তার পক্ষ সমর্থন করেনি।

কিন্তু পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক সংকটের সময়ে সােভিয়েট প্রেসিডেন্টের এই প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বে একটা আলােড়নের সৃষ্টি করে। প্রেসিডেন্ট পােদগর্নি তার প্রেরিত বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে আরাে জানায় যে, সােভিয়েট সরকার এখনাে বিশ্বাস করে যে, পাকিস্তান’ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব এবং একথা বলা তার দায়িত্ব বলে তিনি মনে করেন। ৫ এপ্রিল লন্ডনের পত্র পত্রিকায় এই খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হলে প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল লণ্ডনস্থ সােভিয়েট দূতাবাসে গমন করে রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সােভিয়েট প্রেসিডেন্টকে উপরােক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।  বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ও সমর্থন দান করে ভারতীয় পার্লামেন্ট যে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে তা ১ এপ্রিল, ১৯৭১ সালের বৃটিশ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লন্ডনসহ বিলাতের প্রতিটি শহরে বাঙালীরা যখন বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন দানের জন্য পথে পথে শােভাযাত্রা করছে ও বিভিন্ন দূতাবাসের দ্বারে দ্বারে ধর্ণা (লবিং) দিচ্ছে। তখন ভারতের এই সমর্থন বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ঘােষণা যে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয় তার স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে ভারতের সমর্থন এক বিরাট ভূমিকা। রেখেছে। এপ্রিলের প্রথম দিকে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। একদিকে পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচারণা আর অন্য দিকে নিকট অতীতে ‘বায়াফ্রা’ সংগ্রামের ব্যর্থতা কূটনৈতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার যথার্থতা ও সফলতা সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান ছিল। এই ক্রান্তিলগ্নে ভারতীয় পার্লামেন্টে সর্বসম্মত সমর্থন ও পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য এক বিরাট কূটনৈতিক অবদান রেখেছে। লন্ডনে বাঙালীদের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের দূতাবাসে গমন করে এই সমর্থন ও সহানুভূতির জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও জনগণের প্রতি প্রবাসী বাঙালীদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রবাসী বাঙালীদের পরিষদ সমূহের লবিং, জনমত সৃষ্টি ও যােগাযোেগ প্রােগ্রামের আর একটি সাফল্য অর্জিত হয় বাংলাদেশের প্রতি বৃটিশ লিবারেল পাটির সমর্থন দানের মাধ্যমে। বৃটিশ লিবারেল পাটি তাদের দলীয় কাউন্সিলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে এবং রক্তপাত বন্ধ করার জন্য কমনওয়েলথের একজন প্রবীণ সদস্য হিসেবে বৃটেনকে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়। লিবারেল পার্টির গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে ঘােষণা করা হয়েছে এবং তাকে দমন করার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্বিচারে বেসামরিক জনগণকে হত্যা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের এই হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে চিহ্নিত করে বৃটেন বসে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে এবং রক্তপাত বন্ধ করার জন্য বৃটিশ সরকারের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ কামনা করে ১৬০ জন বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের দস্তখত সম্বলিত প্রস্তাব উপস্থাপনের ব্যাপারে লন্ডনের নর্থ কেনসিংটন থেকে নির্বাচিত শ্রমিক দলীয় এমপি ব্রুস ডগলাস ম্যান বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিছক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বিবেচনায় বায়াফ্রা সমস্যার সময়ে নাইজেরিয়ার ফেডারেল সরকারের প্রতি যেভাবে বৃটিশ সরকার সমর্থন দিয়েছিলেন সেই দৃষ্টিভঙ্গির সমার্থক মনে করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম বাংলাদেশের ব্যাপারে একটু শীতল ছিলেন। ক্রস ডগলাস ম্যান “পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রতি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান এবং তা কার্যকর করার জন্য কমনওয়েলথ কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টে দাবি উত্থাপন করেন। ব্রুস ডগলাস ম্যানের এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখের মধ্যে যে সকল মাননীয় এম, পি, দস্তখত করেন তাঁরা হলেন ফ্রড লি (প্রাক্তন কলনিয়েল সেক্রেটারী). মিসেস জুডিথ হাট (প্রাক্তন ওভারসিজ উন্নয়ন মন্ত্রী), ফ্রাঙ্ক জাড (পার্লামেন্টারী প্রাইভেট সেক্রেটারী টু লীডার অব অপজিশন), নাইজেল ফিসার (প্রাক্তন কমনওয়েলথ আন্ডার সেক্রেটারী), জন পারডাে (নর্থ করণওয়াল। থেকে লিবারেল পার্টির এম, পি,) এরিক হেফার (ওয়ালটন থেকে লেবার পার্টি এম, পি.)।

নিকোলাস স্কট (দক্ষিণ প্যাডিংন্টন থেকে নির্বাচিত কনজারভেটিভ দলীয় এম, পি,) হিউজ ফ্রেজার (ষ্টাফোর্ড এড ষ্টোন থেকে কনজারভেটিভ দলীয় এম. পি.) উইলিয়াম বেনিয়ন (বাকিংহাম থেকে কনজারভেটিভ দলীয় এমপি) এবং ক্রিসটার ব্রুকলব্যাংক ফাইলার (কিংগস লীন থেকে কনজারভেটিভ এম. পি.)। ৪ এপ্রিল-এর মধ্যে উপরােক্ত ১১ জন বিশিষ্ট বৃটিশ এম, পি, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে এগিয়ে এসেছিলেন তা প্রবাসী বাঙালীদের জন্য এক আশাতীত সাফল্য ছিল। জনমত সৃষ্টির অব্যাহত প্রয়াস এবং নেপথ্যে থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কূটনৈতিক যােগাযোেগ এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে। ১১ জন মাননীয় এম, পি, এর এই উদ্যোগের ফলেই পরবর্তিকালে এই প্রস্তাবে দস্তখতকারী এম. পি.-এর সংখ্যা ১৬০ জনে উন্নীত হয়েছিল। সর্বদলীয় ১৬০ জন এম. পি. কে বাংলাদেশের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা বা একাত্মতা প্রকাশ করায় বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাধ্য হয়েই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানকে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। বৃটেনে তখন কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় ছিলেন। বৃটিশ কমনওয়েলথ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। কিন্তু বৃটিশ জনমত এবং ১৬০ জন। সর্বদলীয় মাননীয় এম. পি. দের বাংলাদেশের ইস্যুকে সমর্থনের ফলেই রক্ষণশীল হয়েও কনজারভেটিভ সরকার ও তার প্রধান মিঃ হিথ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে যখন পাকিস্তানের কারাগারে গােপনে বিচার করে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছিল তখন তার নিরাপত্তার জন্য বৃটিশ সরকার বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য বৃটিশ পার্লামেন্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, ইয়াহিয়া খানকে বুঝানাের জন্য পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল। এবং সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ত্বরিৎ গতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বৃটিশ পার্লামেন্ট এবং বৃটিশ সরকারের বাংলাদেশের প্রতি দুর্বলতার (কূটনৈতিক) জন পাকিস্তান সরকার বিক্ষুব্ধ ছিল যার পরিণামে পাকিস্তান কমনওয়েলথ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। প্রসংগত উল্লেখযােগ্য যে, পাকিস্তান পুনরায় কমনওয়েলথে যােগদান করেছে। এপ্রিল মাসটিতে বৃটেনের বাঙালীদের আন্দোলন ও লবিং এর সকল কেন্দ্রবিন্দু ছিল বৃটিশ পার্লামেন্ট। ৫ এপ্রিল স্যার আলেক ডগলাস হিউম বৃটিশ পার্লামেন্টে একটি দায়সারা বিবৃতি প্রদান করেন। এর পর খৃষ্টানদের ধর্মীয় দুটি ইষ্টারের জন্য পার্লামেন্ট কিছু দিনের জন্য স্থগিত হয়। ইষ্টারের বন্ধের পর ১৯ এপ্রিল পুনরায় পার্লামেন্ট বসার দিনে বাংলাদেশ মহিলা সংগ্রাম কমিটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহযােগিতায় পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়ােজন করে। পার্লামেন্টের সামনে শত শত মহিলা ও ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে বৃটিশ পার্লামেন্টকে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি সম্বলিত প্লেকার্ড ও ব্যানার বহন করে।

৪ এপ্রিল, রবিবার বিকাল ৩.০০ টায় “কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন ইউ, কে” এর উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ারে এক বিরাট জনসভার। আয়ােজন করা হয়। বাঙালীদের সকল রেষ্টুরেন্ট বন্ধ করে লন্ডনে বসবাসকারী বিপুল পরিমাণ বাঙালী উক্ত জনসভায় যােগদান করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাইড পার্ক স্পীকার্স কর্ণারে। দুপুরের সমাবেশের শেষে মিছিল সহকারে ট্রাফেলগীর স্কোয়ারের জনসভায় যােগ দেয়। প্রায়। দশ সহস্র জনতার উপস্থিতিতে ট্রাফেলগার স্কোয়ার পূর্ণ হয়ে যায়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন ‘কাউন্সিল’ এর সভাপতি গউস খান এবং সভা পরিচালনা করেন বি. এইচ, তালুকদার। সভায় বক্তব্য রাখেন কাউন্সিল’ এর সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল মান্নান, ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেন, সুলতান মােহাম্মদ শরিফ, মাঞ্চেষ্টারের আবদুল মতিন এবং ছাত্র সংগ্রামের এ, জেড. মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। একই দিনে (৪ এপ্রিল) সন্ধ্যা বেলায় পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা গণহত্যার প্রতিবাদে লন্ডনের ‘হ্যাম্পস্টেড টাইন হলে এক সুধী সমাবেশ আয়ােজন করা হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন শ্রমিক দলীয় । (Labour Party) প্রভাবশালী নেতা জন এনালস। সভায় যারা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম লর্ড ক্লকওয়ে, শ্রমিকদলীয় এম. পি. পিটার শাের, মাইকেল বার্নস্, পাকিস্তানী। ছাত্রনেতা তারেক আলী, নিউজ লেটার’ এর সম্পাদক ফরিদ জাফরী (পাকিস্তানী নাগরিক), বাঙালীদের মধ্য থেকে শেখ আবদুল মান্নান, লুলু বিলকিস বানু, সুলতান মাহমুদ শরীফ প্রমুখ। সভায় বক্তাগণ পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের গণহত্যা ও নিরস্ত্র বাঙালীদের আক্রমণের বিষয়ে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। পিটার শাের এবং মাইকেল বার্নস্ পূর্ববাংলার সংগ্রামকে সমর্থন করে পাকিস্তান কর্তৃক গণহত্যা বন্ধ করার জন্য বৃটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

পাকিস্তানের নাগরিক তারেক আলী ও ফরিদ জাফরী পূর্ব বাংলার ন্যায্য সংগ্রামকে সমর্থন করেন। ৪ এপ্রিল লন্ডনের বাইরে অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ ও সমাবেশ। অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাডফোর্ড শহরে ব্রাডফোর্ড টেক্সটাইল হলে বাঙালীদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন আফরুজ বখত এবং বক্তব্য রাখেন মনােয়ার হােসেন, জহির উদ্দিন, আবুল বাশার, করম আলী আহম্মদ, আবদুল মালিক, মাহমুদুল হক, মকসুদ আলী এবং মিসেস সৈয়দা তাহেরা । ১০ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাসহিউম এর সাথে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তান সরকারের পরিচালিত গণহত্যা, সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মি, সাদারল্যান্ড এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব মি. ব্যারিংটন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলােচনার সময় তারা দু’জন উপস্থিত ছিলেন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি চৌধুরীকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন এবং যথাসাধ্য সহযােগিতার আশ্বাস দেন। বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বের হয়ে সরাসরি বুশ হাউজে বি. বি. সি. এর বাংলা বিভাগে গমন করেন এবং বাংলা অনুষ্ঠানের জন্য সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। বিচারপতি চৌধুরী তার সাক্ষাৎকারে আবেগ জড়িত কণ্ঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র হত্যার তীব্র নিন্দা করেন। তিনি দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত দেশে না ফিরে বিশ্বে পাকিস্তানী সামরিক সরকারের বর্বরতার কথা জানাবেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য আত্মনিয়ােগ করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘােষণা করেন। তিনি একই দিনে দি ডেইলি গ্রেলিগ্রাফ’ এর রিপাের্টার পিটার গিল এর সাথে একটি সাক্ষাক্তার দেন। এর দু’টি সাক্ষাৎকার প্রদানের মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরী সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ণ সময়ে বিলাতে বাঙালীদের নেতৃত্ব দেন ও বিলাতসহ ইউরােপআমেরিকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা পরিচালনা করেন।

লন্ডনে বসবাসকারী বাঙালীরা বিভিন্ন কমিটি ও সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার সমন্বয় সাধনে বেশ সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় মুজিবনগর সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপন প্রয়ােজন হয়ে পরে। তাই লন্ডন মুভমেন্টের পক্ষ থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রথম আহ্বায়ক মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও লন্ডন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ শরিফ মুজিবনগর সরকারের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে কলকাতা গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। লন্ডন আওয়ামী লীগ সভাপতি মিনহাজ উদ্দিন আহমদ উপরােক্ত বিষয়ে সহযােগিতা করেন। বিলাতে প্রবাসীদের শুভেচ্ছা ও সমর্থনের টোকেন হিসেবে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও সুলতান মাহমুদ শরিফ ১২ এপ্রিল কলকাতার উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন। বিলাতের আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে মুজিবনগরের সরকারের সাথে তাদের যােগাযােগ পরবর্তিকালে মুজিবনগরের সাথে বিলাতের কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনে সুফল এনে দিয়েছিল।  ১৬ এপ্রিল লন্ডনের হলওয়ে এলাকায় ব্যারিষ্টার রুহুল আমীনের বাসভবনে “কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপারলিক অফ বাংলাদেশ ইন ইউ. কে” এর কার্যনির্বাহী কমিটির সভা  অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের সভাপতি গউস খান। বিচারপতি চৌধুরী। সহ কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল মান্নান, সদস্য ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেন, জাকারিয়া খান চৌধুরী, আমীর আলী, সামসুল মাের্শেদ, শামসুল হুদা হারুন, আবদুল হামিদ প্রমুখ নেতৃবর্গ সভায় উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সভায় বিচারপতি চৌধুরীকে এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে বাঙালীদের নেতৃত্ব প্রদানের জন্য সর্বসম্মত অনুরােধ জানানাে হয়। গউস খান এই কমিটির সভাপতির পদত্যাগ করার ঘােষণা করেন। বিচারপতি চৌধুরী সকলকে আশ্বস্ত করে বলেন, একটি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব না নিয়ে তিনি আরাে বৃহত্তর পরিসরে কাজ করতে চান এবং এই মর্মে তার বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা বলে কমিটির সদস্যদের সাথে একাগ্রচিত্তে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। | ১৮ এপ্রিল, রােববার বিকালে বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি” এর উদ্যোগে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তাগণ নব গঠিত মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থনের ঘােষণা করেন।

সভায় পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বৃটেন সফর বাতিল করার জন্য বৃটিশ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান হয়। সভাশেষে এক বিরাট মিছিল ১০নং ডাইনিং স্ট্রীটে প্রধানমন্ত্রী বাসভবনের সামনে সমবেত হয় এবং নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানানাের দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে পেশ করা হয়। | একই দিনে (১৮ এপ্রিল) বৃটিশ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী শ্রমিক দলীয় এম, পি, ব্রুস ডগলাস ম্যানের নেতৃত্বে “জাষ্টিস্ ফর ইষ্ট পাকিস্তান” নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশের সমর্থক বৃটিশ এম, পি, ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই কমিটির পক্ষ থেকে পরের দিন (১৯ এপ্রিল) ব্রুস ডগলাস-ম্যান এম, পি, বাংলাদেশ থেকে আগত। শরণার্থীদের অবস্থা এবং পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি দেখার জন্য কলকাতা গমন করেন। | ১৮ এপ্রিল যুক্তরাজ্যস্থ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যকরী কমিটির সভা আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন এ-টি, এম ওয়ালী আশরাফ, এ, কে, নজরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান সাহজাহান, সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, শফিউদ্দিন মাহমুদ বুলবুল প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। সভায় নিম্নলিখিত বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ঃ (ক) পাকিস্তান ক্রিকেট দলের আসন্ন বৃটেন সফরের প্রতিবাদ; (খ) ২৪ এপ্রিল বিকাল ৪.০০ টায় পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের হিথরাে বিমান বন্দরে অবতরনের সময়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন; (গ) ক্রিকেট টীমের সফরের বিরুদ্ধে কর্মসূচী গ্রহণে ইয়ং লিবারেল পার্টির পিটার হেইনসহ অন্যান্য সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগে স্থাপন; (ঘ) ক্রিকেট খেলার জন্য নির্ধারিত মাঠের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচী গ্রহণ এবং (ঙ) মহান মে দিবসে মিছিল সহকারে ট্রাফেলগার স্কোয়ারে শ্রমিক সমাবেশে যােগ দান। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের জনগণের রক্তে যখন প্রতিনিয়ত দেশের মাটি রঞ্জিত হচ্ছে, পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর বর্বরতার জন্য সারা বিশ্ব যখন প্রতিবাদ মুখর তখন হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা হিসেবে পাকিস্তান তাদের ক্রিকেট টীমকে বৃটেনে শুভেচ্ছা সফরে প্রেরণ করে। বিলাতের বাঙালীরা এই শুভেচ্ছা সফরকে নিছক ক্রিকেট খেলা হিসেবে মেনে নিতে। পারেনি। বিলাতে ইতােমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদ সমূহ এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ইয়াহিয়ার রক্তরঞ্জিত হাতকে শুভেচ্ছার হাতে পরিণত করার এই ক্রিকেট খেলার কূটনৈতিক পদক্ষেপকে প্রতিহত করতে হবে। ইতােপূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরােধিতা ও নিন্দা জ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রেরিত ক্রিকেট টীমকে বিলাতে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

বাংলাদেশে গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান ক্রিকেটকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রতিবাদে বিলাতে বিভিন্ন কার্যক্রম। গ্রহণ করা হয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেঙ্গল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ এপ্রিল ৭১ তারিখে ২৬৪ নং দি ট্রান্ড, লন্ডন ডব্লিউ, সি-২ এর অবস্থিত ‘চার্লস ডিকেনসে’ এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়ােজন করে। সাংবাদিক সম্মেলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক জনমতের তৎকালীন সম্পাদক এ টি এম ওয়ালী আশরাফ লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের এই ক্রিকেট টীমের সফরকে রাজনৈতিক চাল হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের এই হীন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার প্রত্যয় ঘােষণা করা হয়। সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিলাতের সকল সংগ্রাম পরিষদ সমূহকে এই ক্রিকেট সফর প্রতিহত করার আহ্বান জানানাে হয়। | ২১ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিল পরপর তিনরাত “কাউন্সিল ফর দি পিপল্স রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন ইউকে” এর কার্যকরী কমিটীর সভা পূর্ব লন্ডনের আটিলারী প্যাসেজের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিল’ এর সভাপতি গউস খান। সভায় কাউন্সিল’ এর সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল মান্নান সহ প্রায় সকল সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। এই গুরুত্ব পূর্ণ তিন রাতের সভায় প্রধান আলােচ্য বিষয় ছিল ইতােমধ্যে আহুত কভেন্ট্রি সম্মেলনে করণীয় কৌশল ও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। বিভিন্ন শহরে প্রতিষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদগুলাের মধ্যে সমন্বয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কেন্দ্রীয় ভাবে বিলাতে আরাে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের লক্ষ্যে কভেন্ট্রি সম্মেলনে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ব্যাপারে। সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের সকল প্রতিবন্ধকতা ও সংশয় মুক্ত করার লক্ষ্যে কাউন্সিল’ এর সভাপতিসহ সকল সদস্য পদত্যাগ করার ঘােষণা প্রদান করেন।  ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রি সম্মেলনে ‘স্টিয়ারিং কমিটি গঠন যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্দোলন, আন্তর্জাতিক প্রচার, কূটনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা এবং বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই গুরুত্ব উপলব্ধি থেকেই কভেন্ট্রি সম্মেলন সম্পর্কে একটি আলাদা অধ্যায়ে (অধ্যায়-পাপ আলােচনা করা হয়েছে।

২৫ এপ্রিল বৃটেনে বামপন্থীদের সংগঠন “স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ” এর উদ্যোগে লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে’ প্রবাসী বামপন্থীদের একটি সম্মিলিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ এবং বক্তব্য রাখেন লুৎফর রহমান সাহজাহান, নিখিলেশ চক্রবর্তি, এরশাদ আলী, গৌরাঙ্গ সাহা, সামসুল আলম, মুস্তাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, হাবিবুর রহমান ও আবদুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বক্তাগণ দেশের মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের উপর গুরুত্ব দিয়ে ভিয়েত্রম সংগ্রামের’ আদলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মতামত ব্যক্ত করেন। কোন কোন বক্তা বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করলে বিপ্লবের ব্যাখ্যা নিয়ে সভায় মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। | ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রীটে “কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ ইন, ইউ, কে,” বিলুপ্ত হওয়ায় লন্ডন ভিত্তিক একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শামসুর রহমান। সভায় অন্যান্যদের। মধ্যে বক্তব্য রাখেন মিনহাজউদ্দিন, শেখ আবদুল মান্নান, জিল্লুর রহমান, আমীর আলী এবং ডাঃ নুরুল হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় লন্ডন ভিত্তিক সংগ্রামের কর্মকাণ্ডকে জোরদার করার জন্য লন্ডন এ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

উক্ত কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারী হিসাবে সভায় অনুপস্থিত গউস খান ও ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সভায় আর এক প্রস্তাবে ‘জয়বাংলা’ নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। আমীর আলীর সম্পাদনায় ‘জয়বাংলা’ এর ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কিন্তু ব্যারিষ্টার শাখাওয়াত হােসেনের সেক্রেটারী পদত্যাগ ও আমীর আলীর কমিটির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ সহ কমিটির সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং অসহযােগিতার কারণে লন্ডন এ্যাকশন। কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ও ‘জয়বাংলা’ এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।  ২৭ এপ্রিল লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালী শিক্ষা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানকে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাথে সক্রিয় থাকার অভিযােগে বিনা নােটিশে বরখাস্ত করা হয়। হাবিবুর রহমান পরবর্তি কালে বাংলাদেশ দূতাবাসে’ যােগদান করে আন্দোলনে সার্বক্ষণিক কাজ করেন। ২৮ এপ্রিল লন্ডনের মে-ফেয়ার এলাকায় অবস্থিত ইংলিশ স্পিকিং এসােসিয়েশনে আয়ােজিত পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সম্বর্ধনা সভায় বাধা দিতে হাজার হাজার বাঙালী সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে ২৬ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে। বৃটেনে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের সফরের বিরুদ্ধে গৃহিত বিভিন্ন কর্মসূচী সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে গ্রন্থের তেত্রিশ অধ্যায়ে।

 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!