বাঙলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রায় ৫০ জন পাকসৈন্য নিহত
(স্টাফ রিপাের্টার)
কলকাতা, ২৮ সেপ্টেম্বর বাঙলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে গত ২১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী হাতে কমপক্ষে ৪৯ জন পাকিস্তানী হানাদার সৈন্য নিহত হয়েছে।
বাঙলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে প্রচারিত এক বুলেটিনে জানানাে হয়েছে যে, বাঙলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় ব্যাপক কম্যান্ডাে অভিযান চলছে। তার কয়েকটি প্রধান প্রধান অভিযানের উল্লেখ করে জানাে হয়েছে :
ঢাকা কুমিল্লা চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে মহরী এলাকায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও তিনজন আহত হয়।
২১ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনী কলিমপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাটির উপরে আক্রমণ চালিয়ে ৪ জন শত্রু সৈন্য খতম ও ১২ জনকে আহত করে। ২৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর হাতে ৬ জন ২০০ গজ দীর্ঘ রেল পথ তারা মাইন বিস্ফোরণের সাহায্যে বিধ্বস্ত করে।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতায় চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে বিদেশী নাবিকদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি
মুজিবনগর, ১ অক্টোবর (ইউএনআই)- মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের তৎপরতায় সম্প্রতি বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরের বিদেশী নাবিকদের মধ্যে প্রচন্ড সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাপ্ত বিভিন্ন সংবাদে জানা গেল, বিদেশী বাণিজ্য জাহাজের নাবিকরা বাঙলাদেশের বন্দরে অবস্থানকালে কর্তৃপক্ষের কাছে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেছেন।
সংবাদে আরাে প্রকাশ যে, গত ২১ সেপ্টেম্বর গেরিলারা ইমতিয়াজ বক্স’ নামে একটি পাকিস্তানী জাহাজকে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে ধ্বংস করে দিয়েছেন। অপরদিকে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধির ফলে খােদ ঢাকা শহরে পাকসৈন্যরা চলাফেরায় সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে চলেছে।
কয়েকদিন পূর্বে ভিখারির ছদ্মবেশে কিছু গেরিলা একটি সেনাবাহিনী জীপ আক্রমণ করে এবং গ্রেনেডের সাহায্যে একজন পাক সামরিক অফিসারসহ বেশ কিছু পাকসৈন্যকে খতম করেন। এর প্রতিশােধ নিতে পাকবাহিনী শহরের বহু ভিখারিকে হত্যা করেছে।
আজ মুক্তিবাহিনী কর্তৃক প্রচারিত এক বুলেটিনে ঘােষণা করা হয়েছে যে, গত এক সপ্তাহে বাঙলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে কমপক্ষে ৭৪ জন পাক-হানাদার গেরিলা আক্রমনে নিহত হয়েছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর মুক্তিবাহিনীর গােপন মাইন বিস্ফোরণে আখাউরা রেল স্টেশনের উত্তরে রূপ এলাকায় বহু রেলওয়ে ট্রাক উল্টে গেছে। ৬ জন হানাদার সেনা নিহত হয়েছে।
ভারতের মাটিতে পাক গােলাবর্ষণ অব্যাহত
২৬ সেপ্টেম্বর থেকে একটানা তিনদিন সীমান্তের ওপার থেকে পাকসেনারা গােলাবর্ষণ করে ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে ৮ ব্যক্তিকে নিহত ও ১৩ জনকে আহত করেছে। নিহতদের মধ্যে ৪ জন শরণার্থী রয়েছেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর পাকসেনারা পূর্ববাঙলার ধর্মগড় এলাকা থেকে ভারতের সিধাই থানাস্থ কার্যলাম পাড়ায় ৬ ঘণ্টা ধরে গােলাবর্ষণ করে। ফলে ২ জন শরণার্থী নিহত এবং অপর পাঁচজন আহত হয়েছেন।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিম ত্রিপুরার করমছােরা থানাস্থ রহিমপুর গ্রামে পাক গােলায় ৩ জন ভারতীয় নিহত হয়েছেন। একাধিক আহত হয়েছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ ত্রিপুরার রঙ্গমুরা গ্রামে পাকগােলার আঘাতে ২ জন শরণার্থী নিহত এবং ১জন আহত হয়েছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর মিয়াবাড়িতে ১ জন ভারতীয় এবং ১ জন আহত হয়েছেন। ঐ দিন দক্ষিণ ত্রিপুরার রাণীবাড়ীতে পাকগােলার পাঁচজন অসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
পাক সামরিক জুন্টার আর্তনাদ
পাকসামরিক জুন্টা আজ রেডিও পাকিস্তান মারফৎ এক আবেদনে সংবাদপত্র ও জনসাধারণকে গুজব ছড়াতে বারণ করেছে। কারণ দেশ এক অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে।
মুক্তিবাহিনীর হাতে ৬৪ জন পাকসৈন্য নিহত
কলকাতা থেকে স্টাফ রিপাের্টার জানাচ্ছেন, গত পাঁচদিনে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী সেক্টরে এবং ঢাকা ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ হেনে ৬৪ জন পাকহানাদার খতম করেছে।
মুজিবনগর থেকে বাঙলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জনসংযােগ বিভাগ থেকে প্রচারিত যুদ্ধ বার্তায় ঐ তথ্য জানানাে হয়েছে।
২৮ সেপ্টেম্বর রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী সেক্টরের লিখালদেবী অঞ্চলে পাক ফৌজের সঙ্গে এক যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ৬ জন শত্রু সৈন্য খতম করে। এই যুদ্ধে ৩ জন পাক সৈন্য আহত হয়। একই দিনে ময়মনসিংহ জেলার দেওয়ানগঞ্জে একটি পাক টহলদার বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ হানার ফলে মুক্তিবাহিনীর হাতে ২ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয়। ঢাকা জেলার করমি ও জয়দেবপুরে মুক্তিবাহিনীর অনুরূপ অতর্কিত আক্রমণে ১২ জন পাকসৈন্য নিহত এবং ৭ জন আহত হয়।
২৭ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর জেলর জয়মনিরহাটে টহলদার পাকসৈন্যদের আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী ৬ জনকে নিহত করে। ২৬ সেপ্টেম্বর দেবপুর অঞ্চলে অনুরূপ আক্রমণের ফলে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। ২৬ তারিখ রাত্রে আরেকটি আক্রমণের দরুন উত্সা অঞ্চলে ১৫ জন পাকসৈন্য খতম করে মুক্তিবাহিনী ২টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়।
২৫ সেপ্টেম্বর শ্রীহট্ট জেলার অন্ধরমানিক অঞ্চলে পাকফৌজের উপর গুলি চালিয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর গুলি চলিয়ে মুক্তিবাহিনী ১৫ জন পাক সৈন্যকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে ছিল পাকফৌজের জনৈক জুনিয়র কমিশনড় অফিসার। একই দিনে মুক্তিযােদ্ধারা গুথুমা অঞ্চলে ৩ জন পাক সৈন্য নিহত এবং ৬ জনকে আহত করেন।
শ্রীহট্ট জেলা থেকে সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, সুলিপুকার, পাকুরিয়া ঘাট, সৈন্যদের উপর মর্টার সহ আক্রমণ হেনে মুক্তিবাহিনী ১০ জন পাক সৈন্য নিহত এবং ১৬ জনকে আহত করে। মুক্তিযােদ্ধারা ৭টি বাঙ্কারও বিধ্বস্ত করেছেন।
সূত্র: কালান্তর, ২.১০.১৯৭১