You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রবাসীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিলাত-প্রবাসী বাংলাদেশীরা আন্তর্জাতিক প্রচারের ক্ষেত্রে ও দেশে মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহদানের কাজে এক প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত বিলাত-প্রবাসী বাংলাদেশীরা দলমত নির্বিশেষে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য ও সহযােগিতা করার এই চেতনা প্রবাসীদের মধ্যে একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দেশের জনগণের মতােই প্রবাসী বাংলাদেশীরা তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক ও শােষকের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার দীর্ঘ সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। মূলত দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের মধ্যে সমভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। বিলাত-প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে উন্মেষ ঘটেছিল তার কারণ সমূহ পর্যালােচনা করতে হলে প্রথমেই বিলাতে প্রবাসীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আলােচনা করা প্রয়ােজন। বিলাতে তকালে যে সকল প্রবাসী বাংলাদেশী বসবাস করতেন তাদেরকে মােটামুটি চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা : ছাত্র, শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও চাকুরীজীবী সম্প্রদায় । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিলাতের আন্দোলনে ও প্রচার কার্যে যে সকল মহিলা নেত্রী ও কর্মী অবদান রেখেছিলেন তারা বেশির ভাগই ছিলেন গৃহিনী এবং মুষ্টিমেয় সংখ্যায় ছাত্রী ও চাকুরীজীবী। মুক্তিযুদ্ধকালে বিলাতে বসবাসকারী ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ষাটের দশকে তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রাপ্ত ছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের পড়াশােনা সমাপ্ত করে বিভিন্ন পেশায় যােগদান করে বৃত্তি লাভ করে বিলাতে ছাত্র হিসেবে গিয়েছিলেন অথবা স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পর সরাসরি উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য বিলাতে গমন করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন এমন কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রনেতৃবৃন্দ তখন বিলাতে অধ্যয়নরত ছিলেন। বিশেষ করে ষাটের দশকের শেষের দিকে যারা বিলাত গিয়েছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষের রাজনৈতিক ভাবধারার অধিকারী। ফলে বিলাত প্রবাসী ছাত্রদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রকট ছিল। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিলাত প্রবাসী সকল স্তরের নাগরিকদের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের আকাংক্ষা প্রবল ও সােচ্চার ছিল।

বিলাতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীই ছিল সর্বাধিক সংখ্যক । বিলাতে যখন শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছিল, তখন বিদেশী শ্রমিকদের বিলাতে প্রবেশে উৎসাহিত করা হয়েছিল। তখন থেকেই বাঙ্গালীরা বিলাতে বসবাস শুরু করে। এদের মধ্যে শিল্প কলকারখানা ও বিভিন্ন কঠিন কাজেই বেশির ভাগ লােকদের নিয়ােগ করা হতাে। শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক চর্চা করার সময় ও সুযােগ না থাকা সত্ত্বেও তকালিন পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্য, উনসত্তরের গণ আন্দোলন, আগরতলা মামলা, রাজনৈতিক অবস্থা, ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের সময়ে পাকিস্তানী শাসকদের বিমাতাসুলভ ব্যবহার এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের উপেক্ষা করে জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করার বিষয়সমূহ বাংলাদেশী শ্রমিকদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের উপর শােষণ, নির্যাতন ও অবহেলা এতই প্রকট ছিল যে, বিলাত প্রবাসী বাঙ্গালী শ্রমিকরা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ ছিল এবং স্বাধিকারের প্রশ্নে দেশের শ্রমিকদের সাথে একাত্ম ছিল।  বিলাতে প্রবাসী বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রভাবশালী শ্রেণী হিসাবে ব্যবসায়ী গােষ্ঠী বসবাস করতাে। যারা এক সময় চাকুরী বা অন্য পেশায় ছিলেন তাদের মধ্যে পরিশ্রমী, উৎসাহী, কর্মঠ ও অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা ব্যবসা ও বাণিজে মনােনিবেশ করেন। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশির ভাগই রেষ্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করতেন। সামান্য কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী গ্রোসারী ও ছােটখাট গার্মেন্টসের মালিক ছিলেন। ছাত্রদের পরই ছােট ছােট ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে বিলাতে প্রবাসী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। ছাত্রদের পরই এই ব্যবসায়ী গােষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় গ্রুপ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব কাল থেকেই বিলাতে আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়া কিছু কিছু শিক্ষিত চাকুরীজীবী ব্যক্তিত্বও রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র জীবনের ইতি করে চাকুরী গ্রহণ করেছিলেন। তাই তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও দেশের প্রতি দায়িত্ববােধ তাদেরকে স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবীর আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিলাতে বসবাসকারী ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হলেও বিলাতে বসবাসকারী ছাত্ররা স্বাভাবিক কারণেই রাজনৈতিকভাবে বেশি সচেতন ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার জন্য বিলাতে ষাট দশকেই ছাত্ররা সােচ্চার ছিলেন। তৎকালে ছাত্র, ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতিক “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ”। “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” শুধু একটি বাড়ি ছিলনা—এই স্বতন্ত্র ‘হাউজ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে চেতনার সৃষ্টি করেছিল তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে বিলাতের আন্দোলনে প্রবাসী ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ সম্ভব হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান হাউজ প্রতিষ্ঠায় যারা ভূমিকা রেখেছিলেন তারা সকলেই স্বাধীন বাংলাদেশে স্ব স্ব ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেছে। পাকিস্তান হাউজে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ভিত্তিক যুক্তরাজ্যস্থ পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনে বাঙ্গালী ছাত্ররা নেতৃত্ব গ্রহণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাংখা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করে। ষাটের দশকে বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী। ছাত্র পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায় সঙ্গত দাবির পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। সে কারণে বাঙ্গালী ছাত্ররা আলাদাভাবে পাকিস্তান যুব সমিতির প্রতিষ্ঠা করে এবং সকল বাঙ্গালী ছাত্র নেতৃবৃন্দ এই ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী মহিলাদের মধ্যে বেশির ভাগ হাউজ ওয়াইফ (গৃহিনী) থাকায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তেমন উল্লেখযােগ্য কোন মহিলা সংগঠন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু তাদের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবল। ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মহিলারা সংগঠিত হয়। মহিলাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে যারা বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে জেবুন্নেছা বস্তৃত, আনােয়ারা জাহান, লুলু বিলকিস বানু, মুন্নী সাহজাহান, জেবুন্নেছা খায়ের, ফেরদৌস রহমান, ডাঃ হালিমা আলম, সুরাইয়া বেগম, রাজিয়া চৌধুরী, রাবেয়া ভূইয়া, সুফিয়া রহমান, মনােয়ারা বেগম ও বার্মিংহামের বদরুন্নেছা পাশা এর নাম উল্লেখযােগ্য। তৎকালে বিলাতে প্রবাসী চিকিৎসকরা শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বেশ সংগঠিত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই বিলাতে বসবাসকারী চিকিৎসকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রাখার জন্য লন্ডন ভিত্তিক ও বিভিন্ন শহরে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসােসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করে। চিকিৎসকদের সংগঠিত করার ব্যাপারে যারা অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ডাঃ মােশাররফ হােসেন জোয়ার্দার, ডাঃ এ. টি. এম. জাফরুল্লা চৌধুরী, ডাঃ আবদুল হাকিম, ডাঃ সামসুল আলম, ডাঃ মঞ্জুর মাের্শেদ তালুকদার, ডাঃ কাজী ও ডাঃ আহম্মদ এর নাম উল্লেখযােগ্য ষাটের দশকে যেমনিভাবে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি সােচ্চার ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লাভ করছিলেন ঠিক তেমনিভাবে বিলাতে প্রবাসীরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে একই লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। এই কারণে ষাটের দশকে বিলাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক দল সংগঠিত হতে দেখা যায়। যে সকল রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে আত্মপ্রকাশ করে তার মধ্যে আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকালে মরহুম গউস খান, মিনহাজ উদ্দিন, তৈয়বুর রহমান, মরহুম বি, এইচ, তালুকদার, সুলতান মাহমুদ শরীফ, হাজী আবদুল মতিন, সামসুর রহমান, মতিউর রহমান, মিম্বর আলী, আতাউর রহমান, সৈয়দ আবুল আহসান, আহম্মদ হােসেন জোয়ার্দার, ইসহাক প্রমূখ সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী বিলাতে আওয়ামী লীগ গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং আওয়ামী লীগ সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আইয়ুব বিরােধী আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি বিলাত প্রবাসী বাঙালীরা বেশ আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগে যােগদান করে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তাবায়নের মাধ্যমে বিদেশে আইয়ুব বিরােধী জনমত সৃষ্টি করতে ভূমিকা রেখেছিলেন।

আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনে বিলাত প্রবাসীদের কাছে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম সংগ্রামের অগ্নিমশাল হিসেবে চিহ্নিত ছিল। মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও সেই কারণে বিলাত প্রবাসীদের আকৃষ্ট করেছিল এবং বিলাতের বিভিন্ন শহরে বিস্তার লাভ করেছিল। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ বিলাতে সংগঠিত করার ব্যাপারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন কর্মীরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। সমাজকর্মী শেখ আবদুল মান্নান, আবদুস সবুর, ডাঃ তালুকদার, সাইদুর রহমান (বর্তমান বার এট ল), শ্যামাপ্রসাদ ঘােষ (ডাকসুর প্রাক্তন ভি. পি.), নিখিলেশ। চক্রবর্তী, এম, এহিয়া (বার এট ল) প্রমুখ ন্যাপ সংগঠনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন। ষাটের দশকে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিলাত ভ্রমণে যান এবং বাঙ্গালী অধ্যুষিত শহরগুলােতে বিভিন্ন সভায় বক্তব্য রাখেন। মওলানা ভাসানীর বিলাত ভ্রমণের ফলে বিলাতে ন্যাপের সাংগঠনিক তৎপরতা বিস্তৃতি লাভ করে। অবশ্য পরবর্তী কালে ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া বিলাতের ন্যাপেও বিস্তার লাভ করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাপ বিভক্ত হওয়ার ফলে তার প্রতিক্রিয়ায় বিলাতের ন্যাপে বিভক্তি আসে। মােজাফফর পন্থী ন্যাপ খায়রুল হুদা, মাহমুদ এ. রউফ, ডাঃ নুরুল আলম ও হাবিবুর হরমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে চলাকালে বিলাতের আন্দোলনে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করে অবদান রাখে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ ছাড়াও বিলাত প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী কিছু কমী সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিভিন্ন সংগ্রামে উপরােক্ত প্রগতিশীল কর্মীরাও সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিল। তাদের ভূমিকাকেও ছােট করে দেখার অবকাশ নেই। প্রগতিশীল যে সকল কর্মী দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের কাজ করছিলেন তাদের মধ্যে তাসাদুক হােসেন, ব্যারিষ্টার সাখাওয়াত হােসেন, ব্যারিষ্টার জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিষ্টার লুৎফুর রহমান সাহজাহানের নাম উল্লেখযােগ্য। তাসাদুক হােসেন এককালীন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি লন্ডনের কেন্দ্রবিন্দুতে গঙ্গা রেষ্টুরেন্টের মালিক ছিলেন।

এই গঙ্গা রেষ্টুরেন্ট বিলাত প্রবাসী প্রগতিশীল কর্মীদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বর্তমানে এই গঙ্গা রেষ্টুরেন্টের অস্তিত্ব আর নেই।  বিলাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গ্রুপগুলাের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল লন্ডন। তবে বার্মিংহাম, মানচেস্টার, লীডস, ব্রাডফোর্ড, মিডলসেক্স, লুটন, সাউথহল, গ্লাসগাে, লেষ্টার, সেন্ট অলবন্স, কভেন্ট্রি, পাের্টসমাউথ, টিপটন, সাউথ হল, ওল্ডহাম ও ইয়র্কশায়ার এর যে সকল অঞ্চলে বাঙালীরা বসবাস করতেন সে সকল অঞ্চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আঞ্চলিক কমিটি সংগঠিত হয়েছিল। এছাড়া পেশাগত কিছু সংগঠন স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্ম প্রকাশ করে। বিভিন্ন শহরে শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ বা সমিতি নামে অগণিত সংগঠন জন্ম লাভ করে ষাটের দশকে। বিভিন্ন শহর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বাঙালী যুব সংগঠন ও ছাত্র সংগঠন স্বাধিকার আন্দোলনের শপথে আত্মপ্রকাশ করে। এই সকল কর্মকাণ্ডের ও সংগঠনের মাধ্যমে কিছু আঞ্চলিক নেতৃত্বে গড়ে উঠে। তাদের মধ্যে বার্মিংহামের জগলুল পাশা, আজিজুল হক ভূইয়া, তােজাম্মেল হক (টনি হক), আফরােজ মিয়া, ইসরাইল মিয়া; মাঞ্চেষ্টারের হাজী আবদুল মতিন; ইয়র্কশায়ারের মনােয়ার হােসেন, ব্রাডফোর্ডের আবদুল মুসাব্বির তরফদার ও শারাফত আলী, লুটনের দবির উদ্দিন ও বােরহান উদ্দিন, সেন্ট অলবনূসের আবদুল হাই; গ্লোসগাে এর ডাঃ মােজাম্মেল হক, ডাঃ রফিউদ্দিন ও কাজী এনামুল হক; লীডস্ এর মিয়া মােঃ মুস্তাফিজুর রহমান, খায়রুল বাশার, মােঃ নুরুদ্দোহা ও ডাঃ ফজলুল করিম; নর্থহাম্পটনের এ. এইচ. চৌধুরী, বি, মিয়া ও ইস্রাইল আলী; লেষ্টারের নূর মােহাম্মদ খান; ল্যাংকেশায়ারের কবীর চৌধুরী; কভেন্ট্রি এর সামসুল হুদা চৌধুরী ও মতছিম আলী; টিপটনের আলতাফুর রহমান চৌধুরী ও আসব আলী, সাউথ হলের আবদুস সালাম চৌধুরী ও এম. ইউ. আহসান এবং ইয়র্কশায়ারের জহিরুল হক এর নাম উল্লেখযােগ্য। ষাটের দশকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে লন্ডন ভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং আঞ্চলিক সংগঠনে নেতৃবৃন্দই ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট বলে খ্যাত বিলাত আন্দোলনের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন

১৯৭১ সালে বিলাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে প্রচার কার্যে প্রবাসী ছাত্ররা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্ররা পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন এবং এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ছাত্র সমিতির মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকে। লন্ডনের ‘পাকিস্তান হাউজে অবস্থিত পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এই ছাত্র ফেডারেশনে নেতৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ের দাবি জোরদার করার লক্ষ্যে বাঙালি ছাত্ররা বিলাতে ঐক্যবদ্ধ হয়। বাঙালি ছাত্রদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনে মাহমুদুর রহমান, আমিরুল ইসলাম, শরফুল ইসলাম খান, সুবেদ আলী টিপু ও একরামুল হক প্রমুখ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের বৈঠক বাতিল ঘােষণার প্রতিবাদ করার জন্য পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের এক সভায় পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বের সাথে বাঙালি সদস্যদের মতবিরােধ হয়। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতির জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক গৃহিত পদক্ষেপকে নিন্দার প্রস্তাব নিয়ে মতবিরােধ হয় এবং অপ্রীতিকর ঘটনায় পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সভা পণ্ড হয়ে যায়। পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের তত্ত্বালীন সভাপতি বাঙালি (একরামুল হক) হওয়া স্বত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি ফেডারেশনের মাধ্যমে উত্থাপন করা সম্ভব হয় নাই। তার ফলশ্রুতিতে বাঙালি ছাত্রদের অংশ গ্রহণে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় ।

এতদ্‌উদ্দেশ্যে পাকিস্তান যুব সমিতি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তাতে শুধুমাত্র বাঙালি ছাত্র ও যুবকদের সদস্য করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগে যারা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, সুলতান মাহমুদ শরীফ, এ, কে, নজরুল ইসলাম, আহমেদ হােসেন জোয়ার্দার, এ. টি. এম, ওয়ালী আশরাফ, মনজুর মাের্শেদ, সামসুল আলম চৌধুরী, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, লুৎফর রহমান সাহজাহান, আখতার ইমাম, শফিউদ্দিন মাহমুদ বুলবুল, সামসুল আবেদীন, আনিছ আহম্মদ, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও লেখকের নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য । উপরােক্ত সংগঠনের উদ্যোক্তা সদস্যদের পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বিরােধী বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্র বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রবাসী ছাত্রদের মধ্যে পাকিস্তান বিরােধী তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির মেরুকরণ শুরু হয় মূলত পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নির্বাচনকে উপলক্ষ করে। বিলাত প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ অবশ্য পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের অংশ পাকিস্তান যুব ফেডারেশনের সাথে ঐক্যমত পােষণ করেননি, বরং পাকিস্তানী ছাত্রদের সমঝােতা করে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এই আপােসকামী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বেশির ভাগই তৎকালীন সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন এন এস এফ এর কর্মী ও সমর্থক ছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তান হাউজ

ষাটের দশকে পাকিস্তান হাউজে অবস্থিত ছাত্র ফেডারেশনে বিভেদকে কেন্দ্র করে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শােষণ ও নির্যাতনের প্রশ্নের বাঙালি ছাত্রদের সাথে পাকিস্তানী ছাত্রদের বিরােধ তীব্র হয়। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীদের সহযােগিতায় উত্তর লন্ডনে ১৯৬৪ ইং সনে ৯১নং হাইবারী হীলে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তানী দূতাবাসের নানা হুমকি ও দেশদ্রোহিতার অভিযােগকে উপেক্ষা। করে ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ প্রতিষ্ঠা বিলাতের প্রবাসী বাঙালিদের কাছে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। পাকিস্তানীরা এই হাউজ’ প্রতিষ্ঠাকে নিছক একটি বাড়ি ক্রয় হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তাদের দৃষ্টিতে এই আলাদা হাউজ’ প্রতিষ্ঠাকে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ পশ্চিম লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তান হাউজের’ বিকল্প এবং বাঙালিদের আলাদা অস্তিত্বের প্রমাণ স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই উদ্যোগের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের নানা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল এবং পরবর্তিকালে মুক্তিযুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান হাউজ’ ও তার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বিশেষ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধিকারের সংগ্রামে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে বিলাত প্রবাসীদের কাছে “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” একটি আলাদা অস্তিত্বের প্রতিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” প্রতিষ্ঠার পিছনে যে চেতনা কাজ করেছিল তা ছিল স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। ১৯৬২ সনের দিকে প্রতিষ্ঠিত “উত্তর সূরী” নামক এক সংগঠনের একদল প্রগতিশীল ছাত্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পাকিস্তানের অব্যাহতভাবে শােষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতন থেকে পরিত্রাণের জন্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় গ্রহণ করে ।

খােলাখুলিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা প্রথম পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” এর পক্ষ থেকে ঘােষণা করা হয় । “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” প্রথমে একটি সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ সালের শেষ দিকে এই প্রতিষ্ঠান থেকে “Unhappy East Pakistan” শিরােনামে একটি বুকলেট প্রকাশ করা হয় যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য, শােষণ ও নির্যাতনের কথা প্রকাশ করা হয়। পরবর্তি সময়ে লন্ডনে বসবাসকারী ব্যবসায়ী, রেষ্টুরেন্ট মালিক ও সমাজকর্মীদের যৌথ প্রয়াসে উত্তর লন্ডনের হাইবারী হীলে “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” এক নামে একটি বাড়ি ক্রয় করা হয়। তাৎপর্য পূর্ণ “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” আন্দোলনের সাথে তকালে লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার জন্য অবস্থানকারী ছাত্রদের মধ্যে ড, কবির উদ্দিন আহম্মদ, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহম্মদ, জাকারিয়া খান চৌধুরী, আমীর আলী, শফিক রেহমান, মিসেস আলেয়া রহমান, আবেদ হাসান, ব্যারিষ্টার আবদুর রশিদ, ব্যারিষ্টার আবুল খায়ের, আলমগীর কবির, ব্যারিষ্টার সাখাওয়াত হােসেন, ব্যারিষ্টার লুৎফর রহমান সাহাজাহান, ফজলে লােহানী, আবুল মনসুর, মেসবাহউদ্দিন, ড. মনােয়ার হােসেন, ড. বেলায়েত হােসেন, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, ফজলে আলী এবং আবিদ হােসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। লন্ডনের যে সকল ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ও সমাজসেবী “পূর্ব পাকিস্তান হাউজ” এর জন্য বাড়ি ক্রয়ে আর্থিক সহযােগিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে গউস খান, নেছার আলী, মােতালেব মিয়া, শফি আহম্মদ ও তৈয়বর রহমানের নাম উল্লেখযােগ্য।

বাংলা পত্রিকা

ষাটের দশকে প্রবাসীদের মধ্যে আরাে একটি উল্লেখযােগ্য জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে লন্ডনে একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। তৎকালে আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে মতামত প্রকাশ ও প্রচারের উদ্দেশ্যে লন্ডনের বালহাম এলাকার ২নং টেম্পারলি রােড থেকে ‘জনমত’ নামে একটি পরিপূর্ণ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ লাভ করে। এককালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, ভাসানীপন্থী রাজনৈতিক কর্মী এবং বাংলাদেশ সংসদের সাবেক এম, পি মরহুম এ. টি. এম. ওয়ালী আশরাফ জনমত’ পত্রিকাটি প্রকাশ ও সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে সহযােগিতা করেন জনমতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনিস আহমেদ। তাদের উভয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দেশপ্রেমিক জাতীয়বাদী প্রবাসী বাঙালিদের সহযােগিতায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে ‘জনমত জনপ্রিয়তা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালে বিলাতে প্রবাসীদের মধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণের দূরবস্থা, বঞ্চনা ও পাকিস্তানের শােষক গােষ্ঠীর অপকর্ম প্রচার এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় শুধুদ্ধকরণের কাজে জনমত’ বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হয়। জনমত’ ১৯৭১ সালে পশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে পি, আই, এ-সহ পাকিস্তান দূতাবাসের প্রদত্ত সকল বিজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুখপত্র হিসেবে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। ইতােপূর্বে অবশ্য কিছু অনিয়মিত প্রচারপত্র ও বুলেটিন স্বাধিকারের স্বপক্ষে প্রচার কার্যে অংশগ্রহণ করে। তবে নিয়মিতভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের খবরাখবর পরিবেশন ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাঙালিদের প্রেরণা জোগাতে জনমত’-এর ঐতিহাসিক ভূমিকা অনস্বীকার্য। নিয়মিত বাংলা সাপ্তাহিক “জনমত” ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কয়েকটি অনিয়মিত বাংলা পত্রিকা লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে ‘মশাল’ নামে। একটি সাপ্তাহিক বামপন্থি চিন্তার বাহক হিসাবে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। ‘মশাল’ এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন শেখ আব্দুল মান্নান। ‘শিখা’ নামে আরেকটি বাংলা সাপ্তাহিক অনিয়মিতভাবে প্রকাশ লাভ করে। এই পত্রিকার দুটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন জনমত’ এর সম্পাদক এ, টি, এম, ওয়ালী আশরাফ এবং পরবর্তিতে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন শেখ আবদুল মান্নান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চীন পন্থিদের মুখপত্র হিসাবে গণযুদ্ধ’ নামে একটি সাপ্তাহিক অনিয়মিভাবে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার সম্পাদনা মণ্ডলির সদস্য ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, মেসবাহ উদ্দিন, জগলুল হােসেন এবং ব্যারিষ্টার লুৎফর রহমান সাহজাহান। মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘ মেয়াদি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধ প্রবাহিত করা (ভিয়েৎনামের ধারায়) ছিল ‘গণযুদ্ধ’ এর মূল বক্তব্য। ষ্টিয়ারিং কমিটি এর উদ্যোগে আফরােজ আফগান চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলাদেশ সংবাদ পরিক্রমা’; পূর্ব বাংলা পাবলিকেশন এন্ড প্রিন্টিং কোম্পানী লিঃ এর পক্ষে ডাইরেক্টর এম. এ. রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানেও একরামুল হকের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ এবং বাংলাদেশ। জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্টের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ” নামে পাক্ষিক পত্রিকা অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। এই সকল পত্রিকা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সমর্থন ও উৎসাহ প্রদানে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালিদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সমর্থন করে আবুল হায়াত নামে এক বাঙালির সম্পাদনায় মুক্তি’ নামে একটি অনিয়মিত পত্রিকাও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। পূর্ব লন্ডনের গ্রান্ড প্যালেস হলের সামনে “লন্ডন এ্যাকশন কমিটি আয়ােজিত জনসভায় বিচারপতি চৌধুরীর। সামনেই মুক্তি’ পত্রিকায় অগ্নি সংযােগ করে প্রতিবাদ করা হয় । ঊনসত্তরের ছাত্র গণআন্দোলন ও আইনজীবী প্রেরণ ষাটের দশকের শেষ দিকে যখন স্বাধিকারের আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে তীব্র আকার ধারণ করে তখন তার হাওয়া স্বাভাবিকভাবেই সুদূর বিলাতেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। উনসত্তরের ছাত্র গণ আন্দোলনের সময়ে বিলাত প্রবাসী বাঙ্গালীরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র-জনতার সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন।

জনমত গঠনে পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পূর্ব বাংলার জনগণের উপর পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর ২৪ বছরের জবরদস্তি শাসনের ফলাফল ও তার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে লিফলেট ও প্রচারপত্র বিলির কার্যক্রম গ্রহণ করে জনমত সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে যখন পাকিস্তান সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসেবে গ্রেফতার করে তখন বিলাত প্রবাসীদের মধ্যে তুমুল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। বিলাত প্রবাসী বাঙালিরা এই ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভের আয়ােজন করে এবং মামলা পরিচালনার জন্য বিলাত থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিলাত প্রবাসীরা চাঁদা সংগ্রহ করে প্রখ্যাত একজন “কুইনস কাউন্সিলর”কে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থনের জন্য ঢাকায় প্রেরণ করেছিলেন। তৎকালীন সরকার সেই বৃটিশ আইনজীবীকে নির্বিঘ্নে কর্তব্য পালনে নানা রকমের বাধা সৃষ্টি করেছিলেন এবং বেশি দিন ঢাকায় থাকতে দেননি। এই আইনজীবীর আগমন বিচারের প্রক্রিয়ায় কতটুকু শুভ প্রভাব বিস্তার করেছিল তা স্পষ্ট করে বলা না গেলেও তথাকথিত বিচার চলা সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে তখন যে আন্দোলন চলছিল তার গতি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিপুল প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে তথাকথিত মামলার প্রধান বিচারককে পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে হয়েছিল এবং পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। ঊনসত্তরের ছাত্র-গণ আন্দোলন বিলাত প্রবাসীদের এই অবদান ক্ষুদ্র হলেও তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। একজন আইনজীবী প্রেরণ করে দেশের জনগণের মধ্যে আন্দোলনের উৎসাহ সৃষ্টির সাফল্য থেকে বিলাতের প্রবাসীরা দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ববােধের এবং দেশের দুর্দিনে জনগণের পাশে দাঁড়ানাের যে আত্মবিশ্বাস ও শিক্ষা লাভ করেছিল তা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকালে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।

সত্তরের জলােচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়

১৯৭০ সালে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে যখন পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত জনগণের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করে বিমাতা সুলত মনােভাবের পরিচয় দিলেন তখন বিলাত প্রবাসী বাঙালিরা তা ফলাও করে প্রচার করেছিল। লন্ডনের রাস্তায় বাঙালিরা সাহায্যের হাত পেতে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানী শাসকদের আসল চেহারা উন্মােচন করে দিতে সাহায্য করেছিল। বিভিন্ন সাহায্যসংস্থা ও দুতাবাসসমূহে বাঙালিরা লবিং’ করে পাকিস্তানের প্রশাসনের অবহেলার কথা তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর এহেন মনােবৃত্তির পরিচয় বৃটিশ সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচার করে তাদেরকে বাঙালিদের প্রতি সংবেদনশীল করে গড়ে তুলতে নানা প্রচারপত্র সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এই কাজে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বি, বি, সি, বাংলা বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ। তাদের মধ্যে সিরাজুর রহমান, প্রয়াত শ্যামল লােধ, কমল বােস, এ, টি, এম। ওয়ালী আশরাফ সহ বিলাতে অধ্যয়নরত কিছু ছাত্র বিশেষ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছিল। সাংবাদিকদের সংবেদনশীল মনােভাবের ফলে ১৯৭০ এর-ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের সময় বিলাতের পত্র পত্রিকা পাকিস্তান প্রশাসনের সমালােচনা মুখর ছিল যার ফলে বৃটিশ জনমত বাঙালিদের পক্ষে সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী এই আন্দোলনকে ‘বায়াফ্রার’ মতাে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে চিত্রায়িত করতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু বৃটিশ। সাংবাদিকদের সহানুভূতি এবং বৃটিশ জনমত বাঙালিদের পক্ষে থাকায় মুক্তিযুদ্ধকালে বৃটিশ। পত্রপত্রিকা বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মুক্তি। সংগ্রামে বিশ্ব প্রচারকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লন্ডনের সংবাদপত্রকে প্রভাবান্বিত করার ক্ষেত্রে বিলাত প্রবাসীদের ভূমিকা বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!